আমেদাবাদ থেকে গৌতম ভট্টাচার্যের সুইচ হিট
হিন্দু বিশুদ্ধবাদীরা ঈশ্বরের মূর্তিতে অষ্টধাতুর সমাহারে অনন্ত বিশ্বাসী। যতদূর মনে করতে পারছি –সোনা,রুপো ,তামা,লোহা, দস্তা , সীসা ,টিন ,পারদ ।
ভারতের (India) বিশ্বকাপে (Cricket World Cup 2023) পাকিস্তানকে (Pakistan) হারানোর ঐতিহ্যকে টানা ৮-০ নিয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে কী অসামান্য রেকর্ড হয়ে থাকছে। টানা একত্রিশ বছর ধরে বিশ্বকাপের মর্যাদার চূড়ান্ত লড়াইয়ে তারা অপরাজেয়। এক একটা জয় আর সেগুলো মিলে যেন ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বরের নতুন মূর্তিকে গড়ল। এর মধ্যে শচীন ও কুড়ি বছর আগের সেঞ্চুরিয়ন যদি সোনা হয়। শনিবারের আমেদাবাদকে রুপো বলতে অসুবিধে কী ! সেঞ্চুরিয়নে তবু অনেক ঘাম-রক্ত ঝরেছিল। এটা এমন একপেশে জয় যে সদ্য পেসমেকার বসানো মানুষকেও তার পরিজন টিভির সামনে থেকে সরিয়ে দেবে না। জাস্ট সেকেন্ড রাউন্ডে নকআউট করে দেওয়ার মতো। রুপো –ঠিকই আছে।
কলকাতার বিশিষ্ট সব থিম পুজোর ঢঙে একটা কমন থিম খোঁজা যাক এক লাখ তিরিশ হাজার দর্শকের সামনে মহাযুদ্ধ জয়ের । একাধিপত্যের বিশ্লেষণে উঠে আসছে পাঁচ কারণ।
১, শর্মাজির বিক্রম
শুধু পাক বোলারদের নয়। ভারতীয় সেনাধ্যক্ষকে তিনি রোহিত শর্মা গভীর সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন। কেন , জানানোর আগে মনে করিয়ে দিই, বাঙালি জীবনে শনিবার মহালয়ার যেমন পুণ্য আগমন ঘটেছে। তেমনি রোববার গুজরাতি সহ ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের শুরু হচ্ছে নবরাত্রি। সেই উৎসব যেন মাঠে আগাম শুরু করে দিলেন রোহিত। নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম তাঁর এক একটা ছক্কায় যেভাবে মোবাইল টর্চের আলো আর জাতীয় পতাকা নাড়ানো চলছিল এর চেয়ে জমকালো উৎসব চাঁদে হয়তো ঘটতে পারে । এই গ্রহে নয়। এর চেয়ে উদ্ভাসিত নবরাত্রি আর কী পালন করবে ? অষ্টধাতুর যে সমাহারে ভারতীয় ক্রিকেট মূর্তি তৈরি হবে তার প্রতিটা প্রেস বক্সে বসে দেখা। কোথাও কোনো জয়ী ভারত অধিনায়ককে বিশ্বকাপের পাকিস্তান ম্যাচে নিজে সংহারকের ভূমিকায় নামতে দেখিনি। আজহার না। গাঙ্গুলি না। ধোনি না। কোহলি না। রোহিত প্রথম। ধারেকাছে কোনো নাম নেই। প্রথম ইনিংসে বল পড়ে যেমন নিচু হচ্ছিল তাতে ১৯২ তাড়া করাটাও চাপ হবে কিনা বিস্তর গবেষণা চলছিল। রোহিত প্রথম থেকে এমন ব্যাট করতে শুরু করলেন যেন কলেজের রিইউনিয়ন ম্যাচ খেলতে এসেছেন। চার বছর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওল্ড ট্রাফোর্ডে তাঁর সেঞ্চুরি মাঠে বসে দেখা। কিন্তু সেটা ভিডিও গেমস খেলার পর মতো এমন সহজ করে ছিল না। ওয়ানডে তে এদিন তাঁর ৩০০ ছক্কা পূর্ণ হল যাকে অলৌকিক বলা যেতে পারে । নাকি মহাজাগতিক? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে দেখা গেল ভি ভিআইপি বক্সে এমনই একটা ছক্কা দেখে হাসিতে উজ্জ্বল। ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ প্রতিবার বিশ্বকাপে পাক ম্যাচ জেতার পর ক্যাপ্টেন আর ম্যাচের সেরা ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে ফোনে অভিনন্দন জানান। প্রশ্ন ,এবার কাকে কনগ্রাচুলেট করবেন ? বরাবরের মতো ক্যাপ্টেন ? না ৬৩ বলে ৮৬ রানের ইনিংসে মহাযুদ্ধকে সড়কের লড়াই এবং ছেলেখেলায় নামিয়ে আনা ৪৫ জার্সিধারী ওপেনারকে ? আর হ্যাঁ ভারতীয় মাঠে আধুনিক সময়ে হয় বিরাট বা ধোনির নামে চিৎকার ওঠে। এদিন আমেদাবাদ গ্যালারি লুডুর গুটির মতো তাঁর ক্রমান্বয়ে চার-ছয় মারা দেখতে দেখতে বারবার আওয়াজ তুলল র-ও-হ-ই-ট। রো -হি -ত।
