Saturday, May 24, 2025
HomeScrollFourth Pillar | কারা এই পাক উগ্রপন্থী? তাদের ডেরা আর চেহারা
Fourth Pillar

Fourth Pillar | কারা এই পাক উগ্রপন্থী? তাদের ডেরা আর চেহারা

এই অসম্ভব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে মধ্য ষাট থেকে

Follow Us :

পাকিস্তানে এক জটিল টেরর নেটওয়ার্ক কাজ করে। এই নেটওয়ার্ক তৈরিতে সাহায্য করেছে পশ্চিমি দেশগুলো। এই গোটা উপমহাদেশে তাদের বিভিন্ন স্বার্থ দেখরেখ করার জন্যই এদের অস্ত্রশস্ত্র, টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার বেশিরভাগটাই পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মাধ্যমে। কাজেই এরা ওই সেনা আর আইএসআই-এর নির্দেশে আর প্রয়োজনে যে কোনও কাজ করতে পারে, দেশের মধ্যে দেশের বাইরে যখন যা দরকার হবে তাই করে অর্থ অস্ত্র আর শেল্টারের গ্যারান্টি পেয়ে যায়। ওদিকে এই পাকিস্তান সেই ৪৭ থেকেই একটা বড় অংশ সরাসরি আর্মি রুলেই থেকেছে, সরকার আর্মি মিলিটারি সবই এক। তারপরে খানিক লোকলজ্জার খাতিরেই একটার পর একটা সরকার তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু তারা চলেছে ওই আর্মি, মিলিটারিদের নির্দেশে, আইএসআই আর এক ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে তখন থেকে। আমাদের দেশে আমরা বলেই থাকি সরকারের নির্দেশে কাজ করে সেনাবাহিনী, সরকারের পিছনে এসে দাঁড়ায় সেনাবাহিনী, যখন সরকার বলে আমরা সেনাবাহিনীকে ফ্রি হ্যান্ডস দিয়েছি, তখন বুঝে নিতেই হয় যে ওনারা মানে সরকার সবটা ঠিক করে বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্দেশ গেছে, এবারে সেনাবাহিনী তা কার্যকর করবে। অপারেশন সিঁদুরের মতো এক অলমোস্ট কর্পোরেট অপটিক্স তৈরি করা কি মিলিটারিদের কাজ? সেটা নাগপুর দিল্লির থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মাথার ফসল। কিন্তু পাকিস্তানের ব্যাপারটা আলাদা, রাষ্ট্রপ্রধান যুদ্ধ না চাইলেও যুদ্ধ হতে পারে, যুদ্ধ থামতে পারে, অন্য দেশে ঢুকে আতঙ্ক, ত্রাস ছড়িয়ে দিতে পারে তাদের পোষা এই টেরর নেটওয়ার্ক। সেখানে দেশের মানুষ, সরকার সামরিক বাহিনীর পেছনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।

এই অসম্ভব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে মধ্য ষাট থেকে, যা তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই গোষ্ঠীগুলোকে ‘কৌশলগত সম্পদ’ বা ট্যাকটিক্যাল অ্যাসেট হিসেবে দেখে, আর সেই কারণেই এগুলোকে টিকিয়ে রাখে টাকা পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র, ট্রেনিং আর শেল্টার দিয়ে, সঙ্গে জুড়ে দেয় ইসলামকে, জুড়ে দেয় ধর্মকে, একদিকে দারিদ্র, অন্যদিকে অশিক্ষা আর তারওপরে ধর্মের কথা, তথাকথিত ইমানের কথা মিলে মিশে এক ঝাঁঝালো ককটেল যা নিয়মিত ব্যবহার করে এই উপমহাদেশের আরও জটিল রাজনীতিকে আরও ঘোলাটে করে রাখে। খেয়াল করে দেখুন আপনি ঠিক যখন ভাবতে শুরু করেছেন উগ্রপন্থা ব্যাকসিটে, ঠিক তখন ৩০-৪০-৫০-১০০ জনকে খুন করে সেই উগ্রপন্থার আবহকে টিকিয়ে রাখা হয়। ২০০৮ সাল থেকে পাকিস্তান বহুবার ‘Financial Action Task Force (FATF)’–এর ধূসর তালিকায় পড়েছে, কারণ তারা সন্ত্রাসে অর্থ জোগানের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব বিধিনিষেধের ফলে আরও মার খেয়েছে অর্থনীতি, ফলে শহাদত দেওয়ার লাইনে ভিড় লেগেই আছে। ১০টা মরে তো ১০০টা জন্মায়। শুরু কোথা থেকে? শুরু তো সেই কাশ্মীর দখল থেকেই, কিন্তু তা এক সংগঠিত রূপ নিয়েছে কিছু পরে।

