ফ্রান্স–২ ইংল্যান্ড–১
(ওহেলিয়াঁ চুয়োমেনি, অলিভার জিরু) ( হ্যারি কেন–পেনাল্টি)
ফ্রান্স কি পর পর দুবার বিশ্ব কাপ জয়ের দিকে যাচ্ছে? শেষ পর্যন্ত কী হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনাল অবধি। কিন্তু যেভাবে ফ্রান্স শনিবারের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে দুমড়ে দিয়ে সেমিফাইনালে চলে গেল তাহলে তাদের জন্য এই রকম ভাবনা ভাবা যেতেই পারে। বিশ্ব কাপের অন্য দলগুলি যখন এক বা একাধি তারকা নির্ভর তখন ফ্রান্স খেলছে টিম গেম। জেতার জন্য গোলকিপার থেকে লেফট আউট সবারই অবদান বিরাট। যারা ভাবেন, ফ্রান্স মানেই কিলিয়ান এমবাপে গোল করবেন তারা ইংল্যান্ড ম্যাচ দেখে তাদের ভাবনা পাল্টাতে বাধ্য হবেন। এমবাপে ভালই খেলেছেন। কিন্তু গোল করতে পারেননি। তাতে ক্ষতি হয়নি ফ্রান্সের। রিয়াল মাদ্রিদের বাইশ বছর বয়সী এক অখ্যাত তারকা ওহেলিয়াঁ চুয়োমণি বক্সের বাইরে থেকে দুরন্ত ভলিতে গোওল করলেন। তখন খেলার বয়স মাত্র ১৭ মিনিট। বিরতির পর পেনাল্টি থেকে গোল শোধ করলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেন। ম্যাচ তখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে। একবার এদিক, একবার ওদিক। শেষ পর্যন্ত ৭৪ মিনিটে আঁতোয়া গ্রিজম্যানের সেন্টারে হেড করে গোল করলেন অলিভার জিরু। কিন্তু তখনও ম্যাচে অনেক নাটক বাকি। ৮২ মিনিটে আবার পেনাল্টি পেল ইংল্যান্ড। এবার কিন্তু ব্যর্থ হলেন হ্যারি কেন। বল উড়িয়ে দিলেন বারের উপর দিয়ে। শেষ হয়ে গেল ইংল্যান্ডের বিশ্ব কাপ অভিযান। আর ফ্রান্স চলে গেল সেমিফাইনালে। বুধসন্ধ্যায় তাদের সামনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মরক্কো।
ইংল্যান্ড এবারের বিশ্ব কাপে অন্যতম ফেভারিট দল ছিল। একটা দুরন্ত ছন্দের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল টিমটা। ২০১৮ সালের বিশ্ব কাপে সেমিফাইনালিস্ট। ২০২০ সালের ইউরো কাপে রানার্স। সঙ্গত কারণেই ইংরেজরা ধরেই নিয়েছিল ১৯৬৬-র পর বিশ্ব কাপটা এবার লন্ডনেই আসবে। টিমটাও ভাল ছিল তাদের। গোল করার অনেক লোক। হ্যারি কেনের সঙ্গে বুকোয়া সাকা, ফিল ফডেন, ম্যাসন মাউন্ট, মার্কাস র্যাশফোর্ড, রহিম স্টার্লিং। গোল করার এত লোক এক ব্রাজিল ছাড়া কোনও দলের ছিল না। ইংল্যান্ড শুরুটাও করেছিল ভাল। প্রথম ম্যাচে ইরানের বিরুদ্ধে ছয় গোল, তার পর ওয়েলশের বিরুদ্ধেও চার গোল। স্বভাবতই তাদের নিয়ে প্রত্যাশার পারদ চড়ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের কাছে সব জারিজুরি শেষ।
