‘ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না।’ প্রখ্যাত এক নাটকের এই গানটাই যেন বর্তমানকালের রাজ্য-রাজনীতির চালচিত্র। ৩৪ বছরের বাম শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে গোটা রাজ্যের ভোটারদের বিপুল সমর্থনে ক্ষমতায় আসার পর গত কয়েক বছরের মধ্যেই তৃণমূল সরকারের প্রতি মানুষ যেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে ঘাসফুল শিবিরের নীচের তলাতেও। আদ্যন্ত তৃণমূলীরাও দলের বিভিন্ন কাজকারবারের বিরোধী হয়েও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। যাঁরা এতদিন বিভিন্ন বিষয়ে সরব ভূমিকা নিয়েছিলেন, আজ জনমতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বোবা হয়ে গিয়েছেন তাঁরাও। প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যম দ্য কুইন্টে স্পন্দন রায় বসুনিয়া এক নিবন্ধে একথা তুলে ধরেছেন।
বসুনিয়া এই পরিস্থিতিকে ‘স্পাইরাল অব সাইলেন্স’ তত্ত্বের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিখ্যাত জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এলিজাবেথ নোয়েল নিউম্যানের এই তত্ত্বের মূল কথা হল, কোনও ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস বা মতপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা অনেক সময়ই সাধারণ জনমতের দ্বারা প্রভাবিত বা পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। বসুনিয়া উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, তৃণমূলের রাজ্যসভা সদস্য জহর সরকারের কথা। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে জহর সরকার যেভাবে মুখ খুলেছিলেন, তা একপ্রকার সাধারণ জনমতেরই প্রতিফলন। বসুনিয়ার মতে, এটা যদি তাঁর মতো শিক্ষিত ও সাংসদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে, তাহলে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের তো কথাই নেই।
আরও পড়ুন: কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের হাতে নিয়োগপত্র মুখ্যমন্ত্রীর, কটাক্ষ বিরোধীদের
এভাবেই তৃণমূল দলের ভিতরে যাঁরা মুখর ছিলেন, ইদানীং তাঁরাই মুখে কুলুপ এঁটে ফেলেছেন। কিন্তু, এর নেপথ্য কারণ কী, তাও নিবন্ধে লিখেছেন বসুনিয়া। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পার্থকে এ নিয়ে প্রবল জন-সমালোচনা, নিন্দার মুখে পড়তে হয়েছে। সাধারণ মানুষের রোষানলেই দল তাঁকে সাসপেন্ড করে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেন। একের পর এক নির্বাচনে জয়ী দলকেও পার্থ ও অনুব্রতর গ্রেফতারির ঘটনা বেশ পিছনে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন লেখক। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছে জবাব দেওয়ার কোনও ভাষা নেই দলের কর্মীদের।
তৃণমূলের সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাবকেও নিবন্ধে এই অবক্ষয়ের জন্য দায়ী করেছেন লেখক। সরকার-বিরোধী কোনও নাটক, সাহিত্য, ছবি, গান, সিনেমা হলেই তার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছে তৃণমূল। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূলের আচরণে। যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতার এসেছিল, তা অনেকটাই হারিয়েছে তারা এই কারণেই। ২০১২ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রর গ্রেফতারি, শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে অনুব্রত মণ্ডলের কুকথা, চলচ্চিত্র পরিচালক অনীক দত্তের ভবিষ্যতের ভূতের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন লেখক। ওই সিনেমার মুক্তি নিয়ে সে সময় রাজ্য সরকারের ‘ফ্যাসিস্ত’ ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছিলেন অপর্ণা সেন ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। সম্প্রতি, রাজ্য সরকার মহানায়ক সম্মান নামে একটি পুরস্কারও ঘোষণা করে। তাতেও দেখা যায়, যাঁদের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যেমন দেব, নুসরত জাহান, সোহমকে নিয়ে জনমানসে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বসুনিয়ার মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সবথেকে বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ইস্যুতে। দিনের পর দিন চাকরিপ্রার্থীদের পথে বসে আন্দোলনকে মনে মনে সমর্থন জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে, সরকার নিন্দা কুড়িয়েছে। বেকার ছেলেমেয়েদের এই আন্দোলন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তৃণমূল দলের পক্ষে তা অস্বস্তিকর হয়েছে। এর মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে শাসকদল।
আরও পড়ুন: বিধায়ক সুবোধ অধিকারীকে ৩ ঘন্টার বেশি জেরা নয়, সিবিআইকে নির্দেশ হাইকোর্টের
একইভাবে সারদা-নারদ দুর্নীতিতেও শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষ বা ভোটারদের বিষনজরে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, দুর্নীতিতে নাম জড়িয়ে যাওয়া নেতাদের ভোটে টিকিট দেওয়া নিয়েও আমজনতা রুষ্ট। শুধু তাই নয়, সামাজিক মাধ্যমের লড়াইয়ে তৃণমূলের দুর্বলতাও উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক রাজনীতির অন্যতম মাধ্যম সোশাল মিডিয়ায় বিজেপি এবং সিপিএম কয়েক ডজন গোলে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলের আইটি সেলের থেকে। বিশেষত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল, পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তৈরি করা মিমের ছড়াছড়ি ফেসবুক সহ অন্যান্য মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে তৃণমূল কয়েক যোজন পিছিয়ে রয়েছে এসব পার্টির থেকে। কটাক্ষের পেরেক পোঁতা হয়েছে খোদ তৃণমূলনেত্রীর ছড়া-কবিতা, আঁকা ও ভাষণ নিয়েও। যে মুখ্যমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বরাবরই সোচ্চার, তাঁর বিভিন্ন ভাষণে নারীদের প্রতি অসম্মানসূচক মন্তব্যেরও জবাব নেই তৃণমূল কর্মীদের কাছে। থাকলেও মুখ ফুটে বলার সাহস নেই কারও। একেই ‘মৌনতার জট’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক।
তবে কুইন্ট এ কথা বললেও অন্য রাজনৈতিক মতামতও রয়েছে। সেই রাজনৈতিক মহলের মতে, যে যাই বলুক, এখনও তৃণমূল নেত্রীর গ্রহণ যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দুর্নীতির প্রশ্নে তৃণমূল কিছুটা ধাক্কা খেলেও তা কাটিয়ে ওঠা মমতার পক্ষে কোনও ব্যাপারই নয়। দলের নিচুতলার হাজার হাজার কর্মী এখনও নেত্রীর প্রতি অবিচল আস্থা রাখেন। তাঁরা কী চান, তার খোঁজখবর রাখেন নেত্রী নিজের সোর্সের মাধ্যমে।
আগামী বছরের শুরুতেই পঞ্চায়েত ভোট সেরে ফেলতে চান তৃণমূল নেত্রী। তার জন্য তিনি জেলা সফরও শুরু করে দিয়েছেন। তিনি ভালোমতোই জানেন, পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বেজে গেলে এগুলি আর কোনও ইস্যুই হবে না। মমতার গরিব দরদী মনোভাব, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, মহিলাদের প্রতি ভালোবাসা, তাঁর একাধিক জনমোহিনী কর্মসূচিই তাঁর প্লাস পয়েন্ট। এগুলিকে মূলধন করেই তিনি সমস্ত বাধা পেরিয়ে যেতে পারেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনি যে এক অবিসংবাদিত নেত্রী, তা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। পার্থ, অনুব্রত গ্রেফতারের পরেও আসানসোল এবম বনগাঁ পুরসভার দুটি ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিশাল জয় প্রমাণ করে দিয়েছে, সেসব কোনও ইস্যু নয়।