রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা এমনটা অনেকেই ভেবেছিলেন, অবশ্যই আলিমুদ্দিনের কর্তারা তো ভেবেইছিলেন। ভেবেছিলেন অসংখ্য বাম সমর্থক, এমনকী ভেবেছিলেন সাংবাদিক, রাজনৈতিক পণ্ডিতরাও, কিন্তু সব্বার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বামেদের ভোট সামান্য হলেও কমেছে, বাড়েনি। তাও অন্তত পাঁচ-ছ’টা আসন, মুর্শিদাবাদ, দমদম, যাদবপুর, শ্রীরামপুর, হাওড়া, আসানসোল এমনকী তমলুকেও বাম প্রার্থীদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ আলোড়ন ছিল। আমাদের চ্যানেলে আমরা বলেছিলাম, মুর্শিদাবাদে মহম্মদ সেলিম হারছেন, কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে থাকবেন। হ্যাঁ, এই রাজ্যের ৪২টা আসনের মধ্যে ৩০টা আসনে লড়াই করে ওই এক মুর্শিদাবাদেই ৩৩.৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে দু’ নম্বরে আছেন কমরেড সেলিম, বাকি প্রত্যেকে তিন কি চার নম্বরে আছেন। সেলিম ছাড়া জামানত বেঁচেছে আরেকজনের, দমদমে ১৯.১১ শতাংশ ভোট পেয়ে তিন নম্বরে থেকেও জামানত বাঁচিয়েছেন সুজন চক্রবর্তী। বাকি ২৮ জন, যাদবপুরের সৃজন, শ্রীরামপুরের দীপ্সিতা, হাওড়ার সব্যসাচী থেকে তমলুকের সায়ন বা ব্যারাকপুরের দেবদূত, কেউই জামানত বাঁচানোর মতো ভোটও পাননি। একটা লোকসভাতে জামানত বাঁচাতে হলে একজন প্রার্থীকে যা ভোট পড়েছে তার অন্তত ১৬.৬৬ শতাংশ ভোট পেতে হয়। তো এই হচ্ছে সামগ্রিক অবস্থা। দুটো আসনের কথা না বললেই নয়, একটা হল বসিরহাট, যে আসন সিপিআই-এর ছিল কিন্তু এবারে সেখানে সিপিএম নিরাপদ সর্দারকে দাঁড় করিয়েছিল, তিনি ৭৭৮৮৯ ভোট পেয়েছেন জামানত খুইয়েছেন, চার নম্বরে আছেন। তাঁর আগে তিন নম্বরে আছেন আইএসএফ-এর প্রার্থী, ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৫০০ ভোট পেয়ে। অন্যদিকে কৃষ্ণনগরের আসনে দেখুন প্রাক্তন বিধায়ক এস এম সাদিকে দাঁড় করিয়েছিল এই আসনে, তিনি ভোট পেয়েছেন ১৮০২০১, তিন নম্বরে আছেন। কিন্তু মজার কথা হল এই আসনে মহুয়া মৈত্র জিতেছেন মাত্র ৫৬৭০৫ ভোটে, মানে সিপিআইএম ভোট কেটে তৃণমূলকেই খানিক সুবিধে করে দিয়েছে। এইরকম বেশ কিছু আসনে আবার বাম-কং ভোট না কাটলে বিজেপি হেরে যেত, বিষ্ণুপুর, বালুরঘাট, পুরুলিয়া, মালদা উত্তর, রায়গঞ্জ অন্তত এই পাঁচ আসনে বিজেপি সম্মিলিত বিরোধী ভোটের চেয়ে অনেক কম ভোট পেয়েছে। কেবল কংগ্রেস তৃণমূল জোট হলে দুটো আসন নিশ্চিতভাবেই হারাত বিজেপি, দশে আটকে যেত। কিন্তু সে তো আর একদিনের আলোচনা, আপাতত বিষয় আজকে, বামেদের ঘুরে দাঁড়ানো হল না।
সেই ২০০৯ থেকে শুরু হয়েছে, প্রতিটা নির্বাচন যায়, আসন কমতে কমতে শূন্য, ভোট কমতে কমতে ৫ শতাংশ, কমেই চলেছে। অথচ এ রাজ্যে কেন, সারা দেশেই মানুষের চরম দারিদ্র আছে, বেকারত্ব আছে, এ রাজ্যে দুর্নীতি আছে, লাগামছাড়া দুর্নীতি। শিক্ষা ক্ষেত্রে অরাজকতা আছে, মানে বামেদের মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য হাজার একটা ইস্যু আছে। কিন্তু মানুষ শুনছে না কেন?