১৯৭৯ সালের সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধের সময়ই মূল পরিবর্তনটা আসে। তখন আমেরিকার অর্থ সাহায্যে গড়ে উঠছিল এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, যারা পরে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করবে। এই আমেরিকাই পাকিস্তানের আইএসআই জিহাদি সংগঠনগুলোকে বড় আকারে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। এই মার্কিনি, বা পশ্চিমি সাহায্য আর উসকানির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তৈরি হয় এক জটিল সন্ত্রাসি কাঠামো। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরে হামলা, আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার, ধর্মীয় হিংসা ছড়ানো, আর একটা মৌলবাদী যুদ্ধ চালানো। যাবতীয় ওপেন সোর্স ইনটেলিজেন্স (OSINT), ডিক্লাসিফায়েড নথিপত্র এবং অ্যাকাডেমিক গবেষণার বলছে এই সময় থেকেই পাকিস্তানের সন্ত্রাসি নেটওয়ার্কের গভীর গাঁথনির ভিত খোঁড়া হয়েছে, যা আজ বিরাট, আরও জটিল আর অক্টোপাসের মতো অনেক অনেক শুঁড় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। প্রথমে আসুন এদের মাথা লস্কর-ই-তইবা (LeT) নিয়ে কটা কথা বলা যাক। এই সংগঠনটা ১৯৯০-এ তৈরি হয় ভারতের বিরুদ্ধে যাবতীয় টেরর অ্যাকটিভিটিজ ছড়ানোর জন্য পাকিস্তানের প্রধান মাধ্যম হিসেবে। হাফিজ সইদ, এই সংগঠনের প্রধান, যদিও সে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তবুও পাকিস্তানেই এক্কেবারে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার যাওয়া আসা কেবল নয়, তার ব্যক্তিগত সুরক্ষার বন্দোবস্ত করেছে সরকার। লস্করের মূল ঘাঁটি লাহোরের কাছে একটা ২০০ একরের জায়গায় অবস্থিত, নাম ‘মারকাজ-ই-তইবা’। যেখানে এবারে ভারত হানা দিল। কিন্তু সেখানেই তো সবাই নেই, কাশ্মীর ও পাকিস্তানের শহরগুলিতে এর নানা শাখা রয়েছে, প্রতিদিন বাড়ছে। এদের মতাদর্শ ‘আহলে হাদিস’ যেটা কট্টর রক্ষণশীল। পাকিস্তানে এর ৩০০-র বেশি মাদ্রাসা আছে, যেগুলোর মাধ্যমে এই মতবাদ ছড়ানো হয়। সেই মাদ্রাসাগুলোই এনাদের মূল রিক্রুটমেন্ট বেস, এই লস্কর-ই-তইবার পাকিস্তানে অন্তত ১৬টা প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্য বলছে। ক’টা ভাঙা হল? তার উপরে কি খুব নির্ভর করবে আগামী সন্ত্রাস ছড়ানোর পরিকল্পনা? মনে হয় না।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি

LeT-র হামলার ইতিহাস বিরাট। ২০০৮ সালের মুম্বই হামলা (১৬৬ জন নিহত), ২০০৬ সালের মুম্বই ট্রেন বিস্ফোরণ (২০৯ জন নিহত), ২০১০ সালে পুনের ‘জার্মান বেকারি’ বিস্ফোরণ (১৭ জন নিহত)। LeT-এর আন্তর্জাতিক সংযোগ রয়েছে ২১টি দেশে, বাংলাদেশ ও নেপালেও এদের নেটওয়ার্ক স্ট্রং, সেখান থেকেই এরা ভারতে ঢোকে, প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে আবার ফিরে যায়। অসংখ্য স্লিপিং সেল আছে, যাদেরকে আইএসআই-এর নির্দেশে অ্যাকটিভ করা হয়। অর্থের জোগান আসে: মূলত আইএসআই-এর সরাসরি তহবিল (প্রায় ২৫-৫০ মিলিয়ন ডলার প্রতি বছর), তার উপরে আছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে ব্যক্তিগত দান, প্রবাসী পাকিস্তানিদের দান ছাড়াও এই নেটওয়ার্কের নিজস্ব ব্যবসা, জমি কেনাবেচা এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর টাকা এরা পায়, রোজগার করে। পরের সংগঠন হল জইশ-ই-মুহাম্মদ (JeM) ২০০০ সালে মাসুদ আজহার এই সংগঠনটি গড়ে, IC-814 বিমান ছিনতাইয়ের সময় তার মুক্তির পর। এই সংগঠন সুইসাইড অ্যাটাক, আত্মঘাতী হামলার জন্য কুখ্যাত। এর সদর দফতর বাহাওয়ালপুরে, যেখানে ভারত হানা দিয়েছে, চুরমার হয়েছে সদর দফতর। সাথে আরও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে খাইবার পাখতুনখোয়া, পিওকে আর আফগানিস্তানে। বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত শিবির এরমধ্যেই আবার গড়ে তোলা হয়েছে। JeM-এর হামলার ইতিহাসও ছোট নয়, ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে হামলা, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা (৪০ জন জওয়ান নিহত), তাদের আদর্শ দেওবন্দি মতবাদের সঙ্গে যুক্ত, যা আত্মঘাতী হামলাকে এক গৌরবের কাজ বলে মনে করে, বলা হয় তুমি বেহস্তে যাচ্ছ, সেখানে তোমার জন্য হুরি পরিরা অপেক্ষা করছে।

এদের টাকা পয়সা আসে মূলত ‘আল-রহমত ট্রাস্ট’ নামক দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে, সঙ্গে তো আছেই ব্যবসা, চাঁদাবাজি, এবং আইএসআই-এর তহবিলের মাধ্যমে, তাদের স্থাবর সম্পত্তির মূল্যই প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার। এই দুটো বড় সংগঠন ছাড়াও আছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক– আইএসআই-এর একটি এক্সটেনশন হিসেবে কাজ করে আফগান-পাক সীমান্তে। এর নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি এখন আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যদিও তার মাথার দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রেখেছে ১০ মিলিয়ন ডলার। আইসিস-খোরাসান (ISIS-K) – পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সক্রিয়, যদিও এর আদর্শ পাকিস্তানের থেকে আলাদা। তবুও কিছু ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এটাকে কার্যত সহ্য করে করে কারণ এদের সঙ্গে বালোচ বিদ্রোহীদের লড়াই আছে। হারকাত-উল-মুজাহিদিন (HuM)– এটা পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে লোক সংগ্রহ করে LeT এবং JeM-এ পাঠায়, এরা কেবল রিক্রুটার, কাসভ এদের রিক্রুট করা জঙ্গি ছিল। এছাড়াও ব্যাঙের ছাতার মতো বেশ কিছু সংগঠন গজিয়ে ওঠে বা গজিয়ে উঠতে আইএসআই সাহায্য করে, কারণ সেসব নতুন সংগঠনকে দিয়ে কাজ করাতে সুবিধে হয়, তাদের উপরে নজরদারি কম থাকে। পাকিস্তান এই সব সংগঠনের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ রাখে না, বরং সরকারের একটা অংশ সেগুলোকে সরাসরি সাহায্য করে। আইএসআই-এর ‘এস-উইং’ এইসব সংগঠনের তহবিল, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র জোগান দেয়। সত্যিই তো পাকিস্তান ‘ওয়ার অন টেরর’-এ যুক্ত, কিন্তু তার পরে পাকিস্তান ‘ভালো জঙ্গি’ মানে যারা পাকিস্তানের কাজে লাগে আর ‘খারাপ জঙ্গি’ যারা পাকিস্তানের ক্ষতি করে– এই দুই ভাগে জঙ্গিদের ভাগ করে একদলকে সাহায্য করে, অন্য দলকে মেরে বলে আমরা উগ্রপন্থার সঙ্গে লড়ছি। ১৯৯০ সাল থেকে পাকিস্তানের মদতে এই ধরনের গ্রুপগুলোর সন্ত্রাসে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৪৫,০০০ মানুষ, বিভিন্ন ঘটনায়, বিভিন্ন দেশে, এমনকী পাকিস্তানেও। আর এক বিরাট সমস্যা হল এদের ফিনান্স নেটওয়ার্ক, এই সংগঠনগুলো টিকিয়ে রাখতে যে অর্থব্যবস্থা রয়েছে, তা অসম্ভব জটিল। আপাতত বিদেশি টাকা বন্ধ, কিন্তু এদের জন্যই ৪০টার বেশি দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫০-২০০ মিলিয়ন ডলার তোলে প্রতি বছর। গোপন বাজেট বরাদ্দ থাকে পাকিস্তানের, আর হাওলা ট্রান্সফার, এমনকী ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমেও অর্থ আসে।

