সেই সিংহওলা মোদিজির পোস্টারের কথা মনে আছে? পাশে সিংহ, মোদিজির সহাস্য মুখ, আত্ম নির্ভর ভারত, মেক ইন ইন্ডিয়া। ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। সে পোস্টার হোর্ডিং সর্বত্র ছিল, রাস্তার মোড়ে, পেট্রল পাম্পে, স্কুল কলেজের পাশে, সুলভ শৌচালয়ের পাশেও ঝুলছিল সিংহ আর মোদিজীর মুখ। ১০ বছর হতে চললো, সেই মেক ইন ইন্ডিয়া নিয়ে কোনও কথা শুনতে পাচ্ছেন? মোদিজী জয়পুরে গেলেন রাজস্থানের নির্বাচন মাথায় রেখে প্রচার করলেন, কংগ্রেস চোর, কংগ্রেস বংশানুক্রমিক ইত্যাদি বললেন, মধ্যপ্রদেশে গেলেন, মহিলা আসন সংরক্ষণ বিল নিয়ে প্রচুর বাওয়াল দিলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, তাঁদের আসন সংরক্ষণ নিয়ে কথা বললেন, যদিও ভুত বা ভগবানেরও জানা নেই সেই সংরক্ষণ কবে চালু হবে, তার পরেও তিনি মহিলা আসন সংরক্ষণ নিয়ে বললেন কেবল নয়, বললেন কংগ্রেস জিতে গেলে ঐ অধিকার নাকি কেড়ে নেবে, তার মানে কংগ্রেস জিতে যেতে পারে এরকম একটা চিন্তা তাঁর মাথাতেও ঢুকেছে, তো যাই হোক, অনেক কথা বললেন কিন্তু ঐ মেক ইন ইন্ডিয়া নিয়ে একটা কথাও বললেন না। একটা শব্দও না। কেন? কারণ কিছুই বলার নেই। সেই প্রচারের শুরুর দিনে, আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে কী বলা হয়েছিল? বলা হয়েছিল শিল্পে বৃদ্ধির হার হবে ১২ – ১৪%। আপাতত শিল্পে বৃদ্ধির হার কত? ঐ ৫,৯% এর একটু কম, ২০১৩ তে, মোদিজী আসার আগে ছিল ৫.৯%। মানে কি দাঁড়ালো? ১০ বছর পরে আমরা সামান্য নীচে নেমেছি, ১২-১৪% এক অলীক স্বপ্ন। বলা হয়েছিল উৎপাদন শিল্পে উৎপাদন জিডিপির ২৫% হবে। মানে মোট জিডিপির ২৫% আসবে ম্যানিউফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে, কী হয়েছে? তা এই সময়ে ১৬.৪% এ দাঁড়িয়ে আছে।
এরফলে কী হচ্ছে?
উৎপাদন বাড়েনি, উৎপাদন শিল্পও বাড়েনি, কাজেই কর্মসংস্থানও হয় নি, সারা পৃথিবীতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তো বাওয়াল দেবার মিথ্যে কথা বলার দরকার হয় না, ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিকে বাড়াতে হয়, ছোট, মাঝারি ম্যানিউফ্যাকচারিং শিল্প গড়ে উঠলে বহু মানুষ চাকরি পায়, তারা বাজারে জিনিষ কেনে, বাজারে জিনিষপত্রের চাহিদা বাড়ে, আবার নতুন নতুন ম্যানিউফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে থাকে, এটাই এক দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। উনি বলেছিলেন বছরে ২ কোটি একারের চাকরি হবে, কী হয়েছে? ২০১৬.১৭ থেকে ২০২০ -২১ সালের মধ্যে ২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের চাকরি চলে গেছে। করোনা আসার আগেই দেড় কোটি মানুষের চাকরি চলে গেছে মোদিজীর আত্মনির্ভর ভারতে। ২০১৬ থেকে ২০২১ এর মধ্যে ঐ ম্যানিউফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মসংস্থান কমেছে ৫০%, মানে কর্মীদের অর্ধেকের চাকরি গেছে। ২০১১ -১২ তে কর্মীর সংখ্যা ১২.