Saturday, December 27, 2025
HomeScrollFourth Pillar | নির্বাচন কমিশন মানুষ নিয়ে কাটাকুটির খেলা খেলছে
Fourth Pillar

Fourth Pillar | নির্বাচন কমিশন মানুষ নিয়ে কাটাকুটির খেলা খেলছে

দেশজুড়ে যদি SIR চলতে থাকে, তবে বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যা ১৪-১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়!

Written By
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক কাঠামোর সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হল তার নির্বাচন প্রক্রিয়া। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ভারতের নির্বাচন কমিশন যে ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিউ’ বা এসআইআর ২.০ শুরু করেছে, তা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে একটা ভয় সংশয় আর আতঙ্ক দানা বাঁধছে। সোজা কথায় বললে, সাধারণ ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে কমিশন যেন একটা ‘কাটাকুটির খেলা’ শুরু করেছে। যে খসড়া তালিকাগুলো সামনে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ আর রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলোতে কোটি কোটি মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে স্রেফ মুছে ফেলা হয়েছে। কমিশনের দাবি অনুযায়ী, এই মানুষগুলো হয় মারা গিয়েছেন, নয়তো তাঁরা ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন, অথবা তাঁদের নাম একাধিক জায়গায় নথিবদ্ধ আছে। কিন্তু তথ্যের গভীরে ঢুকলেই দেখা যায়, এই বিশাল সংখ্যক মানুষের নাম বাদ দেওয়ার পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক প্রশাসনিক প্রবণতা, যা সরাসরি দেশের দরিদ্র আর প্রান্তিক মানুষকে আঘাত করছে। এসআইআর মডেল ২.০ এবং একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ‘ভোট ছাঁটাই’ হয়ে উঠেছে আর এই ব্যাপারটা নিয়ে আরও সিরিয়াস আলোচনা হওয়া উচিত, কারণ ওপরের থেকে যা মনে হচ্ছে, বিষয়টা তারচেয়ে অনেক বড় আর ভয়ঙ্কর। আসলে এই স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিউ বা এসআইআর কী? কমিশনের ভাষায়, গত ২০ বছরে দেশে প্রচুর নগরায়ন হয়েছে, মানুষ রুটিরুজির টানে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে ভোটার তালিকায় প্রচুর ভুল নাম ঢুকে পড়েছে। তাই ২০০২-২০০৪ সালের পর আবার এক নতুন করে ঘর-ঘর গিয়ে ভোটার তালিকা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিশনের যুক্তি অনুযায়ী, স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য এই ‘শুদ্ধিকরণ’ দরকার। এমনিতে এই কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছে আর সাধারণভাবে এতে আপত্তি করারও কিছু নেই। কিন্তু এই শুদ্ধিকরণের যে পদ্ধতি কমিশন বেছে নিয়েছে, সেটাই বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এখানে কমিশনের মূল শর্ত হল – ভোটারদেরই প্রমাণ করতে হবে যে, তাঁদের নাম বা তাঁদের পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় ছিল। এই ‘লিগ্যাসি লিঙ্কেজ’ বা উত্তরাধিকার প্রমাণের দাবিই আসলে একটা প্রচ্ছন্ন এনআরসি বা নাগরিকত্ব পরীক্ষার চেহারা নিয়েছে। যার কাছে ২৩ বছর আগের কাগজ নেই, তাঁর নামই যেন ভোটার তালিকা থেকে কেটে দেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, গোয়া আর পুদুচেরির মতো কয়েকটা রাজ্য আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়েই প্রায় ১.১ কোটি মানুষের নাম বাদ পড়ার খবর এসেছে খসড়া তালিকায়। পশ্চিমবঙ্গেই প্রায় ৫৮ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছে। রাজস্থানে এই সংখ্যাটা প্রায় ৪২ লক্ষের কাছাকাছি। উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে তো পরিস্থিতি আরও মারাত্মক। সেখানে খসড়া পর্যায়ে প্রায় ২ কোটি ৯৬ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, যা ওই রাজ্যের মোট ভোটারের প্রায় ১৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে সারা দেশজুড়ে যদি এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তবে বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যা ১৪-১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

এর মানে কি এই যে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষই ‘ভুয়ো’ ভোটার ছিলেন? বিহারে যখন প্রথম এই এসআইআর ২.০-এর কাজ শুরু হয়, তখনই অনেকে এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দেখা যায়, বিহারের ২৪৩টা বিধানসভা কেন্দ্র মিলিয়ে প্রায় ৬৫ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে। ‘ভোট ফর ডেমোক্রেসি’ (VFD) নামক এক নাগরিক সংগঠনের তদন্তে উঠে এসেছে কিছু আশ্চর্য তথ্য। দেখা গিয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু দিনের মধ্যে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার এক জ্যামিতিক উল্লম্ফন, জিওমেট্রিকাল প্রগ্রেস হয়েছে,  ২০২৫ সালের ২১ থেকে ২৫শে জুলাই—এই মাত্র চার দিনের মধ্যে বিহারে মৃত ভোটারের সংখ্যা ১৬.৫ লক্ষ থেকে একলাফে বেড়ে ২২ লক্ষে পৌঁছে গিয়েছে। মানে মাত্র চার দিনে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ ‘মারা গিয়েছেন’ বলে কমিশন দাবি করছে। যমরাজও আঁতকে উঠবেন এই পরিসংখ্যান শুনে। সাধারণ স্ট্যাটিসটিক্স বা প্রবাবিলিটির অংক বলে এটা এক অসম্ভব ঘটনা। আরও মজার ব্যাপার হল, কমিশন যাদের নাম বাদ দিয়েছে, তাদের বড় একটা অংশকে ‘স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত’ বা ‘অনুপস্থিত’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই মানুষগুলো কোথায় গিয়েছেন, তার কোনও সঠিক হদিস কমিশনের কাছে নেই। মানে বলতে চাইছি, মানুষগুলো তো উবে যেতে পারে না। উল্টোদিকে, বিহারে জেনুইন ভোটারদের ফর্ম ডিজিটালাইজ করার গতির চেয়ে নাম বাদ দেওয়ার গতি ছিল দ্বিগুণ। বিরোধীদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী দলের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে বেছে বেছে নাম কাটা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যখন হস্তক্ষেপ করে এবং কমিশনকে নির্দেশ দেয় যে, বাদ পড়া ৬৫ লক্ষ মানুষের নামের তালিকা প্রকাশ করতে হবে, তখন কমিশন প্রথমে টালবাহানা করে এবং পরে স্রেফ পিডিএফ ছবি আকারে তালিকা তুলে দেয়, যাতে কেউ সহজে সার্চ করে তথ্য না পায়। এই লুকোচুরিই বলে দিচ্ছে যে, পর্দার আড়ালে বড় কোনও খেলা চলছে। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজীর বন্ধু লুঠেরারা বিদেশে বসে ফূর্তি করছেন