এর উপরে আছে মাদক পাচার যার পরিমাণ কমবেশি ৭৫ মিলিয়ন ডলার), পাকিস্তানে মাদ্রাসার সংখ্যা ৩০,০০০-এরও বেশি। এর মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ সরাসরি চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের সিলেবাসে চূড়ান্ত ভারত-বিরোধী প্রচার, সোশ্যাল মিডিয়ায় থ্রেট স্পিচ, এবং গরিব পরিবারের ছেলেদের নিয়োগ– এই সব মিলিয়ে এটি একটা সেলফ সাফিসিয়েন্ট টেরর মেশিনে হয়ে উঠেছে। এই নেটওয়ার্ক চিরটাকাল একই থাকছে না, এরাও পাল্টাচ্ছে, বিবর্তন হচ্ছে। ধরুন এদের শুরুয়াত সেই ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীরে হামলার মাধ্যমে কিন্তু ২০০০-এর পর আত্মঘাতী হামলা, মানে সুইসাইড অ্যাটাক বাড়ে, মানে তার আগে কিন্তু সেটা আমাদের জানাই ছিল না, ৯/১১-র পর আরও পাল্টায় এরা– নাম পাল্টে বা ‘চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ বানিয়ে কাজ চালানো শুরু করে। আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা ফিরে আসার পর আবার নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে ফেলে। ২০১৮ পর্যন্ত একটু সামলে ছিল আবার সক্রিয় হয়েছে ২০১৯-২০ সালে, ২০২৩-২৪ সালে ভারতের নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে অনুপ্রবেশও আবার বেড়েছে। যদিও ট্রাম্প সাহেব মনে করেন এটা ভারত-পাক সমস্যা, কিন্তু বাস্তব সত্যিটা হল এটা শুধুমাত্র ভারতের সমস্যা নয়, এটা গোটা বিশ্বের জন্য একটা হুমকি। পাকিস্তান বছরের পর বছর ধরে এই টেরর নেটওয়ার্ককে সাহায্য করছে, বেড়ে ওঠার ইন্ধন জোগাচ্ছে, যা আসলে তাদের রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ। এপ্রিল মাসে অনন্তনাগ জেলার পহেলগামে LeT-র হামলায় ২৬ জন সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা তারই প্রমাণ।

RELATED ARTICLES

Most Popular