কয়েকদিন পরই ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ের ৪০ বছর পূর্তি। তার আগে কলকাতা টিভি-র সহকারী ক্রীড়া সম্পাদক জয়জ্যোতি ঘোষের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অন্য মেজাজে ধরা দিলেন ‘কপিলস ডেভিলস’- এর অন্যতম সদস্য সৈয়দ কিরমানি (Syed Kirmani)। উঠে আসল ৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ের অনেক অজানা গল্প…
জয়জ্যোতি: আপনি ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা উইকেটকিপার। একইসঙ্গে ৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। জানতে ইচ্ছে করছে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন প্রথম কবে থেকে দেখতে শুরু করেছিলেন?
সৈয়দ কিরমানি: ক্রিকেটার হতেই হবে বলে কিন্তু ক্রিকেট খেলা শুরু করিনি। আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো অ্যাথলিট ছিলাম। শুধু ক্রিকেট নয়, হকি-ফুটবল সবই খেলতাম। স্কুল স্পোর্টসেও অংশ নিতাম প্রতিবার। ছোটবেলায় আমার ক্রিকেটীয় দক্ষতা দেখে প্রথমে স্কুল টিমে সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে আমি ক্রিকেটের উপর আলাদা গুরুত্ব দিতে থাকি। নিজেকে প্রমাণ করতে থাকি প্রতি ম্যাচে। ধীরে ধীরে সুযোগ আসে রাজ্য দলে, তারপর রঞ্জি ট্রফি এবং পরে জাতীয় দলে। আমি ‘স্লো বাট স্টেডি’-মন্ত্রে বিশ্বাসী। তবে একটা কথা বলতে চাইব কোনও ‘শর্টকাট’ পন্থায় সাফল্যের শিখরে পৌঁছনো যায় না।
জয়জ্যোতি: আপনার সময়ের ক্রিকেটীয় পরিকাঠামো নিয়ে কী বলতে চাইবেন?
সৈয়দ কিরমানি: ক্রিকেটীয় পরিকাঠামোর কথা বলতে গেলে এখনকার সঙ্গে কোনও তুলনাতেই আসে না। আমাদের সময়ে কেউ ‘প্রফেশনাল ক্রিকেটার’ হওয়ার লক্ষ্যে ক্রিকেট খেলত না। ক্রিকেটকে মন থেকে ভালোবাসতো বলেই খেলতো। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক মার্কেটও সেইসময় তৈরি হয়নি। আমি যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি, তখন সেভাবে গাইডেন্সও পাইনি। অনেকসময় বুঝতে পারতাম না কোন টেকনিকটা ঠিক আর কোনটাই বা ভুল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করেই ক্রিকেট শেখা বলতে পারেন।
জয়জ্যোতি: আর এভাবেই ‘কপিলস ডেভিলস’-এ নাম লেখানো এবং দেশের সেরা উইকেটকিপার হয়ে ওঠা…
সৈয়দ কিরমানি: (হাসি) লক্ষ্য স্থির থাকলে এবং মনে সাহস থাকলে সব সম্ভব। ১৯৮৩-র ২৫ জুন আমি মনে করি ভারতীয় ক্রিকেটের স্বাধীনতা দিবস। যতদিন ভারতীয় ক্রিকেট থাকবে, ততদিন লর্ডসে ব্যালকনিতে প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে হাসিমুখে কপিলের ফ্রেমটা থেকে যাবে। দেখতে দেখতে ৪০ বছর হতে চললো। মনে রাখবেন, এই দিনটিই পরোক্ষভাবে সচিন-সৌরভ- দ্রাবিড়ের মতো পরবর্তী ক্রিকেট তারকাদের জন্ম দিয়েছে। ভারতকে ‘ক্রিকেট ক্রেজি ন্যাশন’-এ পরিণত করেছে।
জয়জ্যোতি: অথচ ৮৩-তে বিশ্বকাপ জয় তো অনেক পরের ব্যাপার, ভারত যে সেমিফাইনালে পৌঁছবে- এটাও কেউ কল্পনায় আনেননি…
সৈয়দ কিরমানি: একদম ঠিক বলেছেন। আমরা ক্রিকেটাররাই কেউ কল্পনা করিনি। অনেকে বিশ্বকাপ খেলে ইংল্যান্ড থেকে সরাসরি মার্কিন মুলুকে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। ভারত দুর্বল দল বলে ভারত বনাম জিম্বাবোয়ে ম্যাচটি সম্প্রচার করা হয়নি পর্যন্ত। আমাদের বলা হয়েছিল বিবিসি স্ট্রাইক ডেকেছে। যদিও পরে জানতে পারি আসল কারণ এটা নয়। কপিলের ১৭৫ রানের অমর ইনিংস দেখতে পারলো না কেউ। বিশ্বকাপের শুরুতে একটা ম্যাচই ক্রিকেটারদের মানসিক অবস্থার বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। প্রথমেই আমরা যখন দুবারের বিশ্বকাপ জয়ী দল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করি, তখনই সবার মনে এক অদ্ভুত সাহস জন্মে গিয়েছিল। এখনও মনে আছে বিশ্বকাপ ফাইনালের ঠিক আগের রাতে ক্যাপ্টেন কপিল বলেছিলেন- ‘যদি আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একবার হারাতে পারি, তাহলে দু’বার কেন পারব না?’