৬% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৬%। মোদিজী সেই কারণেই আর আত্ম নির্ভর ভারত, মেক ইন ইন্ডিয়ার কথা বলে ভোট চাইছেন না, উনি রামমন্দিরের নামে ভোট চাইবেন, হিন্দুত্বের কথা বলে ভোট চাইবেন, এই সবে আনা মহিলা আসন সংরক্ষণ বিল এর কথা বলে ভোট চাইবেন, কিন্তু একবারও বলবেন না যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেবো। কেন বলবেন না? কারণ তা তিনি গত সাত বছর আগেই বলেছেন, এবং দ্বিগুণ হওয়া তো দুরের কথা কৃষকের প্রকৃত আয় কমেছে। তিনি তখন ঐ মেক ইন ইন্ডিয়া, আত্ম নির্ভর ভারত ইত্যাদি বাওয়াল দেবার সময়ে বলেছিলেন কেবল মাত্র ম্যানিউফ্যাকচারিং শিল্পে ১০ কোটি বেকারের চাকরি হবে। সে চাকরি হয়নি, যাদের চাকরি ছিল, তাদের চাকরিও গেছে, অতএব তিনি ওসব নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছুদিন হল অ্যাপেল ফোনের কথা প্রায় মাইক লাগিয়ে বলা হচ্ছে। প্রথমত অ্যাপেল আমাদের দেশে যা করেছে যা অন্য দেশেও করে, সেটা একটা অ্যাসেম্বলিং ইউনিট, একটা চিপ ও আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে না, সেগুলোর সাপ্লায়ারেরা আলাদা। অন্যদিকে সারা পৃথিবীর মাত্র ৭% ফোন উৎপাদন হচ্ছে ভারতে, ভারতবর্ষের কতজন অ্যাপেল ফোন কেনেন? যার সর্বনিম্ন মূল্য ৭৩ হাজার টাকা? খুব কম, তাই সেই অ্যাপেল ফোন বিক্রি হচ্ছে বিদেশে, অ্যাপেল কোম্পানি কম পয়সায় শ্রমিক পেয়ে লাভ বাড়িয়ে নিচ্ছে বহুগুণ, এটাই মোদিজীর মেক ইন ইন্ডিয়া। ইন্ডেক্স অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাক্ট, মানে কত পণ্য তৈরি হল তার সূচক, আই আই পি, ২০১৩ -১৪ সালে এই সূচক ছিল ১০৫.৭, ২০২২ -২৩ এ এই সূচক আছে ১৩৮.৫ এ, মানে বৃদ্ধির হার কত? ২.৯%।
যেখানে কেবল মাত্র ম্যানিউফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথ রেট ধরা হয়েছিল ১২ -১৪%, সেখানে দেশের শিল্প কোন হারে বেড়েছে? ২.৯%, দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই কারণেই আত্মনির্ভর ভারত নিয়ে আর একটা কথাও বলেন না। ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ শিল্পে বৃদ্ধি নেগেটিভ, মাইনাস ১.৮%, কমপিউটার অপটিক্যাল পণ্যের উৎপাদন এর হার ২%, পরিবহণ শিল্পে যন্ত্রাংশ বৃদ্ধির হার ২.৩%, মোটোর গাড়ি শিল্পে বৃদ্ধি হয়েছে ১.৬ %, বস্ত্র শিল্পে নেগেটিভ, মাইনাস ০.৫%, গয়না শিল্পে ১.২%, চামড়া শিল্পে মাইনাস ১.৮%, স্বাভাবিক চাকরি গেছে বহু মানুষের, ঠিক এই মূহুর্তে গ্রাজুয়েট এমন চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে ৪৩% এর চাকরি নেই, মাস্টার্স, পি এইচ ডি করা ছাত্ররা রেল দপ্তরে পিওন হবার জন্য ভিড় করছেন, প্রধানমন্ত্রী রাস্তার ধারের নালি থেকে গ্যাস তৈরি করে স্টোভ জ্বালিয়ে চা দেবার মত অবৈজ্ঞানিক মিথ্যে কথা বলেই চলেছেন। ইউপিএ প্রথম আর দ্বিতীয় সরকারের সময় এই মোদিজী বলতেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তো বোবা, কথাই বলেন না। সেই সময়ে এমন নয় যে দেশ হুহু করে এগিয়ে চলছিল, বেকারেরা চাকরি পাচ্ছিল, দারিদ্র হু হু করে কমছিল, না এমন তো নয়, কিন্তু তবুও যদি মোদিজীর এই আমল আর মনমোহনের ১০ বছরের তুলনা করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে ঐ স্বল্পবাক মানুষটির সময় অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল, ঐ সময়ে ১ লক্ষ নতুন কলকারখানা তৈরি হয়েছিল, গত ৯ বছরে তার পরিমাণ ৫০ হাজার ছাড়ায় নি। মনমোহনের আমলে নিয়োগ বৃদ্ধি, আনে চাকরি বেড়েছিল ৬.