ফ্রান্স টিমের সামনের দিকটা একদম ছবির মতো। সিঙ্গল ফরোয়ার্ড অলিভার জিরু। তাঁর পিছনে তিন জন। ডান দিকে ওসুমানু দেম্বলে, বাঁ দিকে কিলিয়ান এমবাপে আর মাঝখানে গেমমেকার আঁতোয়া গ্রিজম্যান। পিছনে দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রাবিউ এবং চুয়োমেনি। এবং তার পর ডিফেন্সে ব্যাক ফোর। আর সবার পিছনে গোলকিপার এবং অধিনায়ক হুগো লরিস। এবার প্রথম চারটে ম্যাচে লরিস খুব যে ভাল খেলেছেন তা নয়। তবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি দুর্দান্ত। নয় নয় করে ছয়টা বল বাঁচিয়েছেন, যার থেকে গোল হতে পারত। ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের রাইট ব্যাক কাইল ওয়াকার বলেছিলেন, কিলিয়ান এমবাপের দৌড় টিনি থামাবেন। ভয়ঙ্কর হতে দেবেন না পাঁচ গোল করে ফেলা উইঙ্গারকে। এমবাপে খারাপ খেলেননি। তবে গোল করতে পারেননি। আর ওয়াকারের কথা শুনে হুগো লরিস বলেছিলেন, ফ্রান্স শুধু এমবাপের উপর নির্ভরশীল নয়। গোল করার আরও লোক আছে তাদের। সেটাই হল। এমবাপে গোল পাননি। তবু ম্যাচ জিততে অসুবিধে হয়নি ফ্রান্সের।
ইংল্যান্ডের ফরোয়ার্ড লাইনকে কীভাবে আটকায় ফ্রান্স সেটাই দেখার ছিল। এবং এ ব্যাপারে দিদিয়র দেশঁ নির্ভর করছিলেন তাদের সেন্টার ব্যাক রাফায়েল ভারানের উপর। গত বিশ্ব কাপেও তিনি ছিলেন ফ্রান্সের ভরসা। এবারও তাই। তাঁর পাশে অন্যরাও ছিলেন চমৎকার। তাই গোল করার তেমন সুযোগ পায়নি ইংল্যান্ড। ১৭ মিনিটে নিজেদের মধ্যে বল নিয়ে এগোতে এগোতে গ্রিজম্যান বল দেন চুয়োমেনিকে। কখন যে পিছন থেকে নিঃশব্দ ঘাতকের মতো উঠে এসেছেন রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার তা কেউ লক্ষ্য করেনি। বক্সের বাইরে থেকে একটা দুর্দান্ত শটে জর্ডন পিকফোর্ডকে হার মানান চুয়োমেনি। ৫২ মিনিটে গোলটা শোধ করে দেয় ইংল্যান্ড। বক্সের মধ্যে বুকোয়া সাকাকে ফাউল করেন চুয়োমেনি। পেনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল করেননি হ্যারি কেন। উল্টো দিকে টটেনহাম হসপারের সতীর্থ হুগো লরিসকে পরাস্ত করেন তিনি। গোলটা শোধ দেওয়ার পর ইংল্যান্ড কিন্তু দাপিয়ে খেলতে থাকে। তাদের ব্যাক ফোরও তখন দুর্দান্ত। কাইল ওয়াকার, জন স্টোন্স, হ্যারি ম্যাগুয়ের এবং লুকা শ তখন একেবারে টাইট ফুটবল খেলছেন। তাদের সামনে দুই মিডফিল্ডার জুড বেলিংহ্যাম এবং জর্ডন হেন্ডারসন তখন বলই ধরতে দিচ্ছেন না ফ্রান্সকে। কিন্তু ফ্রান্স তো ফ্রান্সই। একটু ধাতস্থ হয়ে তারা আবার শুরু করল আক্রমণ। মাঝখানে নেতৃত্ব দিলেন গ্রিজম্যান। শেষ পর্যন্ত তাঁরই সেন্টারে হেড করে গোল করলেন অলিভার জিরু। কিন্তু এই গোলটা শোধ করার সোনার সুযোগ পেয়েছিল ইংল্যান্ড। বক্সের মধ্যে মেসন মাউন্টকে ফাউল করলেন লেফট ব্যাক থিও ফার্নান্ডেস। এবার কিন্তু হ্যারি কেন উড়িয়ে দিলেন পেনাল্টি শটটা। তার সঙ্গেই উড়ে গেল ইংল্যান্ডের বিশ্ব কাপ জেতার স্বপ্ন।
আর ফ্রান্স? পর পর দুটো বিশ্ব কাপ জিততে তাদের দরকার আর দুটো ম্যাচে জয়। পারবে কি তারা? যে ফর্মে তারা খেলছে তাতে না পারার কিছু নেই। আর দরকার একটু ভাগ্যের। সেটা যে সঙ্গে আছে তা হ্যারি কেনের পেনাল্টি নষ্টের মধ্যেই পরিষ্কার। অতএব বিশ্ব কাপে আরেকটা ফরাসি বিপ্লব দেখার জন্য অপেক্ষা করা যেতেই পারে।