২০২৪, ৫ ফেব্রুয়ারি, সংসদে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার জবাবে ধন্যবাদ ভাষণ দিতে উঠেছিলেন নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি। পুরনো লোকসভায় সেটাই ছিল মোদিজির শেষ ভাষণ। ঘণ্টাখানেকের বেশি দীর্ঘ ওই বক্তৃতাতে ঝরে ঝরে পড়ছিল ব্যঙ্গবিদ্রুপ। তিনি যেমনটা বলেন আর কী, যুক্তি নয়, তথ্য নয়, শব্দ নিয়ে খেলেন নরেন্দ্র মোদি। ওনার যে কোনও বক্তৃতা আবার দেখুন, দেখবেন উনি কেবল শব্দের পর শব্দ সাজিয়েই যাচ্ছেন। অশিক্ষিত মানুষজন প্রতিপক্ষকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে থাকে, আসলে তা তাদের দুর্বলতার লক্ষণ। এটা আমার কথা নয়, মহাভারতে কৃষ্ণ এই কথা বলেছিলেন দুর্যোধনের ভাষণের পরে। সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে মোদিজি বলেছিলেন, বিরোধীরা তাঁদের ভূমিকা পালন করেনি, তাই বিরোধীরা কমতে কমতে শেষ পর্যন্ত ওই দর্শকের আসনে গিয়ে বসবে। রাহুল গান্ধীকে তিনি বলেছিলেন নন স্টার্টার, বলেছিলেন কেবল রাম ঘরে ফেরেননি, রামমন্দির গোটা দেশকে প্রেরণা জোগাবে। বলেছিলেন গোটা দেশ কংগ্রেসকে ইতিহাসের পাতাতেই রেখে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। সেদিন বলেছিলেন মোদি কি গ্যারান্টির কথা আর তারপরেই সেই বিজেপির ৩৭০ আর অব কি বার ৪০০ পারের স্লোগান। তিনি বলছেন অবকি বার, ওনার দলের সমর্থকরা বলছেন ৪০০ পার। সেই সংসদেই নতুন লোকসভার অধিবেশন শুরু হবে আগামী ২৪ জুন। নন স্টার্টারদের ১০২, বিরোধী ২৪০-এর বেশি, আমি গোটা ৬-৭ নির্দলকেও ধরছি, বিজেপি একা ২৪০, জমে ক্ষীর। যতটা মন দিয়ে এগজিট পোল শুনেছিলেন, ততটা মন দিয়ে এবারের সংসদের বর্ষা অধিবেশনের দিনগুলির দিকে নজর রাখুন, প্রতিটা দিন হবে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।
প্রথম পাঁচ বছরে ওই রাফাল ইত্যাদি ইস্যু এসেছিল, ঘোটালাটা মানুষের মগজে ঢোকেনি, তারপরের পাঁচ বছরে পিএম কেয়ার, আদানি কেলেঙ্কারি ইত্যাদি উঠেছিল বটে কিন্তু আবারও আমজনতার অ্যান্টেনার উপর দিয়েই চলে গেছে আর এক ব্রুট মেজরিটি দিয়েই সংসদে সে সব ইস্যুকে উঠতেই দেওয়া হয়নি। কিন্তু এবারে? আমার ধারণা মোদিজি ইদানিং রোজ ঘুমোতে যান আর ঘুম ভেঙে যায় সংসদের প্রথম দিনটার কথা ভেবে। সংসদ শুরুই হবে দুটো বিরাট দুর্নীতির হিসেব নিকেশ নিয়ে, যা এতদিনে সাধারণ মানুষজনের মাথায় ঢুকেছে, যা দেশের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীরা জেনে ফেলেছেন। প্রথমটা হচ্ছে ৩০ লক্ষ কোটি টাকার এগজিট পোল দুর্নীতি, অন্যটা মেডিক্যাল ছাত্রদের এন্ট্রান্স পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতি। এবারে মানুষের সামনে অলরেডি চৌকিদার যে চোর হ্যায় তার ধারণা স্পষ্ট। মন্ত্রীরা সচিবদের ডাকছেন, কী করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের চুল খাড়া। ওদিকে বিপদ বুঝে দস্যু রত্নাকরের পরিবার, আরএসএস নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছেন, ডাকাতি করে এনেছ, মুর্গ মুসল্লম রেঁধেছ, খেয়েছি, কিন্তু তাই বলে ডাকাতির দায় নিতে যাব কেন? ওনারা রোজ বিবৃতি দিচ্ছেন, জানাচ্ছেন, কী খারাপ লোক এই নরেন্দ্র মোদি, কী খারাপ ছিল তাদের সরকার। নাথুরাম বিনায়ক গডসে আর নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তে গান্ধী-হত্যার পরে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে এই আরএসএস তাদের চিনত, সেটাও স্বীকার করেনি, সাফ জানিয়ে দিয়েছে ওরা আমাদের কেউ নয়। এখনও এমন একটা ভাব যে বিজেপি কী করছে সেটা তাদের ব্যাপার, আমাদের নয়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি সরকার কোন কোন ইস্যুতে ভেঙে যাবে? যেতে পারে?
