সে এক সময় ছিল। দেশের কংগ্রেস বিরোধী, বিজেপি বিরোধী নেতারা দিল্লিতে সিপিএম নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন, পিছনে পিছনে সংবাদমাধ্যম। খবর অলরেডি বেরিয়ে গিয়েছে, এমনকী কংগ্রেসও চায়, দেশের প্রধানমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু। জ্যোতি বসু বলেছেন, আমাদের দলে ওরকমভাবে হয় না, কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা, কমিটি বৈঠকে বসবে, আলোচনা করবে, জানাবে। বিভিন্ন লেভেলে আলোচনা চলতে চলতেই খবর এল পলিটব্যুরো এই অফার নিতে নারাজ। সেদিন এক বিরাট বুদ্ধিজীবীর দল, ইরফান হাবিবের মতো ঐতিহাসিক, আরও অনেকে সিপিএম দফতরের বাইরে রাগে ফেটে পড়লেন, এটা ভুল হচ্ছে। জ্যোতি বসু ভাবলেশহীন মুখ করে গাড়িতে চেপে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলেই দিল্লির এয়ারপোর্টে চলে গেলেন। কেবল সেদিন নয়, সেদিন থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত দেশের ইংরিজি হিন্দি সংবাদপত্রের প্রথম পাতার খবর ছিল এই সরকার তৈরি, সিপিএম-এর পলিটব্যুরোর মতামত, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক, কী হতে পারে, কী কী সম্ভাবনা রয়েছে। মানে এই সিপিএম, জ্যোতি বসু নিয়ে আলোচনা সমালোচনা, এডিটোরিয়াল, পোস্ট এডিটোরিয়াল থেকে কুচো খবরেও সিপিএম। শেষ পর্যন্ত হারদানাহাল্লি দেবেগৌড়া, যাঁর নাম আবার জ্যোতি বসুই জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলেন। এখন অবশ্য তিনি এনডিএ-তে, বিজেপির সঙ্গে। মিটে গেল? না, কমিউনিস্ট পার্টিতে কিছুই মেটে না, কারণ ওঁরা মিটতে দেন না। বহু পরে আবার খবরের কাগজের আলোচনায় এসে হাজির হল এই এপিসোড। জ্যোতি বসু নিজেই খানিকটা চ্যালেঞ্জ জানালেন দলকে, এম জে আকবরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উনি জানালেন, এটা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। আবার ন্যাশনাল ইংলিশ ডেইলির প্রথম পাতা, আবার আলোচনা।
কিন্তু সিপিএম জানিয়েছিল, বেগুনের সঙ্গে খাসির মাংসকে পায়েসের মধ্যে ধানি লঙ্কার মিশ্রণে পোস্ত আর আদাবাটা ভাজা ভাজা করে মেখে কুমড়োর ফালি আর পুদিনা পাতার সঙ্গে গাঁদাল পাতার ঝোল গোত্রের এক রেসিপির কথা। কেউ বোঝেননি, তাতে ওঁদের কিছুই যায় আসেনি, ওঁরাও যে বুঝেছেন তেমন দাবিও কেউ করে না। এরপরে আবার সিপিএম ন্যাশনাল ডেইলি নিউজ পেপারের প্রথম পাতায়, কারণ নিউক্লিয়ার ডিল, তো সে কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়, আমআদমির জানা ছিল না, কিন্তু সিপিএম জানিয়েছিল, সেই ডিল সই হয়ে গেলে ব্যস, দেশ শেষ। এদিকে এই বঙ্গে আপাতত যাঁকে ভদ্রতা, সৌজন্য, অমায়িক আচরণের প্রতীক বলা হয়ে থাকে, সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানিয়েই দিয়েছিলেন দুটো কথা। এক, দিল্লির সরকার আমরা উঠতে বসলে উঠবে, বসতে বললে বসবে। দুই, শিল্প হবে না মানে? কেউ বাধা দিতে এলে মাথা ভেঙে দেব। কিন্তু ওপাশে ছিলেন আরেক চাণক্য, প্রণববাবু, বিজেপি আর বামেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার পড়ল না, সামলে নিলেন। কিন্তু লাভের মধ্যে লাভ, কংগ্রেস আর তৃণমূল কাছাকাছি এসে গেল, মানে সোজা বাংলায় ঘটি