Tuesday, July 1, 2025
Homeআপনার কথাচতুর্থ স্তম্ভ

চতুর্থ স্তম্ভ

Follow Us :

কেউ বলতো বালা সাহেব, কেউ বলতো কৃষ্ণ সাহেব। আদতে মানুষটা ছিলেন একজন ক্যাথলিক যাজক, কে পি বালাকৃষ্ণণ, ফাদার বালাকৃষ্ণণ।  সেই কবে ১৮৬১ তে মহুয়াটাঁড়, ছোটনাগপুরের ধানবাদ জেলার এক আদিবাসি অঞ্চলে চার্চের ফাদার, তখনও মহুয়াটাঁড় এর চারদিক অরণ্যই বলা যায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোটা আটেক আদিবাসী গ্রাম, একটা হাট, কিন্তু সাহেব ওই ৮টা নয়, কাছাকাছি ৩০/৩৫ টা গ্রামে একটা টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, সাদা যাজকের পোষাক, কুচকুচে কালো রং, বাচ্চারা পেছনে পেছনে ছুটতো, প্রভুর কৃপায় দাড়ি গজায়, ভাল্লুকে খায় শাঁকালু, প্রভু আমার পরম দয়ালু। সাহেব লজেঞ্চুস দিতেন, তারপর হাটের এক কোণে বসতেন, যিশু এক মূর্তি থাকতো টেবিলের ওপরে, মাথার টুপি খুলে বড় কুঁজোয় রাখা জল আর গেলাস থাকতো, বহুকষ্ট দারিদ্র না সহ্য করতে পেরে আদিবাসী মানুষ সাহেবের কাছে আসতো, সাহেব তার রোজগারের ব্যবস্থা করতেন, ছেলেমেয়েকে চার্চের স্কুলে পড়ানোর বন্দোবস্ত করে দিতেন, কেবল সেই আদিবাসীর নাম হয়ে যেত মাইকেল মদন টুডু, কিম্বা স্যামুয়েল ধরণী মুর্মু, ব্যাস। বড় কুঁজো থেকে জল খেত সেই আদিবাসী পুরুষ, লোকে দেখতো ধরণী, বা খগেনের ব্যাটা বা কৈলাশ জল খেলো, তারপরদিন পরিবারের প্রত্যেকে গিয়ে আবার জল খাওয়া, এবার চার্চের মধ্যে, এবার পবিত্র জল, ব্যাপটাইজেশন, ধর্মান্তরণ। সেবাকে সেবা, ধর্মকে ধর্ম। কোনটা আগে কোনটা পরে আমি বিচার করার কে?

পুরুলিয়া, ১৯৭৪/৭৫/৭৬/৭৭/৭৮ সাল, গরমকালে খরা আর দুর্ভিক্ষ স্বাভাবিক ঘটনা, একে হতদরিদ্র, তার ওপরে খরা। গ্রামকে গ্রাম মানুষের পেটে খাবার নেই, ঘাসের বীজ ফুটিয়ে খায়, কখনও একটা সজারু জুটে গেলো, কখনও ছোলা সেদ্ধ। সেই পুরুলিয়ার বোঙাবাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন, প্রতিবার এই খরায় পঞ্জাব লরিতে ড্রাম ড্রাম খিচুড়ি নিয়ে মহারাজরা চলে যেতেন প্রত্যন্ত গ্রামে, গাড়িতে মিশনের কিছু ছাত্রও থাকতো, তারা এই দরিদ্র সেবার থেকে অনুপ্রেরণা পাবে, পাবার কথা। গ্রামে হাজির হবার আগেই ট্রাকের শব্দ পেত মানুষেরা, হাড্ডিসার মানুষগুলো একটা পাত্র নিয়ে ছুটে ছুটে আসতো, এক ডাবা খিচুড়ি, ভাবা যায়, হাতে চাঁদ। ট্রাক এসে থামতো, টেবিল নামানো হত, জুনিয়র মহারাজেরা, মানে সাদা কাপড় পড়া মহারাজেরা টেবিলের ওপরে সারদা মা, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ছবি সাজিয়ে দিতেন। তারপর গেরুয়া, সাদা মহারাজেরা এবং ছাত্ররা গাইতেন, খণ্ডন ভব বন্ধন জগ বন্দন বন্দি তোমায়।