অনেকের জানা নেই, এই সুযোগে জানিয়ে রাখি, বিজেপির সংগঠনে সাধারণ সম্পাদক সংগঠন নামের একটা পদ আছে, এই পদে যাঁরাই বসেন তাঁরা আসলে আসেন আরএসএস থেকে, আরএসএস সংগঠন এই মানুষটার কাছ থেকেই বিজেপির সব খবরাখবর পেয়ে থাকেন। আপাতত এই পদে আছেন বি এল সন্তোষ, এর আগে ছিলেন রাম লাল, সঞ্জয় জোশি, গোবিন্দাচার্য, এমনকী নরেন্দ্র মোদী, যখন জনসংঘ ছিল তখন ছিলেন সুরিন্দর সিং ভান্ডারি, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতো নেতারা। আসলে এনাদের কাজই হল ওই আরএসএস-এর কর্মসূচির রূপায়ণ আর দুটো সংগঠনের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা। আপাতত বি এল সন্তোষ সেই দায়িত্বে আছেন এবং জনগণ বলে যে এনার সঙ্গে খুব খারাপ সম্পর্কের জন্যই ইনি যতদিন থাকবেন দিলু ঘোষ ততদিন সভাপতির পদ পাবে না এবং সেই জনগণই বলেন এই রাজ্যে ওনার সবথেকে ঘনিষ্ঠ হলেন অগ্নিমিত্রা পল, আমি সাংগঠনিক ঘনিষ্ঠতার কথা বলছি। তো সেই আরএসএস বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মোদিজির কাজ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন, কিন্তু তখন মোদিজি জিতছিলেন, জো জিতা ওহি সিকন্দর অতএব তখন এই প্রশ্ন ওঠেনি, সব্বাই দস্যু রত্নাকরের আনা ভাত খেয়েছেন পেট ভরে। এখন হাওয়া ঘুরেছে, কেউ আর দায় নিচ্ছেন না। তো থাক এই কথা, চলুন আবার সেই ২৪ জুনের কথায় যাই যেদিন আমাদের উনিশতম লোকসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হবে। এবারে বিরোধীদের কাছে দু’ দুটো বোমা আছে, দু’ দুটো বিরাট স্ক্যামের বহু তথ্য আছে যা সামলানো কঠিন হবে সরকারের, আর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল বিরোধীদের সংখ্যা কাজেই অব আয়েগা মজা। কোন দুটো স্ক্যাম নিয়ে কথা উঠবে? দুটোই একই দিনে ঘটেছে, হ্যাঁ, ৪ জুন এই দুই স্ক্যাম আমাদের সামনে এসেছে। আজ আলোচনার বিষয় হল প্রথমটা। এগজিট পোল স্ক্যাম। এগজিট পোলের ফলে কারা কারা লাভবান হলেন? মানে মাল কাদের পকেটে গেল? কে কামিয়ে নিলেন হাজার হাজার কোটি টাকা? আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক।
এগজিট পোল এসেছে পয়লা জুন, তার আগেই আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মানে চৌকিদার এবং তড়িপার অ্যাসিসট্যান্ট, মোদি–শাহ দুজনেই বলেছিলেন শেয়ার বাজার উঠবে, শেয়ার কিনুন। এরপর ১ তারিখে এগজিট পোল এল, প্রতিটা এগজিট পোল জানিয়ে দিল বিজেপি, এনডিএ জোট ৩৭০ থেকে ৪১১ পর্যন্ত পেতে পারে, কংগ্রেস ৫২-৫৪ র বেশি পাবে না, ইন্ডিয়া জোট মেরে কেটে ১৫০ আর বাকিটা অন্যান্যরা। কিন্তু খেয়াল করলেই জানা যেত, যেই এই ১ তারিখে এগজিট পোল আসার আগেই ৩১ মে ২.