কলকাতা: সাংবাদিকতায় চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়ার জীবনাবসান। তখন গুগল ছিল না। সাংবাদিকতার যে কোনও তথ্যের প্রয়োজনে সবার ফোন যেত তাঁর কাছে। ঘটনা, সাল, তারিখ স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে থাকত সবসময়। লিউকেমিয়ার কাছে হেরে ৭১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন সেই বিশিষ্ট সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য। রবিবার ভোরে দক্ষিণ কলকাতার বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত দেবাশিসবাবু তাঁর প্রবল স্মৃতিশক্তির জন্য সাংবাদিকতা মানসে পরিচিত ছিলেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। যে কোনও সাংবাদিকই তথ্যের জন্যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তিনি নিমেষে স্মৃতি থেকে বলে দিয়ে সবসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
শুরুর দিকে কাজ করেন দর্পণ পত্রিকায়। পরে দীর্ঘদিন আজকাল সংবাদপত্রে রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া আকাশ বাংলা, কলকাতা টিভিতেও তিনি দায়িত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কলকাতা প্রেস ক্লাব তাঁর প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করেছে। কর্মজীবনে তিনি একাধিক বই লিখেছেন, ‘ইন্দিরার কারাগারে’, ‘ সত্তরের দিনগুলি’, ‘ সেই ত্রিশ বছর’। দেবাশিসবাবু প্রথম জীবনে ছিলেন বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। নকশালপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়ে কয়েকবছর কারাবাসেও ছিলেন। পরে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও বন্দিমুক্তি আন্দোলনে যুক্ত হন। আটের দশকে কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতিকে।
আরও পড়ুন: Independent Judiciary: অবসরের পর শাঁসাল পদ যদি পাখির চোখ হয়, তাহলে সুবিচার অসম্ভব
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রের সংযোজন-
তেলুগু কাগজ উদয়ামে তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। সেখানে মানবাধিকার সংক্রান্ত খবর বেশি থাকত। পরে আজকাল পত্রিকায় দীর্ঘদিন চিফ রিপোর্টার ছিলেন দেবাশিস। পরে ‘মুখোমুখি’ টেলিভিশন প্রোগ্রামে কাজ করেন। আকাশ বাংলা চ্যানেলে একসময় ব্যুরো চিফ ছিলেন। কলকাতা টিভিতে উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। শেষের দিকে মা-মাটি-মানুষ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর আগে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদনা করে গিয়েছেন। সাংবাদিকদের কাছে তিনি গুগল যুগের আগে কার্যত গুগল ছিলেন। পুরনো রাজনীতির ইতিহাস মুখস্ত থাকত। তাঁর নিজের সংগ্রহে পুরনো পেপার ক্লিপিংস সহ আস্ত লাইব্রেরি ছিল। তাতে তাঁর প্রায় ৫০ বছরের সংগ্রহ ছিল। দেবাশিসের আদি বাড়ি বসিরহাটে। কিন্তু, তিনি থাকতেন কালীঘাটে। সজ্জন মানুষ ছিলেন। অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। হেঁটে যাতায়াত করতে পছন্দ করতেন। ভালো মানুষ হওয়ায় কথায়-কথায় লোককে টাকা ধার দিতেন। অনেকগুলি বই লিখেছেন তার মধ্যে মনে পড়ছে, সেই তিরিশ, সত্তরের দিনগুলি, মহাকরণে মন্ত্রীরা। তাঁর জীবনযাপন কড়া নিয়মে বাঁধা ছিল। কখনও অ্যাসাইনমেন্ট ফেল করতেন না। এমন হয়েছে কাঁকড়া বিছে কামড়েছে তাই নিয়ে কোনওরকমে একটি ইঞ্জেকশন করিয়ে লখনউ চলে গিয়েছেন। সাংবাদিকতার প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন।
তাঁর অসম্ভব ভালো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল। তাঁর কাছে ফোন করে সবাই বিশ্লেষণ জানতে চাইতেন। নিজে বাম ঘেঁষা ছিলেন। তবে সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে সম্পাদনা করতেন। তা করেছেন শেষ কাজ মা-মাটি-মানুষ পত্রিকাতেও। কর্কট রোগ হয়েছিল। দেড় বছর ধরে শুশ্রুষা চলছিল। তাঁর বাড়িতে দেখতে যেতাম। বড় হাসপাতালে শুশ্রুষা করাতে পারতেন। কিন্তু, তিনি এনআরএস সরকারি হাসপাতালে শুশ্রুষা করিয়েছেন।