কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: এখন আর সংবাদ মাধ্যমে অনুসন্ধান বা তদন্তমূলক সাংবাদিকতা (investigative journalism) দেখা যায় না। সম্প্রতি একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে এমনটাই আক্ষেপ করেছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি (Chief Justice of India) এন ভি রমনা (N. V. Ramana)। তারই জবাবে প্রধান বিচারপতিকে দীর্ঘ এক খোলা চিঠি লিখলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথ(P. Sainath)। ওই চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে এই প্রবীণ সাংবাদিকের ক্ষোভ, হতাশা, বিরক্তি ও আক্ষেপ। রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে পি সাইনাথ এই চিঠিতে রীতিমতো জেহাদ ঘোষণা করেছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিমত।
কী বললেন খোলা চিঠিতে প্রবীণ এই সাংবাদিক?
সাইনাথের মতে এখন আর সংবাদ মাধ্যমে অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা কোথা থেকে পাওয়া যাবে ? ওই ধরণের সাংবাদিকতা করতে গেলেই সেই সাংবাদিকের স্থান হবে জেলে, নতুবা তাঁকে রাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারা পদে পদে হেনস্তা হতে হবে। তার জন্যই এখন আর ওই ধরণের খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। এই প্রসঙ্গেই প্রধান বিচারপতিকে প্রবীণ সাংবাদিক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের কথা। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে ধর্ষিতা তরুণীর বাড়ি যাওয়ার পথে গ্রেফতার করা হয় কাপ্পানকে। এক বছর ধরে তিনি জেলে পচছেন। তাঁর পরিবার আদালতের দোরে দোরে ঘুরেও কাপ্পানের জামিন করাতে পারছে না। তাঁর স্বাস্থ্যেরও দ্রুত অবনতি ঘটছে। প্রধান বিচারপতিকে সাইনাথের প্রশ্ন এরপরেও কী অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতার আশা করা যায় দেশে।
প্রধান বিচারপতি যে নিজেও একসময় সাংবাদিকতা করতেন, প্রবীণ এই সাংবাদিক চিঠিতে তারও উল্লেখ করে বলেন, ‘মিডিয়া এবং আইন সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞা প্রশ্নাতীত। তাও আপনাকে কিছু কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।’ ভারতীয় সাংবাদিকতায় কেন এত অবনমন? তার পিছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে বলে সাইনাথের অভিমত। প্রথমত, বড় মিডিয়ার মালিকানা আজ কর্পোরেট দুনিয়ার হাতে। তারা মুনাফা লুটছে। দ্বিতীয়ত, সৎ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাংবাদিক্রা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। তৃতীয়ত, অনেক পেশাদার গরিষ্ঠ পেশাদার সাংবাদিকও এখন ক্ষমতাসীনের স্টেনোগ্রাফারে পরিণত হয়েছেন।
সাইনাথের কথায়, ‘আমি গত তিন দশক ধরে বলে আসছি, ভারতীয় মিডিয়া রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন কিন্তু মুনাফার কাছে পরাধীন। এখনও সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। তার মধ্যেই যেসব প্রতিবাদী সাংবাদিক আছেন তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে বন্দী।’ এই প্রসঙ্গেই প্রবীণ সাংবাদিক প্রধান বিচারপতিকে গৌরি লঙ্কেশ, সুজত বুখারি, নরেন্দ্র দাভোলকর এবং গোবিন্দ পানসারের খুন হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে এই চার জনই ছিলেন মুক্ত চিন্তার প্রবক্তা এবং রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের বিপক্ষে। তাঁদের যে খুন করা হতে পারে তেমন আশঙ্কার কথাও জানানো হয়েছিল রাষ্ট্রকে। সব জেনে শুনেও রাষ্ট্র তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এখনও অনেক সাংবাদিক কারও কারও হিট লিস্টে রয়েছেন।
রিপোর্টের উইথআউট বর্ডার নামে আন্তর্জাতিক সংগঠনের এক রিপোর্ট বলছে, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের স্থান ১৪২তম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটিতে ১৩ জন সদস্য ছিলেন। তার মধ্যে ১১ জন আমলা এবং ২ জন মাত্র সাংবাদিককে রাখা হয়েছিল। সাইনাথও সাংবাদিক হিসেবে কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে সাইনাথ চিঠিতে জানান, কমিটির বৈঠকে অপর সাংবাদিক হয় আসতেন না, এলেও নিরব থাকতেন। একমাত্র তিনি মুখ খুলতেন। কমিটি একটি গুরুত্বহীন খসড়া রিপোর্ট তৈরি করে সাইনাথ তার উপর একটি ডিসেন্ট নোট দেন। রাতারাতি সেই রিপোর্ট এবং কমিটি রীতিমতো উধাও হয়ে যায়। সাইনাথের প্রশ্নও এরপরো কী দেশে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের আশা করা যায়।
প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে সাইনাথের বক্তব্য, এসব ব্যাপারে বিচার ব্যবস্থার কিছু ভূমিকা থাকা উচিত। গত বছর করোনা আবহে (COVID-19 pandemic) সাড়া দেশে প্রায় আড়াই হাজার সাংবাদিক ছাঁটাই হয়েছেন। ছাঁটাই হয়েছেন বহু অসাংবাদিক। তা নিয়ে বিচার ব্যবস্থা নীরব। এই চিঠিতেই সাইনাথের অভিযোগ বিতর্কিত কৃষি আইনো করা হয়েছিল সরকার ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট লবির পরামর্শ মেনেই। এই কর্পোরেট লবি যে কে, তা বুঝতে কারওর কষ্ট হওয়ার কথা নয়।