২) চোকিং
অবিশ্বাস্যভাবে দু ‘ উইকেটে ১৫৫ থেকে পাকিস্তান ধসে গেল। ভারত-পাক ওয়ানডে ম্যাচে বাবরের দেশ শেষ ৮ উইকেট ৩৬ রানে হারিয়েছে এমন ঘটনা শারজার ১৯৮৫-র পর প্রথম ঘটল। আর সেই ম্যাচের মতো ঢুকে গেল অমর সিরিজে। পাকিস্তানী সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ হাসমি জানালেন ,ভারত যখন টস জিতে বাবরদের ব্যাট করতে পাঠায় ,ওয়াসিম আক্রম লাহোরের টিভি চ্যানেলে বলতে থাকেন ,কোনোরকমে ২৮০ কর। তাহলেই চলবে। কিন্তু ভয় পেয়ে খেল না। ঠিক তাই ঘটল। পাকিস্তান যেন এক লাখ তিরিশ হাজার দর্শকের সামনে কুঁকড়ে গেল। রিজওয়ানকে বলা হচ্ছে আধুনিক সময়ের জাভেদ মিয়াঁদাদ। কিন্তু তাঁর সেই বুকের পাটা কোথায় যে একা টেনে নিয়ে যাবেন ? বাবর দ্রুতগতির ফরওয়ার্ড খেলার বল ব্যাকফুটে গিয়ে বোল্ড হলেন। তাঁর সাম্রাজ্যও যেন ধসে পড়ল। পরিষ্কার চোকিং। যেভাবে এরপর তারা বল করল। তার মধ্যেও ঘাবড়ে এলোমেলো হওয়া। পুরোনো পাকিস্তান দেখলে বলত. আমাদের কি ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থা হতে যাচ্ছে ? টিম ডিরেক্টর মিকি আর্থার মানলেন যে তাঁর ব্যাটসম্যানেরা ভীতু ভীতু ক্রিকেট খেলেছে। তারপরে হঠাৎ অভিযোগ করলেন ,” আইসিসির টুর্নামেন্ট যে খেলছি ,মাঠের পরিবেশ দেখে বুঝিনি। বুঝিনি এটা যে বিশ্বকাপ। দ্বিদেশীয় সিরিজ নয়। আমাদের টিম সং-গুলোও তো মাইক্রোফোনে বাজতে শুনলাম না। ” সাংবাদিক সম্মেলন থেকে ওঠার আগে আর্থার বলে গেলেন ,”চরম আতঙ্কিত হয়ে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের কিছু হয়নি। ফাইনালে আবার ভারতের সঙ্গে দেখা হবে। হেরেছি তো তিনটে খেলার একটায়।” যতই বলুন। স্নায়ুচাপে ধস্ত হয়ে ১১৭ বল বাকি থাকতে সাত উইকেটে এমন একপেশে হার স্মরণকালের ভারত-পাক ম্যাচে ঘটেনি। বাকি টুর্নামেন্টে এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা তাদের সমস্য়া হবে।
আরও পড়ুন: রোহিতের তাণ্ডব, পাকিস্তানকে দুরমুশ করে জিতল ভারত
৩) বুমরা রূপেণ সংস্থিতা
জসপ্রীত বুমরাকে খেলার টেকনিক কী ? ” খুব সহজ। ” বলেছেন আরন ফিঞ্চ। ” অবসর নিয়ে নাও। আমি যা করেছি। ” মজা করে বললেও এর মানে বোঝায় , বুমরাকে নিজের দিনে খেলা প্রায় অসম্ভব। এদিন সুইং বা গতি নয়। কাটারে উইকেট তুললেন বুমরা। সাত ওভারে তাঁর দু উইকেটে মাত্র ১৯ রান দেওয়ার মধ্যে শার্দুল ঠাকুরকে আড়াল করাটাও রয়েছে। যাঁকে কেন অশ্বিনের জায়গায় নেওয়া হয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্টই একমাত্র বুঝেছে। কুলদীপ-জাদেজা-সিরাজ সবাই মিডল ওভার থেকে ভালো বল করেছেন। কিন্তু আগাগোড়া চাপ রাখলেন বুমরা। বোলার এবং প্রকৃতিগতভাবে চুপচাপ বলে প্রচার নিজের দিকে কখনও