হারাল। এবার অবশ্য ওই নিউক্লিয়ার ডিল-এর বিরোধিতা করা ইত্যাদিকে আরও বড় ঐতিহাসিক ভুল ইত্যাদি বলার মতো নেতাও ছিলেন না, ওটা নিয়ে জাস্ট চেপে যাওয়া যাকে বলে, সেই চেপে যাওয়া হল। আজও, এতদিন পরে, মানে প্রায় ১৫ বছর কেটে গিয়েছে, ডিল হয়েছে, সই হয়েছে, দেশ এখনও দেশেই আছে, কেবল এখন দেশ বাঁচানোর জন্য এ বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে হাত আর কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোট গড়েছে সিপিএম। কিন্তু ওঁরাই বলে থাকেন, ওঁদের সব কিছুই নাকি বহু আলোচনার পরে ঠিক করা হয়।
আরও পড়ুন: ইন্ডিয়া জোটের অ্যাঙ্কর বয়কট এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (15.09.23)
এরকম অনেক আছে, ভোটার কার্ড এক অবাস্তব প্রস্তাব, প্রত্যেক ভোটারের কার্ড হবে? এটা মেগালোম্যানিয়াক টি এন সেশনের মাথার গন্ডগোল। বলেছিলেন, ওই প্রচুর আলোচনা করেই বলেছিলেন, চালু হয়েছে, সারা দেশজুড়ে চালু হয়েছে, একটা কথাও শুনেছেন সিপিএম-এর মুখে? একবারও কি তাঁরা জানিয়েছেন, সেদিন তাঁদের ওরকম চিন্তার পেছনে কোন যুক্তি ছিল? তারপর সেই বিখ্যাত গ্যাট চুক্তি, ডাঙ্কল চুক্তি ওফফ, সে কী বিশ্লেষণ, ডাঙ্কল আঙ্কলও নিজের সম্বন্ধে এত জানতেন না। যারা মোড়ে মোড়ে এসব বলেছিলেন, তাঁরা দিব্যি ভুলেই গেছেন। উবে গিয়েছে সেই গ্যাট আর ডাঙ্কল চুক্তি। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ, সে এক কাণ্ড, এক বৃদ্ধ মানুষকে দু’ হাত তুলে বলতে শুনেছিলাম, ওরে ভাই আমাদের ঘরে মাতৃদুগ্ধ হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু মাতৃদুগ্ধ না থাক স্লোগানে তেজ ছিল। আজ সেই থিওরি কোথায় গেল? জিরো বাজেট? অসীমবাবু চালু করেছিলেন, গণশক্তিতে কত লেখা। সেই তত্ত্ব কেরলে লাগু হয়েছে? ত্রিপুরাতে? সেই তত্ত্ব কোথায় গেল? আর আদি অকৃত্রিম জণগণতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি ভাটের কথাবার্তা না হয় বাদই দিলাম, ওগুলো ওঁরাও বলা বন্ধ করেছেন, বুঝেছেন, ওসব আর যাই হোক ওঁদের কম্ম নয়। আসলে একদল মানুষ কেবল ভড়কি দিয়ে, কিছু বড়বড় কথা বলে, কিছু শব্দের জাগলারি দিয়ে নিজেদের এক আদর্শ ইত্যাদির আড়ালে রেখে আদতে আত্মরতিতে ব্যস্ত ছিল। আজও সেই ধারা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। দেশজুড়ে এক বিজেপি বিরোধী জোট তৈরি হয়েছে, দেশের বিজেপি বিরোধী বহুদল এখানে এসে হাজির হয়েছে, মূলত দুটো কারণে। প্রথমত তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। তারা জানে যে বিজেপি যে কোনও মুহূর্তে তাদের দল ভাঙতে পারে, তাদের এমএলএ, এমপি, তাদের দলের কর্মকর্তাদের ভাঙিয়ে নিতে পারে। বিজেপির বড় বড় নেতাদের অনেকেই এই ক’দিন আগেও কংগ্রেস করতেন, মাধবরাও সিন্ধিয়া, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, অনেকেই আছেন। অন্যান্য দলেও তাই। দু’ নম্বর কারণ হল এই বিরোধী দলের লড়াইটা বিজেপির সঙ্গে, তাদেরকে বিজেপিকে হারিয়েই রাজনীতিটা করতে হচ্ছে। আর ঠিক এই জায়গাতেই সিপিএম-এর সুবিধে, যেখানে সিপিএম আছে, সেখানে তাদের ভাঙানোর কোনও চেষ্টা বিজেপি করবে না। কেরলে সিপিএমকে ভেঙে বিজেপি করে সেখানকার রাজনীতিতে খুব একটা কিছু করা যাবে