৩ লক্ষ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হল? সাধারণভাবে বাজার ঠিকঠাক চললে ১.১ লক্ষ টাকার শেয়ার বিক্রি হয়। তো এই ৩১ মে কী এমন ছিল যে সেদিন এই রেকর্ড পরিমাণ শেয়ার বিক্রি হল? এর আগে এমনটা কবে হয়েছে? ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেন সেই সময়ে সেই দিনে এইরকম রেকর্ড বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু ৩১ মে কী ছিল? কিচ্ছু না, হ্যাঁ তারপরের দিন এগজিট পোল আসার কথা ছিল। এগজিট পোল এল, ওই একদিনেই বাজার বাড়ল, সেনসেক্স উঠল ৩১ মে, বাজার বন্ধ হল ৭৩৯৬১, ৩ জুন ৭৬৪৪২, আর রেজাল্ট বের হওয়ার পরে তা নামল ৭২২৮৭ তে। যখন বাজার উঠল তখন ওই ৩১ মে যারা শেয়ার কিনলেন তাঁরা শেয়ার বেচতে শুরু করলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ তখন বাজার উঠছে দেখে শেয়ার কিনে যাচ্ছেন, ৪ তারিখে বাজার হু হু করে পড়ল, তখন সেই লোকজন মানে মরিশাস থেকে বা কেমেন আইল্যান্ড থেকে বেনামে শেয়ার কেনা শুরু হল, আবার বাজার উঠেছে, আবার তাদের লাভ। তথ্য বলছে কেবল এই বাজারের ওঠা নামায় চন্দ্রবাবু নাইডু পরিবারের মাত্র ১২০০ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। গণতন্ত্র নাচছে কার উঠোনে? এবং এরই মধ্যে ৩০ তারিখ ৩১ তারিখেই এনরিচ বলে এক সংস্থার এক এগজিট পোল রিপোর্ট বিশ্বস্ত বিজেপি ঘনিষ্ঠ ইউটিউবারদের হাতে, তাঁরা তাঁদের চ্যানেলে এই এনরিচ সংস্থার এগজিট পোল দেখিয়েছেন। কারা এই এনরিচ? এরা আসলে বাজারে শেয়ারের কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। আমাদের রাজ্যেও কিছু ইউটিউবারদের কাছে এই এনরিচের হিসেব পৌঁছেছিল। রাজ্য সরকারের দেখা উচিত এর পিছনে কাদের কোন কোন স্বার্থ কী ভাবে কাজ করেছিল, কিন্তু আসল দায় তো দিল্লির সরকারের। কাজেই ইতিমধ্যেই বিরোধী দলগুলো জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি দিয়ে এই এগজিট পোল স্ক্যামের তদন্ত দাবি করেছে, মোদিজি সংসদে ঢুকলেই এই কেলেঙ্কারির তদন্তের দাবির মুখে পড়বেন, সরকার কোনও কাজ করার আগেই ৩০ লক্ষ কোটি টাকার ঘোটালার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সামনে দাঁড়িয়ে আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং, সংসদে থাকবেন মহুয়া মৈত্র, থাকবেন রাহুল গান্ধী, আমার ভয় হচ্ছে দোস্তি বনি রহে বলে এক গ্লাস জল খেয়ে মোদিজি না বাইরে চলে যান, ওনার তো সেই রেকর্ডও আছে। আগামিকাল ওই নিট নিয়ে নতুন কিছু তথ্য হাজির করব আপনাদের সামনে, আপাতত এইখানেই শেষ করছি।