নিরঞ্জন নর-রূপ-ধর নির্গুণ গুণময়॥

মোচন অঘদূষণ জগভূষণ চিদ্ঘনকায়।

জ্ঞানাঞ্জন-বিমল-নয়ন বীক্ষণে মোহ জায়॥

ভাস্বর ভাব-সাগর চির-উন্মদ প্রেম-পাথার।

ভক্তার্জন-যুগল চরণ তারণ-ভব-পার॥ গাইতেন। অভুক্ত লোভী মানুষগুলোর সবকটা ইন্দ্রিয় তখন লেপটে আছে ওই খিচুড়ির ড্রামের গায়ে, গান শেষ হবার পরেই খিচুড়ি পাবে তারা, পেত। মুখের সেই হাসি, তার কোনও তুলনা নেই, তিন কি চার দিন পর ভাত ডাল। স্রেফ খিচুড়ি। সেবাকে সেবা, ধর্মকে ধর্ম। কোনটা আগে কোনটা পরে আমি বিচার করার কে?

একে দরিদ্র তায় নমঃশুদ্র গাঁয়ের মানুষজনদের পেশা তাঁত, শাড়ি গামছা, সুতো কিনতে যেতে হয়, হাটবারে গাঁয়ের পাঁচ ছ জন মোড়ল ৩৪ কিলোমিটার দূরে বহরমপুরের সুতাপট্টি থেকে সুতো নিয়ে ফিরতো, সেদিন গাঁয়ে ঢোকার আগে ভারি পিপাসা লাগায় পুকুরের থেকে একঘটি জল নিয়েছিল নগেন, চাটুজ্জেদের পুকুরের জল ঘটি ডুবিয়ে খেয়েছে নমঃশুদ্র সুখেন দাসের ব্যাটা নগেন, সাত গ্রামের মোড়ল বসে ১০০ টাকা জরিমানা আর ৬০ দিন বেগার খাটার রায় দিল, বেগার খাটা তবু ঠিক আছে, ১০০ টাকা   আসবে কোত্থেকে? না এলে ঘর জ্বলবে, মানুষ মরবে। এলাকার নায়েব নাজিম, সরফরাজ খানের খাস নওকর আমিনুদ্দিন খবরটা পেল, পরদিন সরফরাজ সড়কি আর বরকন্দাজ নিয়ে হাজির, মুসলমান হলে এ অন্যায় আমি হতে দেব না, কিন্তু হিন্দু ধর্মের ব্যাপারে আমার হাত দেওয়া উচিত নয়। এবার তোমরা বুঝে দেখো। শ্রীকৃষ্ণপল্লির প্রত্যেকে হল মুসলমান, তাদের জরিমানা তো দূরস্থান, রীতিমত সমীহ করতে থাকল পাশাপাশি গ্রামের লোকজন, পল্লির নাম হল আমিনপুর। সেবাকে সেবা, ধর্ম কে ধরম। কোনটা আগে কোনটা পরে আমি বিচার করার কে?

সেবা ইতিহাসে এভাবেই এসেছে, মানুষ বিপদে পড়লেই পাশে দাঁড়িয়েছে গুড সামারিটানরা, কোথা থেকে উদয় হয়েছে আমিনুদ্দিন, ট্রাক ভর্তি খিচুড়ি, কিম্বা কুঁজো ভর্তি ঠান্ডা জল। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, কেন দাঁড়িয়েছে? ধর্ম প্রচার করতে? নাকি কেবলই সেবা করতে? এ নিয়ে চলতে থাকুক বিতর্ক। মানুষ কিন্তু সেবা পাচ্ছে, এবং যে কোনও ক্রাইসিসের সময় সেটাই সবচেয়ে বড় কথা, অভুক্ত মানুষ শেষমেষ খিচুড়ি পেল, সেটাই সে মনে রাখবে।