টেনে নেন না। কিন্তু কালকেই লিখেছি যাতে ফর্মাটেই তাঁর স্ট্যাটস অবিশ্বাস্য। আশ্চর্য এই প্রথম ভারতে কোনো ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরস্কার জিতলেন। আর ভারত -পাক বিশ্বকাপ ম্যাচে কোনও বোলারের সেরা নির্বাচিত হওয়া চব্বিশ বছর বাদে ঘটল। ১৯৯৯-তে ভেঙ্কটেশ প্রসাদের পর তিনি। আন্দাজ করছি স্থানীয় নির্মাণ হাই স্কুলের মেরিট বোর্ডে অন্তত আজকের ম্যাচের পেপার কাটিংটা সাঁটানো হবে আগামী ক’দিনের মধ্যে।
৪) কুলদীপের দীপাবলি
বুমরা যেমন টুর্নামেন্টের সেরা বোলার হিসেবে আপাতত বিচরণ করছেন। সেরা স্পিনার এখন অবধি কুলদীপ যাদব । গত এক বছরে বাড়তি গতি তিনি বোলিংয়ে যোগ করেছেন যার জন্য ফিটনেসের মাত্রা বাড়াতে হয়েছে। সেই এশিয়া কাপ থেকেই ব্যাটসম্যান তাঁর রহস্যভেদ করতে ব্যুর্থ হচ্ছে। এদিনও ম্যাজিক অব্যাহত ছিল। তাঁর নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে চার বছর আগে এই বিশ্বকাপ থেকেই দুর্ভোগের শুরু হয়েছিল। আবার সেই বিশ্বকাপই নাগাড়ে প্রচার দিচ্ছে। জীবন কী বিচিত্র ! দিল্লির দুই সিনিয়র সাংবাদিক নাকি ক্যাপ্টেন ও কোচের কাছে তাঁর মন্তব্য বলে কিছু কথা লাগিয়েছিলেন। সেই দুর্ভোগের শুরু। কেকেআরও তাঁর পাশে সর্বতোভাবে ছিল এমন প্রমাণ কোথায় ? বরঞ্চ নিয়মিত বাদ যেতেন কুলদীপ। রোহিত শর্মা অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে তিনি প্রথম সহানুভূতির বাড়িয়ে দেওয়া হাত দেখতে পান। সেই মনোভাবের উপযুক্ত মর্যাদা কুলদীপ দিচ্ছেন।
৫) দ্রাবিড়িয়ানা
রাহুল দ্রাবিড় এদিনও এলেন না। কিন্তু ক্রমশ টিমের পরিচালনায় তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ পরিষ্কার হচ্ছে। শনিবার মাঠে উপস্থিত থাকা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন তাঁকে কোচ পদে নিযুক্ত করেন ,শুরুর দিকে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ দুটোই ভারত হেরে শেষ করে। এর পর সমালোচনা তীব্রতর হয় তাঁর ও রোহিতের বিরুদ্ধে। ম্যাচ প্রাকটিস ছাড়া বেশ কিছু প্লেয়ারকে টিমে ঢোকানো নিয়েও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন দ্রাবিড়। যেমন শ্রেয়স,রাহুল এবং কিছু অংশে বুমরা। আপাতত তিন ম্যাচের তিনটি জিতে ভারত গ্রূপের শীর্ষে। ধরে নেওয়া হচ্ছে দেশের মাঠে সেমিফাইনাল খেলার ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। এখন অবধি ড্রেসিংরুম শান্ত রাখতে পড়েছেন দ্রাবিড় ও রোহিত। ঘরের মাঠে খেলা হলেও আগের বারের মতো মনোবিদ নিযুক্ত করতে হয়নি। এখন দেখার টুর্নামেন্টের মিডল ওভারে দ্রাবিড়ের পরিচালনায় ভারত কেমন খেলে ? সন্দীপ পাতিল বলছিলেন পিক করতে হয় টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি থেকে। বেশি আগে করলে সেটা ধরে রাখা যায় না। দ্রাবিড় অবশ্যই সেটা জানেন। তাঁর টিমের তিনটে কঠিন ম্যাচ এখনো বাকি –নিউজিল্যান্ড ,ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে বুনোট দেখে মনে হচ্ছে ভারত ঠিক সময়ই পিক করছে। প্রশ্ন যদিও থাকছে দ্রাবিড়-রোহিতের প্রিয় বোলার কবে থেকে পিক করবেন ? তিনি শার্দুল ঠাকুর !
আরও অন্য খবর দেখুন