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভোটার তালিকা সংশোধনের নাম উঠলেই একটা বাড়তি উদ্বেগ তৈরি হয়। এসআইআর ২.০-এর খসড়া তালিকা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ৫৮ লক্ষ নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন উদ্বাস্তু এবং পরিযায়ী মানুষেরা। বিশেষ করে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন, যারা বিভিন্ন সময় ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসেছেন, তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। বিজেপি এমপি’ই বলছে ১ লক্ষ, কিন্তু আশঙ্কা ৫ লক্ষ মতুয়া ভোতারের নাম বাদ যাবে। কমিশন যেহেতু ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি হিসেবে মানছে, তাই যাঁরা ২০০২ সালের পরে ভারতে এসেছেন বা যাঁরা নথিপত্র হারিয়ে ফেলেছেন, তাঁদের নাম সরাসরি তালিকা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। অনেক মতুয়া পরিবার কয়েক দশক ধরে ভারতে বাস করছেন, ভোট দিচ্ছেন, এমনকি তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও আছেন, কিন্তু এখন হঠাৎ করে তাঁদের বলা হচ্ছে যে, ২৩ বছর আগের প্রামাণ্য নথি ছাড়া তারা ভোটার থাকতে পারবেন না। বনগাঁ বা কৃষ্ণনগরের মতো সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার অশোক সরদার বা প্রদীপ করের মতো সাধারণ মানুষেরা, যারা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে দিন কাটান, ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা যাওয়ার ভয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। প্রদীপ করের সুইসাইড নোটে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল যে, ‘এনআরসি-ই আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী’। কমিশনের এই পদ্ধতিগত নিষ্ঠুরতা সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করে দিয়েছে যে, এটা ভোটার তালিকা সংশোধন নয়, বরং তাঁদের ঘরছাড়া করার একটা নীল নকশা। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মতো দলগুলোও অভিযোগ করেছে যে, নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করেই এই নাম কাটার তোড়জোড় চলছে। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন কমিশনের এই কাটাকুটির খেলা এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। লখনউ বা গাজিয়াবাদের মতো শহরে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। গাজিয়াবাদে এই হার ৩৬.৬৭ শতাংশ, লখনউতে ৩৯ শতাংশের কাছাকাছি। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেই এক জনসভায় বলেছিলেন যে, এই বাদ পড়া ভোটারদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই নাকি তাঁর দলের অনুসারী। যদিও বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব অভিযোগ করেছেন যে, সরকার আসলে বিরোধীদের ভোটগুলোকেই তালিকা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা জেলায় বিপিন যাদব নামের একজন সরকারি স্কুল শিক্ষক, যিনি বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার) হিসেবে কাজ করছিলেন, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় এসডিও এবং বিডিও তাঁকে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছিলেন, যাতে তিনি বিশেষ একটি পিছিয়ে পড়া জাতির ভোটারদের নাম তালিকা থেকে কেটে দেন। এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে বুঝতে হবে যে, নির্বাচন কমিশন কোনও স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নয়, বরং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণ করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। যখন একজন সরকারি আধিকারিককে ‘টার্গেট’ দিয়ে নাম কাটাতে বাধ্য করা হয়, তখন গণতন্ত্রের কোনও ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনের এই কাটাকুটির খেলার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন নিচুতলার সরকারি কর্মীরা, যাঁদের আমরা বিএলও বলে জানি। এই বিএলওরা বেশিরভাগই সাধারণ প্রাথমিক শিক্ষক বা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। কমিশন এই বিশাল সংশোধন প্রক্রিয়াটা মাত্র দু-তিন মাসের মধ্যে শেষ করার যে নির্দেশ দিয়েছে, তা এক কথায় অমানবিক। সাধারণত যা তিন বছর ধরে ধীরেসুস্থে করা উচিত, তা দুম করে দু’মাসে করার চাপে অনেক বিএলও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সারা দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ জন বিএলও-র মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই আত্মহত্যা বা অত্যধিক চাপে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণে। পশ্চিমবঙ্গের রিঙ্কু তরাফদারের ঘটনা শুনলে কার চোখে জল আসবে না? ৫১ বছর বয়সী এই স্কুল শিক্ষিকা কৃষ্ণনগর বিধানসভা কেন্দ্রে বিএলও হিসেবে কাজ করছিলেন। কাজের চাপে দিশেহারা হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন এবং তাঁর সুইসাইড নোটে লিখে যান, ‘এই অমানবিক কাজের চাপ আমি আর সহ্য করতে পারছি না’। মালবাজারের শান্তিমণি এক্কা নামে আর একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীও একই কারণে সুইসাইড করেন। তাঁকে দেওয়া ফর্মগুলো ছিল বাংলায়, অথচ তাঁর এলাকা ছিল হিন্দিভাষী, তিনি নিজেও বাংলা জানতেন না। ফলে কাজ করতে না পেরে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন আধিকারিকরা তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থার এই পাথর-হৃদয় আচরণগুলোই প্রমাণ করে যে, কমিশনের কাছে ভোটার বা কর্মী কারও জীবনেরই কোনও মূল্য নেই। তাদের কাছে শুধু সংখ্যার খেলাটাই বড়।