সেই কবে কলকাতায় বিউবোনিক প্লেগ, রাস্তায় কারা? তখন তো রেড ভলেন্টিয়ার নেই, নেমেছেন সিস্টার নিবেদিতা, বস্তিতে বস্তিতে যাচ্ছেন, তাঁর দলবল নিয়ে। সেন্ট পলস চার্চের ফাদাররা, পাড়ায় পাড়ায় যাচ্ছেন, এদিকে পায়রা ওড়ানো উত্তর কলকাতার বাবুরা টাকা ডোনেট করেছেন, দল তৈরি হয়েছে, ঝাড়ু আর ওষুধ নিয়ে ইয়ং বেঙ্গলের ছেলেরা মহল্লায় মহল্লায় ঘুরছে, এ সেবাকে আপনি মতবাদ দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করতেই পারেন, আবার জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ইশ্বর, এরকম ফিলান্থ্রপিকাল পরিসরেও রাখতে পারেন, কিন্তু শেষমেষ সেই ব্যক্তি মানুষটার কথা ভাবুন, যে ওষুধ পেল, যে ডাক্তার পেল, যে খিচুড়ি পেল, যে তার সন্তানের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা পেল, সেই ব্যক্তির দিক থেকে এর মূল্য অনেক, তাকে অন্য কিছু দিয়ে মাপা যাবে না, যায় না।

আজ এই মূহূর্তে এই সেবা প্রসঙ্গটা সামনে, আবার এক্কেবারে প্রথম পাতায়, ঠিক এই মূহূর্তে বাংলায় নাকি ৮০ হাজার রেড ভলেন্টিয়াররা কাজ করছে, সৃজিত মুখার্জির মত চিত্র পরিচালক থেকে ঋদ্ধি সেনের মত অভিনেতারা রাস্তায়, মানুষের সেবার জন্য। কংগ্রেসের অসংখ্য নেতা বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ করে, ওষুধ অক্সিজেন নিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, শিখ গুরুদ্বারা তো এখন নয় বিভিন্ন সময়ে তাঁরা লঙ্গর খুলেছেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে, দাঁড়িয়েছে দেব বা সোনু সুদের মত সেলিব্রেটিরা, অক্সিজেন দিচ্ছেন, সেফ হোম করছেন, খাবার দিচ্ছেন, বীরভূমের বাংলা মঞ্চের কথা বাদ দিই কী করে, মড়া পোড়ানো থেকে অস্কিজেন খাবার ওষুধ, তাঁরা হাজির তাঁদের সামর্থ নিয়ে, হাজির ভারত সেবাশ্রম, শুধু হাজির নয়, তাদের দীর্ঘ দিনের ধর্মীয় অনুশাসন ভেঙে, তাঁদের প্রাঙ্গনে মাছ মাংস রান্না হচ্ছে, কারণ রোগীদের প্রোটিন দরকার। বিভিন্ন ক্লাব দুর্গোৎসব কমিটি, বিভিন্ন সংগঠন তাদের মত করে অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইতে সামিল, এমন কি দিল্লিতে সবচেয়ে বড় কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছে আরএসএস, সকাল থেকে সন্ধ্যে সেখানেও ভলেন্টিয়াররা কাজ করে যাচ্ছেন, প্যাকেটে প্যাকেটে খাবার তোলা হচ্ছে, গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে, কোভিড আক্রান্তদের বাড়িতে বা লকডাউনে অনাহারে থাকা মানুষজনের কাছে, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, সেবাকে সেবা, ধর্মকে ধর্ম। কোনটা আগে কোনটা পরে আমি বিচার করার কে?

