তাদের ‘প্রেম’-এর সম্পর্কে ‘বাধা’ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যাটি। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মা এবং তার ‘প্রেমিক’। চার বছর আগের সেই ঘটনায় নিহত শিশুর মা এবং তার ‘প্রেমিক’কে ফাঁসির সাজা দিয়েছিল আদালত। পুরুলিয়ার সুচ-কাণ্ডে নিহত শিশুর মা এবং তার ‘প্রেমিক’ দু’জনের মৃত্যুদণ্ডের সেই সাজা রদ করে দিল কলকাতা হাই কোর্ট।
দোষীরা জেলা আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেছিল কলকাতা হাই কোর্টে। বৃহস্পতিবার বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি বিভাসরঞ্জন দের ডিভিশন বেঞ্চে উঠেছিল মামলাটি। তাঁরাই দোষী মঙ্গলা গোস্বামী এবং ‘প্রেমিক’ সনাতন গোস্বামী ঠাকুরের ফাঁসির সাজা রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, দোষীরা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত জামিনের আবেদন করতে পারবেন না।
কিন্তু, কেন মৃত্যুদণ্ড রদ করা হল। এই হাই কোর্ট বলে, কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, আসামীর বিপক্ষে একশো শতাংশ অভিযোগ থাকতে হবে। পাশাপাশি পক্ষে শূন্য শতাংশ আবেদন( মানে কেউ তাঁর পক্ষে নন) থাকতে হবে। এখানে দেখা যাচ্ছে, জেল থেকে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছে মঙ্গলা এবং সনাতনের জেলে ব্যবহার ভাল ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, দোষীদের তাদের ক্ষেত্রে কম ও বয়স্কদের ছাড়ের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সনাতনের বয়স ৬১ বছর আর মঙ্গলার কুড়ি বছর। আবার তাদের বিরুদ্ধে আগে কোনও ফৌজদারি অপরাধ নেই। যদিও মৃত্যুদণ্ড রদের বিরোধিতা প্রথম থেকেই করে যান সরকারি আইনজীবী সঞ্জয় বর্ধন। তিনি বলেন, মানসিক অবসাদ থেকে এ-কাজ করা হয়নি । এটা পূর্বপরিকল্পিতা। এটা সামাজিক খারাপ বার্তা বহন করছে। বিরলতম-নৃশংস ঘটনা। তাই মৃত্যুদণ্ড বজায় রাখা উচিত।
২০১৭ সালের ১১ জুলাই জ্বর ও সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়ে সাড়ে তিন বছরের মেয়েকে পুরুলিয়ার সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছিল মঙ্গলা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, সেই সময়েই শিশুটির শরীরে একাধিক ক্ষত এবং আঁচড়ের চিহ্ন ছিল। এমনকি শিশুটির নিম্নাঙ্গে রক্তের দাগও ছিল বলে জানিয়েছিলেন তাঁরা। ক্ষতের কারণ জানতে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে এক্সরে করা হলে দেখা যায় তার শরীরের ভিতর বিঁধে রয়েছে সাতটি সূচ। কী ভাবে সুচ বেঁধানো হল, তা জানতে চাওয়া হলেও তার সদুত্তর মেলেনি মঙ্গলার কাছে। পরে দাবি করে, সে প্রাক্তন হোমগার্ড সনাতনের বাড়ির পরিচারিকা। সনাতনই তার মেয়ের উপরে ‘নির্যাতন’ চালিয়েছে।
নড়েচড়ে বসে পুলিশ। মঙ্গলাকে গ্রেফতার করা হয়। মূল অভিযুক্ত তথা পলাতক সনাতনকে গ্রেফতার করা হয় উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্র জেলায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে। পরে তদন্তে প্রকাশ্যে আসতে থাকে একের পর এক তথ্য। পুলিশ জানতে পারে পেশায় ওঝা সনাতন একজন অবসরপ্রাপ্ত হোম গার্ড। জানা যায়, নিহত শিশুকন্যাটির মায়ের প্রেমিকও। তাঁর কথাতেই চালানো হয় শিশুটির উপর অত্যাচার। এর পরই দু’জনের বিরুদ্ধে ‘প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস’ (পকসো)-সহ ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় মামলা শুরু করে পুলিশ। ঘটনার ৫৭ দিনের মাথায় ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চার্জশিট পেশ করা হয়। পুলিশের পেশ করা তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষীদের বয়ানের ভিত্তিতেই মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয় পুরুলিয়ার জেলা আদালত। কিন্তু, প্রথম থেকেই নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করে আসছিল মঙ্গল-সনাতন।
এজলাসের বাইরে বেরিয়ে সে দিন সনাতন দাবি করে, ‘‘এখনও বলছি, আমি নির্দোষ। আমি চক্রান্তের শিকার।’’ ফাঁসির রায় শোনার পর আদালতের বারান্দায় কয়েক ফুট দূরে পুলিশি ঘেরাটোপে চিৎকার করে কেঁদেছিল মঙ্গলা। মহিলা পুলিশকর্মীরাই তাকে ধরে বেঞ্চে বসিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়েছিলেন। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রসঙ্গে তারও দাবি, ‘‘আমি নির্দোষ। আমি কিছু জানি না। আমি কোনও দোষ করিনি।’’ মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মঙ্গলার মা মাধুরী মোহন্তও দাবি করেন, ‘‘মেয়েটা চক্রান্তের শিকার হল।’’ সেই মৃত্যুদণ্ডের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করা হয়। তারই রায় দান হল বৃহস্পতিবার।