না। আর কেরলে যেখানে সিপিএম আছে, সেখানে তাদের লড়াই বিজেপির সঙ্গে নয়, কংগ্রেসের সঙ্গে। কাজেই এই যে তাদের বিরোধী জোটে আসা, সেটা ওই এক ধরনের কেতাবি প্র্যাকটিস, অ্যাকাডেমিক প্র্যাকটিস। এটা আজ নয়, সিপিএম-এর জোট নিয়ে গোটা ধারণা চিন্তাটা বরাবর এরকমই। এবার সেই ইন্ডিয়া জোট নিয়ে তাদের পলিটব্যুরো বৈঠকে বসেছিল। মানে জোট হয়েছে সেই কবে, জোটের নাম ঠিক হল, যখন এটাও ঠিক হল যে কয়েকটা কমিটি তৈরি করে এবার জোটের কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ঠিক তখন সিপিএম-এর পলিটব্যুরো বৈঠক বসে পড়ল। কী সিদ্ধান্ত হল? জোটের হয়ে রাজ্যে রাজ্যে প্রচার করতে হবে। জোটের বক্তব্য রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু জোটের কোনও সাংগঠনিক কাঠামো থাকলে হবে না, তাতে নাকি সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধে হবে।
এর মানে বুঝতে পারলেন? এই যে, রাজ্যে রাজ্যে সভা করতে হবে, জোটের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু, কিন্তু কোনও কমিটি করা যাবে না, তাতে নাকি সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধে হবে। বুঝতে পারলেন না তো? আমরাও পারিনি, ওঁরাও এর মানে জানেন? সম্ভবত না, জানেন না। একটা জোট তৈরি হবে, জোটের মধ্যে ২৮টা দল থাকবে, কিন্তু কোনও সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে না, কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি যা বলবেন তাই মেনে চলতে হবে? একটা পাড়ার ক্লাবেও একটা কমিটি থাকে, তারা বসে সিদ্ধান্ত নেয়, ওঁরা দেশ জুড়ে জোট তৈরির কথা বলছেন, কিন্তু জানিয়েই দিলেন কোনও কমিটি থাকবে না। কেন? কারণ ওঁদের দলের কর্মীদের অস্বস্তি। বাংলায় ওঁদের অসুবিধে তৃণমূল নিয়ে, কেরলে ওঁদের অসুবিধে কংগ্রেস নিয়ে। বিজেপি নিয়ে আগেই বলেছি, ওঁদের কোনও অসুবিধেই নেই। এটা এখন বললেন, কিন্তু আরও বলা বাকি। আচ্ছা রাজ্যে রাজ্যে মানে কোন রাজ্যে? ধরুন কাল যদি এই বাংলায় একটা ইন্ডিয়া জোটের জনসভা হয়, সিপিএম থাকবে? থাকলে কী বলবে? এবং একই মঞ্চে থাকলে আবার সেই অস্বস্তি। একই বিষয় ঘটবে যদি ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক কেরলে হয়। তখন সিপিএম-এর পলিটব্যুরো আবার বসবে, পলিত কেশ নয়, পলিত বুদ্ধি খাটিয়ে তখন বলা হবে এই বাংলা আর কেরলে ইন্ডিয়া জোটের কোনও সমাবেশ দরকার নেই। কিন্তু আর কোথাও আপনাদের মঞ্চে তোলা হবে কেন? একটা সলিড রিজন দেখান, দিল্লি বা গুজরাত বা রাজস্থান বা কর্নাটক বা উত্তরপ্রদেশেও আপনাদের মঞ্চে তোলা হবে কেন? কোন কামে আসবেন আপনারা সেখানে? কে আপনাদের চেনে? আসলে সিপিএম এখনও এই বাংলা আর কেরলেই খবরের কাগজে জায়গা পায়। খুলে দেখুন আজকে দ্য হিন্দু বা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দেখবেন এই এত্তবড় পার্টি সিপিএম-এর পলিটব্যুরো বসল, ইন্ডিয়া জোট নিয়ে বৈঠক করল, তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য জানাল, কিন্তু এক লাইন খবরও ওঁরা করেননি, করেননি কারণ সিপিএম জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, আর ক’ বছর পরে রাজ্যের রাজনীতিতেও তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যাবে।