একমাত্র ‘এ’ নয়, একমাত্র ‘বি’ বা ‘সি’ নয়, সারা দেশ জুড়েই মানুষ সেবাব্রতে নেমেছেন, যে যার মত করে, যে যার সামর্থ্য নিয়ে। এ যেন এক সমুদ্র বন্ধন হচ্ছে, বিশাল আকারের গজরাজেরা পাহাড় প্রমাণ পাথর নামিয়ে আনছেন, ওদিকে কাঠবেড়ালি তার নুড়িপাথর নিয়ে নেমে আসছে, তাদের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতন।

কেবল সরকার গর হাজির, সরকার নেই। দেশজুড়ে এক প্রবল শক্তিশালী সরকারের রাস্তায় উপস্থিতি জরুরি ছিল, একজন রাম, যার পাশে দাঁড়াতো হনুমান থেকে জাম্বুবান, কপিরাজ থেকে কাঠবেড়ালি।  সরকার অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতেই পারতো, এই মহামারীর মুখোমুখি, ভ্যাক্সিন নিয়ে, অক্সিজেন নিয়ে, ওষুধ নিয়ে, কিছু কম থাকতো তো থাকতো, অন্তত মানুষ দেখতো দেশের নেতা রাস্তায়, মানুষের মাঝে, দেশের নেতার হাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভ্যাক্সিনের ভয়াল, ওষুধ। মরতো মানুষ মরতো, আগেও মহামারিতে মরেছে, এবারেও মরতো, কিন্তু এটা জেনে যে তার মৃত্যুকে রোখার জন্য রাষ্ট্র লড়ে গেছে শেষ পর্যন্ত, সেই সরকার যা তার নির্বাচিত, সে তার সর্বস্ব নিয়ে রাস্তাতেই ছিল। তা হয়নি। রাষ্ট্র, রাষ্ট্র প্রধান ব্যস্ত তাঁর নতুন বাসভবন নিয়ে, তাঁর যাতায়াতে যেন বিঘ্ন না হয় তার জন্য সুড়ঙ্গ পথ কাটতে ব্যস্ত ছিলেন দেশের প্রধান সেবক, নিজের ঠুনকো আত্মগৌরব বাড়াতে আমার প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন চলে গেছে অন্য দেশে, তিনি বা তাঁর সরকার আমাদের কথা ভাবেন নি।

একটা কথা তো বিলকুল পরিস্কার, এ রাষ্ট্র, এই নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেবাতেও নেই ধর্মতেও নেই, তিনি এক স্বৈরাচারী, অত্যাচারী শাসক হিসেবেই থেকে যাবেন, ইতিহাস সেই জায়গাই বরাদ্দ রেখেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Video thumbnail
Kasba Incident | কসবা কাণ্ডে হকি স্টিকের রহস্য কী? জানলে চমকে উঠবেন
00:00
Video thumbnail
Kasba Incident | মনোজিতের কীর্তি জানলে চমকে উঠবেন
00:00
Video thumbnail
Kasba Incident | বিগ ব্রেকিং, কসবা কাণ্ডে পুলিশের হাতে অভিযুক্তদের টাওয়ার লোকেশন
00:00
Video thumbnail
Iran-America | সিরিয়াকে সাহায্য আমেরিকার, কোন স্ট্র্যাটেজি নেবে ইরান?
00:00
Video thumbnail
Iran-Israel | ইজরায়েলকে বিশ্বাস করা যায় না, বি/স্ফো/রক ইরানের সেনাপ্রধান, পাল্টা কী করবেন খামেনি?
00:00
Video thumbnail
India-Pakistan | ভারত-পাক বন্দি বিনিময়ে বড় সিদ্ধান্ত, দেখুন এই ভিডিও
03:56
Video thumbnail
Uttar Pradesh | BJP | ডবল ইঞ্জিনের রাজ্যে, হাসপাতালে খু/ন নার্সিং ছাত্রী
06:34
Video thumbnail
Zohran Mamdani | ডেটিং অ্যাপ থেকে পরিচয়, তারপর পরিণয়, কে এই মামদানি স্ত্রী রামা?
02:00
Video thumbnail
India-America | ভারত মার্কিন বাণিজ্য নিয়ে বড় কথা শোনাল হোয়াইট হাউস
01:12
Video thumbnail
TMC | ভোটার তালিকায় সংশোধনী স্বচ্ছতা চাই, দাবি তুলল তৃণমূল, কী বলল শুনুন
01:23

Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39