এবারে একটা খুব বড় তাত্ত্বিক এবং আইনি প্রশ্নে আসা যাক। নির্বাচন কমিশন যদি দাবি করে যে, সারা দেশে ১০ শতাংশ বা প্রায় ১৪-১৫ কোটি মানুষ ভুয়ো ভোটার ছিলেন, তবে একটা সাংবিধানিক সংকট তৈরি হওয়া অনিবার্য। একটু ভেবে দেখুন, এই কোটি কোটি ভোটারই তো ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বা বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। তাঁদের ভোটেই দেশের বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরা নির্বাচিত হয়েছেন। এখন যদি কমিশন বলে যে, এই ভোটাররা ‘ভুয়ো’ ছিল, তবে কি বর্তমান সরকারগুলোর আইনি বৈধতা বা লিগ্যাল স্ট্যাটাস থাকবে? রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছিলেন যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে অনেক জায়গায় ‘ভোট চুরি’ হয়েছে। তিনি হরিয়ানার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সেখানে ২৫ লক্ষ ভোট ছিল ভুয়ো। একজন ব্রাজিলীয় মডেলের ছবি ভোটার তালিকায় ব্যবহার করে হরিয়ানার বিভিন্ন বুথে অন্তত ২২ বার ভোট দেওয়ানো হয়েছে। রাজস্থানেও প্রায় ৪২ লক্ষ ভোটার উধাও হয়ে যাওয়া একই দিকে ইঙ্গিত করে। মানে কমিশনের এই কাটাকুটির খেলা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আগে প্রচুর ভুয়ো নাম ঢুকিয়ে নির্বাচন জেতা হয়েছে, আর এখন সেই নামগুলো ডিলিট করে দিয়ে একটা ‘পরিষ্কার’ ইমেজ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে যারা আসল এবং বৈধ ভোটার, সেই দরিদ্র মানুষগুলোই বলি হচ্ছেন। কমিশনের এই খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের কারণে কোটি কোটি মানুষ আজ তাদের সাংবিধানিক অধিকার হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। যদি দেখা যায় কারা সবচেয়ে বেশি তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন, তবে একটা পরিষ্কার প্যাটার্ন ধরা পড়ে। বাদ পড়ছেন কিন্তু মূলত দরিদ্র মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিক, আর যারা পড়াশোনা জানেন না। একজন সম্পন্ন মানুষের কাছে পাসপোর্ট বা ইনকাম ট্যাক্সের নথিপত্র থাকে, যা দিয়ে তিনি সহজেই তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন। কিন্তু একজন গ্রাম থেকে আসা শ্রমিকের কাছে ২০০২ সালের নথিপত্র কোথায় থাকবে? ছত্তিশগড়ের অনেক আদিবাসী এলাকা থেকে খবর আসছে যে, ‘সালওয়া জুডুম’-এর কারণে যাঁরা ঘরছাড়া হয়েছিলেন, তাঁদের আর নতুন করে ভোটার তালিকায় জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। কমিশন দাবি করছে যে, তারা খুব আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। কিন্তু সেই সফটওয়্যারের উপরেই তাদের ভরসা নেই, বিএলও-কে দেওয়া অ্যাপ ৬০ বার, হ্যাঁ ৬০ বার আপডেশন হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে কমিশন স্বীকার করেছে যে, তাদের ডি-ডুপ্লিকেশন সফটওয়্যার বা একই নামের ভোটার ধরার প্রযুক্তিটি তেমন কার্যকর ছিল না বলে তারা সেটা বাতিল করে দিয়েছে। এখন তারা সরাসরি মানুষের কাছ থেকে সেলফ-ডিক্লারেশন নিচ্ছে। কিন্তু ভাবুন তো, একজন দরিদ্র মানুষ যখন তাঁর ফর্ম ফিলাপ করতে সাইবার ক্যাফেতে যান বা বিএলও-র কাছে যান, তখন তাঁকে কত রকমের বাধার সামনে দাঁড়াতে হয়। অনেক সময় বিএলওরা ইচ্ছা করে বা ভয়ে প্রান্তিক মানুষের নথিপত্র গ্রহণে অনীহা দেখান। ফলে ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়ার আড়ালে কার্যত একটা ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ধনীরা ভোটার থাকছে আর গরিবরা বাদ পড়ছে।

নির্বাচন কমিশনের মতো একটা শক্তিশালী এবং স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা যখন এই ধরনের এক অস্বচ্ছ ধোঁয়াটে মাথা মুন্ডু নেই এমন এক প্রক্রিয়ায় মানুষকে নামিয়ে দেয়, তখন গণতন্ত্রের ওপর মানুষের বিশ্বাস টলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। ‘ভোট ফর ডেমোক্রেসি’-র রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে, অনেক বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ের ব্যবধানের চেয়ে ভোটার ডিলিশনের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। অর্থাৎ কোনও আসনে কেউ হয়তো ১০ হাজার ভোটে জিতেছে, কিন্তু সেখানে ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার মানুষের। এটা যদি সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়, তবে তাকে ‘নির্বাচন’ না বলে সেটাকে ‘সিলেকশন’ বলাটাই তো ভালো। আসলে নির্বাচন কমিশন যে কাটাকুটির খেলা খেলছে, তাতে লাভের পাল্লা নির্দিষ্ট এক পক্ষের দিকেই ঝুঁকছে। যেভাবে তাড়াহুড়ো করে এই কাজ চালানো হচ্ছে, যেভাবে বিএলও-দের উপর চাপ তৈরি করা হচ্ছে এবং যেভাবে স্বচ্ছতার অভাবে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত, তাতে পরিষ্কার যে, কমিশনের এই পদক্ষেপ কোনওভাবেই গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে মেলে না। যদি ভোটার তালিকা সংশোধন করতেই হয়, তবে তা হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদী এবং সংবেদনশীল পদ্ধতিতে। শুধু মৃত বা স্থানান্তরিত নাম কাটা নয়, নতুন যোগ্য ভোটারদের নাম তোলাও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কমিশন যেন শুধু বাদ দেওয়ার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। এই সন্দেহের কারণ সুপ্রিম কোর্ট বারবার কমিশনকে স্বচ্ছ হওয়ার কথা বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তথ্য যদি সার্চযোগ্য টেক্সট ফরম্যাটে না থাকে, তবে সাধারণ মানুষ জানবে কী করে যে, কার নাম কেন কাটা হল? এই অন্ধকার কাটাতে না পারলে আগামীদিনে ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়া শুধু একতরফা প্রচারের জায়গায় পরিণত হবে। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রে ভোটাররাই আসল মালিক। সেই মালিকদেরই যদি তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেই গণতন্ত্রের কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকবে না।

দেখুন আরও খবর:

Read More

Latest News