২% হারে, মোদিজীর সময় বেড়েছে ২.৮% এর কিছু কম। ইউ পি এর সময়ে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছিল ১৭.১%, ওদিজীর সময়ে বেড়েছে ৮.৪%। ইউ পি এ র সময়ে শিল্পে মুনাফা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ১৮.৯% হারে, মোদিজীর সময়ে সেই হার ০.৬%। শিল্পপতিরা মুনাফার এক অংশ আবার বিনিয়োগ করেন, এটাকে মুলধন গঠন বলা হয়, মানে নতুন পুঁজির সৃষ্টি। ইউ পি এ র সময়ে সেটা ছিল ২১.৩%, এখন নেগেটিভ, মাইনাস ০.৭%। কাজেই হোর্ডিং এ মোদিজীও নেই, তাঁর সিংহও নেই, মোদিজী এখন নতুন ললিপপ নিয়ে বাজারে নামছেন, তিনি এখন তাঁর প্রবল হিন্দুত্বে ফিরে যেতে চান, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করে হিন্দু মুসলমান, হিন্দু খ্রিস্টান মেরুকরণ চান। তিনি ভুলেই গেছেন ১০ বছর আগে ক্ষ্মতায় এসে বলেছিলেন, আম আদমি কে মোদি হাওয়াই জাহাজে চড়াবে, হয়েছে কী? যাঁরা চড়তেন, তাঁদেরও অনেকে চড়তে পারছেন না, হাওয়াই যাতায়াতের মুল্য এতটাই বেড়েছে। একমাত্র মিলেছে তাঁর একটা বেদ বাক্যের শেষ অংশ, না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। খাচ্ছেন সেটা তো পরিস্কার, আদানি কে নিয়ে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে উনি রাজি নন, জবাব ওনার কাছে নেই, বিজেপির তহবিলে কর্পোরেট ডোনেশন ৮৫% এর বেশি, তিনি কদিন আগেই ভূপালে বলেছেন, আমার তো ঘর নেই, কিন্তু দেশের মানুষের নতুন ঘর হচ্ছে, ২০১৯ এ নির্বাচনের সময়ে উনিই জানিয়েছিলেন ওনার যে পৈত্রিক বাড়ি আছে তার মূল্য সেই সময়েই কোটি টাকার বেশি, আজ তার ভ্যালু কত ভাবুন, তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি মিথ্যে বলতে বলতে ক্লান্ত হন না। ১০০টা কথা বললে ৫০ টা নির্জলা মিথ্যেই বলেন। সেই তিনি একটা সত্যি কথা বলেছিলেন, না খানে দুঙ্গা, কাউকে খেতেও দেবো না।
কথা রেখেছেন, খাদ্য পণ্যের দাম রেকর্ড বাড়াতে পেরেছেন, যে খাবার কিনতে গতবছরে খরচ হতো ১০০ টাকা, সেটাই এখন ১৬৬ টাকা। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমিষ খাবারের দাম, মোদিজী আমিষ খান না, বিদেশের বেশিরভাগ ১০০% আমিষভোজীদের ডেকে বাজরার পায়েস খাইয়েছেন, সে খাওয়ান, কিন্তু দেশে আমিশ খাবারের দাম রেকর্ড হারে বাড়ছে। গরীব দেশে এনিম্যাল প্রোটিন হল সবচেয়ে সস্তার প্রোটিন সোর্শ, মোদিজী সেটা বন্ধ করে দেবার তালে আছেন, উনি বা ওনার বন্ধুরা হাজার টাকার প্রোটিন সমৃদ্ধ মাশ্রুম খেতে পারেন, কিন্তু দেশের মানুষের কজন ৮০০ টাকা কেজি খাসির মাংস, ২৬০ টাকা কেজি মুরগির মাংস, ৩০০ টাকা কেজি মাছ খেতে পারবেন? কিন্তু না এসব বিষয় তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় নেই। মেক ইন ইন্ডিয়া থেকে আত্মনীর্ভর ভারত ইত্যাদি বাওয়াল নিয়ে তিনি একটা শব্দও খরচ করছেন না। কিন্তু না স্যর, আমাদের দিব্য মনে আছে, আপনার প্রতিটা মিথ্যে ভাষণের তথ্য আমরা রেখেছি, আর কদিন পরেই তো মাঠে নামতে হবে? প্রতিটা মিথ্যে প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি আমরা তুলে ধরবো, আমরা ভুলে যাই নি, ভুলে যাবো না।