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু অধিকারীর ফুটুর ডুম
তার মূল দুটো কারণ আছে, মানুষ ৩৪ বছরের অভিজ্ঞতা ভুলে যায়নি, সেই ঔদ্ধত্য, সেই হামবড়া ভাব, সেই আর কেউ কিচ্ছু জানে না আমরাই সব জানি, সেই মার্কসবাদ সত্য কারণ ইহা বিজ্ঞান আর মার্কসবাদ বিজ্ঞান কারণ ইহা সত্য ইত্যাদির ব্যাখ্যা মানুষের মনে আছে। মনে আছে বাড়ির হেঁশেলটাও কন্ট্রোলে আনার সেই প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মানুষের কাছে যে বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছে বামেরা তা আজও ফেরেনি। দু’ নম্বর বিষয় হল মূল শত্রুকে গুলিয়ে ফেলা, হচ্ছে লোকসভার নির্বাচন, বক্তৃতাতে সিংহভাগ বিষয় মমতা আর রাজ্য সরকার, তাদের ভিক্ষে ওই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী ইত্যাদির মতো অর্বাচীন কথাবার্তা। অন্যদিকে এখনও, হ্যাঁ এখনও ফেসবুকে সেই একই ঔদ্ধত্য ঝলসে উঠছে বার বার, সামান্য বিরোধিতা, আপনি তো চটিচাটা, তারমানে আসল লক্ষ্য মমতা ব্যানার্জি, ফলও হাতেনাতে। মানুষ, গরিবস্য গরিব মানুষের পরিবারে মা, দুই বউমা আর দুই মেয়ের সংসারে মাস গেলে ৬০০০-৭২০০ টাকার মাহাত্ম্য না বুঝতে পারার মতো বোধবুদ্ধি নিয়ে আর যাই হোক ঘুরে দাঁড়ানো যায় না। যায়নি। মানুষ মনে করেছে তাহলে তো এরা এলে এই টাকাটাও বন্ধ হবে। অথচ এই এনারাই, এনাদের নেতারাই মাসে ন্যূনতম ২৯ হাজার মাইনে পান যিনি তাঁর ডিএ, মহার্ঘ্য ভাতার দাবিতে রোজ গলা ফাটিয়েছেন। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত স্ববিরোধিতাই বামেদের সিপিএমকে আরও বড় শূন্যের দিকে নিয়ে চলেছে। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, সর্বত্র বলা হচ্ছিল বামেরা ঘুরে দাঁড়াবে, কিন্তু ফলাফল বলছে ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, ভোট সামান্য কমেছে ৩০ জনের মধ্যে ২৮ জনের জামানত গেছে। কেন? আপনার মতামত কী?
মিছিলে লোক এসেছে? কত? হাজার দশেক? কুড়ি হাজার? তো সেই ভোট তো পেয়েছেন, তা দিয়ে তো নির্বাচন জেতা যায় না। ব্রিগেডে বিরাট ভিড়, কত? ৩ লাখ, ৪ লাখ? তো? সেই পরিমাণ সদস্য কর্মী সংখ্যা তো আপনাদের আছে, তাদেরকেই বার বার বার্তা দিয়ে কী হবে? ব্রিগেডের জমায়েত বা যাদবপুর দমদমের মিছিলে লোক আসার থেকেও জরুরি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়া, মানুষের কাছে সঠিক দাবি নিয়ে যাওয়া আর শত্রুকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করা। না হলে লেনিন সরণিতে গিয়ে এসইউসিআই-এর মিটিং দেখে আসুন, ৪২টা আসনেই প্রার্থী দিয়ে এবারে তাঁরা ভোট পেয়েছেন ০.৩৬ শতাংশ। একেই বলে শূন্যের গেরো।