জয়জ্যোতি: ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ভারত বনাম জিম্বাবোয়ে ম্যাচ। কপিল দেবের অতিমানবিক ১৭৫ রানের ইনিংস। একইসঙ্গে দলের সবথেকে কঠিন সময়ে কপিলের সঙ্গে আপনার ১২৬ রানের পার্টনারশিপ। সেই ম্যাচের স্মৃতি…
সৈয়দ কিরমানি: একটা মজার কথা বলি। সেই ম্যাচ শুরুর আগে ওপেনার সুনীল গাভাসকর ক্ষেপে গিয়েছিলেন কপিল দেবের উপর। টস করতে যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তেও ক্যাপ্টেন জানাননি, টসে জিতলে কী সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন- ব্যাটিং না বোলিং? টস জিতে যখন ব্যাটিং নেওয়া হয়, তখন নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন গাভাসকর। মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত ছিলেন না ব্যাটিং এর জন্য। ২ বলে শূন্য রান করে আউটও হয়ে যান। ভারতের ইনিংস যখন শুরু হয়, অনেকে বাইরে বসে ম্যাচ দেখলেও আমি ড্রেসিংরুমের ভিতরে ব্রেডটোস্টের সঙ্গে প্রাতরাশ সারছিলাম। ভারতের ইনিংস শুরুর ৩০ মিনিটের মধ্যে বাইরে থেকে কোনও টিমমেট বলে উঠলেন- ‘কিরি প্যাড পর’। আমি ভাবলাম কেউ বোধহয় ‘লেগপুলিং’ করছে। তাই খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। এর কিছুক্ষণ পর ফের সেই আওয়াজ- ‘কিরি কী করছ? প্যাড আপ প্লিজ…’ সেইসময় জানালার কাছে গিয়ে ভারতের স্কোরবোর্ডে চোখ রাখতে দেখি ১৭/৫। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরপর গায়ের টাওয়েল সরিয়ে রেখে দ্রুত স্নান করে ব্যাটিংয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। আমি যখন ব্যাট করতে যাই, তখন ভারতের স্কোর ১৪০/৮। মনে সাহস ছিল যে নিজের সেরাটা দেব। দলে আমাকে ‘ক্রাইসিস ম্যান’ বলে ডাকা হত। সেদিন নিজেকে ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলাম। আমার কাজ ছিল একটা প্রান্ত ধরে রাখা। সেটাই করেছিলাম। অপরদিক থেকে যা করার করছিলেন কপিল। বলা বাহুল্য, সেটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক দিন।
জয়জ্যোতি: টি-২০ যুগে ক্রিকেট খেলতে না পারায় কোনও আক্ষেপ…
সৈয়দ কিরমানি: না। কোনও আক্ষেপ নেই। আমাদের সময়ে টেস্ট ক্রিকেটকেই প্রাধান্য দেওয়া হত। ৬০ ওভারের ওয়ান ডে ফরম্যাট ছিল। একজন ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে যতটুকু অবদান রাখতে পেরেছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট।