Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: ইনসাফ? এ ব্যবস্থায় প্রতিশ্রুতি আছে ভুরিভুরি, ইনসাফ নেই

চতুর্থ স্তম্ভ: ইনসাফ? এ ব্যবস্থায় প্রতিশ্রুতি আছে ভুরিভুরি, ইনসাফ নেই

Follow Us :

ভারি ভালো লেগেছে শ্লোগানটা, বুদ্ধিদীপ্ত শ্লোগান। আনিশ হত্যার ইনসাফ চাই, তুই আসিস, বন্ধুকেও আনিস। অনেকদিন পর ফোটা কৃষ্ণচূড়ার মতো দেখাচ্ছিল ওয়াই চ্যানেল, চৌরঙ্গি এলাকা। অনেকদিন পর মিছিলের সেই মুখ দেখেছি। কানে এসেছে ইনসাফ কথাটা, ন্যায় বিচার, ইনসাফ, যারা চিরটাকাল মাথা কুটে মরে, এই ব্যবস্থা ইনসাফের, ন্যায় বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়, হাজার হাজার তরুণ যুবক, যুবতী, কিশোর রাজপথে নামে ইনসাফ চায়, কিন্তু ইনসাফ অধরাই থেকে যায়। আজ তাই নিয়েই আলোচনা।

১৯৫৭ থেকেই উধাও হয়েছিল চাল-গম, মানুষ ভাত চাইতে শহরমুখো তখন থেকেই। বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন চলছিল, শেষমেশ ১৯৫৯-এর ৩১ শে আগস্ট শহীদ মিনার এর জমায়েতে গ্রাম গঞ্জ থেকে মানুষ আসছিল, ভাত চাই, খাদ্য চাই। গুলি চললো। বিভিন্ন পরিসংখ্যান আছে, অন্তত ৮০ জনের মৃত্যু হল, গুলিতে, লাঠিতে, আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে, কারোর লাশ পড়ে থাকলো রাজপথে। সেদিন সম্মিলিত বিরোধী নেতারা, কর্মীরা, ছাত্র-যুবরা ইনসাফ চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র গুলি করে মেরেছে কাদের? যারা ভাত চেয়েছিল, ফ্যান চেয়েছিল, একবেলা, অন্তত একবেলা খাবার চেয়েছিল তাদের। আবার ১৯৬৬-তে, আবার খাদ্য আন্দোলন, ১৭ই ফেব্রুয়ারি বসিরহাটের স্বরুপনগরে পুলিশের গুলিতে মারা গেলো ছাত্র নুরুল ইসলাম, রাজ্য বিধানসভার সভা চলাকালীন বিদ্যুৎবেগে সিপিআই সদস্য সোমনাথ লাহিড়ী সভায় প্রবেশ করে বলতে শুরু করলেন, স্যার, এই মাত্র খবর পাওয়া গেল বসিরহাটের স্বরূপনগরের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র নুরুল ইসলামকে এই সরকারের পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। অপর একটি ছেলে মণীন্দ্র বিশ্বাসকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের অপরাধ তারা তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে ধর্মঘট করে খাদ্য ও কেরোসিন তেলের জন্য স্বরূপনগর থানার সামনে আসা শোভাযাত্রায় অংশ নেয়, সেই শোভাযাত্রার উপর গুলি চালানো হয়। যে সরকার খেতে দিতে পারে না, তারা গুলি করে হত্যা করতে পারে কী করে? বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হল, কদিন পরেই কৃষ্ণনগরে, ৪ মার্চ রেশনে কেরোসিন তেল দিতে হবে, তার দাবিতে বনধ, ছাত্রদের মিছিল, আবার গুলি চললো, এবার মারা গেল আনন্দ হাইত, ১৭ বছরের তরতাজা ছাত্র, আনন্দ হাইত। ৫ মার্চ, প্রতিবাদ রাজ্যজুড়ে, আবার গুলি চলল, এবার পুলিশের গুলিতেই মারা গেলেন কৃষ্ণনগরের বৌবাজার নতুনপল্লীর কংগ্রেস সমর্থক প্রতুল বিশ্বাসের ছেলে ২৭ বছরের যুবক হরি বিশ্বাস। সেদিন বাংলা ইনসাফ চেয়েছিল, পুলিশ নয় ওরা দানব বলেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সোমনাথ লাহিড়ি। দৈনিক বসুমতি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হল, ‘কিশোর আনন্দ হাইতের মা বসুমতীতে প্রকাশিত পুত্রের ফটো দেখিয়া আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন—ওরে আনন্দ ফিরে আয়। হে শোকার্ত বঙ্গজননী, আনন্দ আর ফিরিবে না। পশ্চিমবাংলা হইতে আনন্দ বিদায় লইয়াছে, সেখানে গণতন্ত্রের কবর খোঁড়া হইয়াছে এবং সেই কবরের পাশে অন্ধকারে মিলিটারির ছায়ামূর্তি পদচারণা করিতেছে—আনন্দ-নুরুল-হরি-অর্জুন প্রভৃতি কিশোরেরা সেই গণতন্ত্রের কবরে শায়িত। আর শাসকেরা শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার গর্বে গৌরবান্বিত। না কোনও বিচার নয়, তদন্ত নয়, পুলিশি হত্যাকাণ্ডের কোনও প্রতিকার নাই। হে শোকার্ত জননী আনন্দ সত্যই বিদায় নিয়াছে। এই পশ্চিমবঙ্গে আনন্দ আর ফিরিবে না। সত্যই অবস্থা আজ ফার্স্ট ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস মুখ্যমন্ত্রী’।   

এরপরেই বাংলায় যুক্তফ্রন্টের সরকার তৈরি হল, প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ৬৭ সালের ১লা মার্চ থেকে ২রা নভেম্বর, দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার ১৯৬৯’র ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭০ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত সরকার চলে। পুলিশমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। না ইনসাফ কেউ পায়নি, ৫৯-এর ৮০ জন শহীদ, ৬৬’র নুরুল, আনন্দ, হরি, অর্জুন, না একজনও পুলিশ অফিসারকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় নি, একজনও শাস্তি পাননি। ইনসাফ? ওহ কোন চিড়িয়া কা নাম হ্যায়? চলুন আর একটু এগোই। ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশ ঘটক, পরবর্তীকালে শ্রমমন্ত্রী শান্তি ঘটকের ভাই, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমেন্দ্র দত্ত এবং স্বপন পাল — দক্ষিণেশ্বর আড়িয়াদহের এই ৮ জন কমরেডকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে বারাসাতের রাস্তায় তাঁদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ফেলে আসে। তার কিছুদিন পরে ১৯৭১-এ ৫ আগস্ট গড়ের মাঠে সরোজ দত্তকে খুন করেছে পুলিশ, লাশ ও লোপাট। ১২ আগস্ট কাশীপুর – রতনবাবু রোদের মাঝখানে জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে খুন করে কিছু যুবক। এরপরে ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় তাণ্ডব। বাবলু, লকা, ছোটবাবু, নিতাই, হাতকাটা কেলো, ট্যাঁরা শঙ্কর, এলাকার গুন্ডা, কংগ্রেসী আর অন্যদিকে সিআরপি ঘিরে ফেলে বরাহনগর রতনবাবু ঘাট রোড, কাশীপুর রোড, চন্দ্রকুমার রায় লেন, প্রামাণিক ঘাট রোড, ঘর থেকে টেনে বার করা হয় যুবক-যুবতীদের খুন করা হয়, গায়ে ছুরি দিয়ে নকশাল লিখে দেওয়া হয়, খুন করে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে রতনবাবু ঘাটের সামনে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়। রাজ্যজুড়ে এই কাশীপুর-বরাহনগর হত্যার নিন্দা হয়, প্রতিবাদ হয়, পুলিশের শাস্তি দাবি করেন এমন কি সিপিএম, সিপিআই নেতারাও। ৭৭-এ ১৪ই জুন বাংলায় নির্বাচন হল, সেদিন সন্ধ্যায় আড়িয়াদহ-দক্ষিণেশ্বর এলাকার নেতা, সেবারের কামারহাটির নির্বাচন প্রার্থী রাধিকা রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রিকশায় করে বাড়ি ফিরছেন, সঙ্গে তাঁর জামাই যুব ফেডারেশনের নেতা রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। হঠাৎ গুলি চললো। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন। ইনসাফ চাই, রাস্তায় নেমেছিল যুব ছাত্ররা। বাম সরকার তৈরি হল, পুলিশ দপ্তর জ্যোতি বসুর হাতে। না একজনেরও শাস্তি হয়নি, কুখ্যাত রুনু গুহ নিয়োগীর শাস্তি হয়নি, প্রোমশন হয়েছে। চলুন আরও এগোই। নো ভোটার কার্ড, নো ইলেকশন, শ্লোগান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, টিএন শেষণ মুখ্য নির্বাচনী অফিসার হবার পরেই ভোটার কার্ড চালু করার কথা বলেছেন, জ্যোতি বসু শুনে বলেছিলেন, মেগালোম্যানিয়াক। মমতা দাবি করেছিলেন ভোটার কার্ড চাই। মূলত সেই দাবিতেই ধর্মতলা অঞ্চলে বিক্ষোভ সমাবেশ, জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ওরা রাইটার্স দখল করতে চায়। ১৯৯৩ সাল। গুলি চললো। ১৩ জন যুবকংগ্রেস কর্মী মারা গেলেন, অধিকাংশের দেহের ওপরে গুলি লেগেছিল, যা হওয়া উচিত নয়। বাংলা উত্তাল হয়েছিল। বাংলা ইনসাফ চেয়েছিল। বহু পরে ২০১১-তে ৯৩-এর পুলিশমন্ত্রী, ২০১১-র মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভাট্টাচার্য, বামফ্রন্টকে হারিয়ে ক্ষমতায় এল তৃণমূল দল। সেদিনের স্বরাষ্ট্র সচিব মণীশ গুপ্ত হলেন মন্ত্রী। মৃতদের পরিবারকে সাহায্য করা হয়েছে, তাঁরা চাকরি পেয়েছেন, সব ঠিক আছে, কিন্তু ইনসাফ? গুলি করে মারার জন্য কারোর শাস্তি? না হয়নি। একজনেরও না। এবার আনিস। ঠিক কী করে মারা গেলো, না জানা নেই, সে রহস্য এখনও উন্মোচিত নয়। কিন্তু পুলিশ যে দায়ী, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কারা এসেছিল মাঝরাতে? কেন এসেছিল? কিভাবে, কেন আনিস মারা গেল? তাকে কে হত্যা করলো? দায় কার? জানা যায়নি। ছাত্র যুব রাস্তায়। তুই আসিস, বন্ধুকেও আনিস। এসেছিল তো, ইনসাফ চেয়েছে তারা। ইনসাফ পাবে? না পাবে না। ইনসাফ আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোতে নেই। যারা স্বাধীনতার আগে বিপ্লবীদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল, রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েছিল, তারাই পরে মন্ত্রী হয়েছে, কেষ্টবিষ্টু হয়ে অসেছে সমাজে। যারা গান্ধী হত্যা করলো, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরিয়ে দিল, যারা মুচলেকা দিল, যারা বিশ্বাসঘাতক, তার আজ দেশের ক্ষমতায় বসে আছে। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো এমনই। আসলে ইনসাফ চাইলেই তো হবে না, ইনসাফ কিভাবে আসবে, তাও তো ঠিক করার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। প্রতিটা বেআইনি কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে যারা মানুষ মারলো, তারা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? যারা অনায়াসে ছাত্রদের বুকে গুলি করে রাজপথে শুইয়ে দিতে পারে, তারা তো দানব। সত্যিই তো বলেছিলেন সোমনাথ লাহিড়ি। বলেছিলেন, কিন্তু একজন দানবকেও চিহ্নিত করতে পারেননি। রুনু গুহ নিয়োগীর মত কুখ্যাত পুলিশ অফিসার কেবল পার পেয়ে যায়নি, প্রোমশন পেয়েছে, অবসরের পর মিথ্যে গপ্পো লিখেছে। একজন অপরাধী শাস্তি না পেলে, সমাজে ১০ জন অপরাধী তৈরি হয়। প্রত্যেকেই বুঝে যায়, আইনি পোশাক পরে গুলি চালানোর অধিকার আছে তার, তারা গুলি চালায়। তাদের শাস্তি হয় না, অন্য আরেক আইনি উর্দিধারী গুলি চালানোর প্রেরণা পায়। ইনসাফ কেঁদে মরে। আমাদের দেশে ইনসাফের প্রতিশ্রুতি তো আছে ভুরি ভুরি, ইনসাফ নেই।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments