বিজেপির সরকার গত ১১ বছরে এমন কিছু করেনি যার ফলে তারা মানুষের সমর্থন নিয়ে ভোটে জিতে গদি দখল করতে পারে। খেয়াল করে দেখুন, সেই শুরু থেকে ডিমনিটাইজেশন থেকে কালা ধন থেকে করোনা থেকে কৃষি বিল থেকে সিএএ থেকে আজ পর্যন্ত গোটা ইতিহাসটা। একটা টোটাল ফেলিওর। কোনও অর্থেই তাঁরা এমন কিছু করে দেখাতে পারেননি যা নিয়ে তাঁরা গর্ব করে বলতে পারেন যে এই দেখো এইটা আমরা করেছি, অতএব আমাদের ভোট দাও। কী বিশাল বাওয়াল দিয়ে ওই ডিমনিটাইজেশন করেছিলেন, অত বড় একটা সিদ্ধান্ত, এখন মোদিজির মুখে, বিজেপির কোনও নেতার মুখে শুনতে পান যে ডিমনিটাইজেশন ঠিক হয়েছিল? না পান না। করোনার সময় তো বাদই দিলাম, সেই মৃত্যুমিছিল আমরা জেনেছি। এই সরকার অন্তত তিনটে বিল পাশ করিয়ে হয় লাগুই করে উঠতে পারেনি, না হলে ফেরত নিয়েছে। বিশাল ঢাকঢোল বাজিয়ে তিনটে কৃষি বিল পাশ করিয়েছিল, কৃষকদের আন্দোলনের মুখে তা ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছে। নাগরিকত্ব বিল পাশ করে এখনও, এখনও তাকে লাগু করার সাহস দেখাতে পারছেন না, কেবল নির্বাচন এলে লাগু করার কথা বলছেন নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে আবার চুপ। নারী সংরক্ষণ বিল এনেছেন কিন্তু তা কবে লাগু হবে ওনারাও জানেন না, কেউ জানে না। ইন ফ্যাক্ট সেটা তো জণগণনা আর ডিলিমিটেশনের পরে হবে। এদিকে জনগণনা করতে পারছেন না, কারণ জনগণনা করলেই জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি উঠবে, না করলে শরিক দল সরে যাবে, করলে ওনাদের কোর ভোটার, উচ্চবর্ণের ভোটাররা সরে যাবেন। জনগণনা হচ্ছে না অতএব ডিলিমিটেশনও হচ্ছে না। একটা দেশে সেই ২০১১ থেকে ২০২৫-এ আমরা চলে এলাম, জনগণনা করার সাহস সরকার দেখাতে পারছে না। তারমধ্যে এক দেশ এক ভোটের বিল নিয়ে এলেন, পেশ না করে তাকে সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠাতে বাধ্য হলেন আর সেখানে ওনাদের শরিক দলের তরফেই প্রবল বিরোধিতা শুনতে হল।
ওদিকে অর্থনীতি তো গড়ের মাঠে ঘাস খেতে গেছে, জিডিপি ওঠার বদলে নামছে, উনি দেশে বিদেশে ৫ বিলিয়ন ইকোনমির কথা বলছিলেন সেটাও যে ফাঁপা বেলুন তা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। বেকারত্ব গত ৫০ বছরের মধ্যে এই জায়গাতে যায়নি, এটাও এক রেকর্ড। টাকার দাম পড়ছে, শেয়ার বাজার টলমল করছে আর ফরেন ইনভেস্টররা টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে, বাজার পড়ছে। আর এক দিকে দলের সেই তীব্র হিন্দুত্ববাদীরা আজ এখানে তো কাল সেখানে মুসলমান পেটাচ্ছেন, মসজিদ দেখলেই খুঁড়ে দেখানোর দাবি জানাচ্ছেন, সংখ্যালঘুরা বিপন্ন, দেশের মধ্যের আওয়াজ নয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বৈঠকে বলা হচ্ছে। আর ফরেন পলিসি, পড়শি দেশগুলোর দিকে তাকান বুঝতে পারবেন, তীব্র ভারত বিরোধিতা আমাদের পড়শি দেশের মানুষজনদের মধ্যে, আমাদের পাসপোর্ট আরও কিছুটা নেমেছে। ২০২৪-এ ৮০তে নেমেছিল, এখন তা ৮৫তে নেমে গেছে। তাহলে ২০১৪-তে যে আচ্ছে দিন আনার কথা বলা হয়েছিল সেই আচ্ছে দিন কোথায়? তার বদলে এই ১১ বছরে দেশ ক্রমশ সমস্ত ক্ষেত্রে নেমেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য তো এক সাংঘাতিক জায়গাতে এনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের যেখানে যাই করা হোক না কেন, যে অবস্থাই থাক না কেন, দেশের গোটা ৫-৭ পরিবার ছাড়া সবাই ক্ষতির মুখ দেখছেন। তাহলে সেই সরকার টিকে আছে কেন? এই প্রশ্ন তো জায়জ, একটা সরকার যার ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, সেই কিল মারার গোঁসাইকে দেশের লোক রেখে দিয়েছে কেন? কারণ বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে হাজার রকমের খেয়োখেয়ি আর সবথেকে বড় বিরোধী দলের নির্বুদ্ধিতা, তাদের নিষ্ক্রিয়তা।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | জ্ঞান নয়, বুদ্ধি নয়, চেতনা নয়, মোদিজির একমাত্র অস্ত্র ধর্ম
আমরা দেখেছিলাম বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়া জোটের পরে রীতিমতো টেনশনে পড়ে গিয়েছিল বিজেপি, কেবল ইন্ডিয়া জোটের বিভিন্ন নেতাদের এক জায়গাতে বসাটাই বিজেপির কাছে বড় ধাক্কা ছিল। আর আজ? কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী সাফ বলে দিলেন, ইন্ডিয়া জোট এইভাবে চালানোর চেয়ে ভেঙে দেওয়া ভালো। ঠিকই বলেছেন, কার্যকারিতা না থাকলে, জোটধর্ম পালন না করলে সেই জোট ভেঙেই দেওয়া উচিত। ওই কর্নাটকের জয়ের পরেই কংগ্রেসের মনে হয়েছিল, রাহুল গান্ধীর মনে হয়েছিল, তাঁদের হাতেই চলে এসেছে দেশের রাজ্যপাট। তারপরে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা হেরেছেন, বিরাটভাবেই হেরেছেন, কিন্তু দেখুন সেই হারের কোনও পর্যালোচনা নেই। এক জলসাঘরের জমিদারের মতো চালাচ্ছেন দল এবং এই অ্যালায়েন্সকে। হরিয়ানাতে আপ-এর সঙ্গে জোট থাকলে জিতে যেত এমন কথা বলছি না কিন্তু এত বড় হারের মুখোমুখি হতে হত না আর দেশজুড়ে এক বিরোধী ঐক্য থাকত, সেখানে আপ-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল কংগ্রেস, এবারে দিল্লিতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দিল্লিতে গতবারে ৭০টা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৮টা আসন আপ ৬২টা আসন ৫৩ শতাংশ ভোট, কংগ্রেসের ছিল ৪ শতাংশের একটু বেশি ভোট। লোকসভাতে আপ-এর সঙ্গে জোট বেঁধেও ১৯ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস, এবারে তারা জোটের ধারেকাছেও গেল না। শুরু থেকেই তাদের দিল্লির নেতারা কুৎসিত ভাষায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আক্রমণ করতে থাকলেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিষয়টাকে ইন্ডিয়ার মঞ্চে আলোচনা করতে পারতেন তিনিও সাফ জানিয়ে দিলেন যে আমরা একলাই লড়ব, সবকটা আসনে প্রার্থীও দিয়ে দিলেন।
তৃণমূল দল, সমাজবাদী পার্টি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা দল জানিয়েই দিলেন তাঁরা সমর্থন করছেন আপকে, কেজরিওয়াল তাঁদের ধন্যবাদ দিলেন। এবং ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লা বললেন, এটাই যদি বাস্তব পরিস্থিতি হয় তাহলে ইন্ডিয়া জোট ভেঙে দেওয়া উচিত। মজার কথা হল এই কথা বলার পরে বিহারের তেজস্বী যাদব জানালেন ইন্ডিয়া জোট তো লোকসভা ভোটের জন্য হয়েছিল। উনি কংগ্রেসকে চটাতে চান না, কারণ বিহারে কংগ্রেসের যে সামান্য ভোট আছে তা ওনার বড্ড জরুরি, ওখানে মহাগঠবন্ধনে কংগ্রেস আছে। ওদিকে এই আরজেডি থেকে আপ থেকে সমাজবাদী দল বা উদ্ধব ঠাকরের দল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই জোটের মাথায় দেখতে চান। ওদিকে এই জোটের অন্যতম শরিক সিপিএম মনে করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল দল আসলে বিজেপির বি টিম, তারা এক্কেবারে অফিসিয়ালি এই বাংলাতে বিজেপি আর তৃণমূলকে সমান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেই নির্বাচনে নামেম প্রচার চালায়। ওদিকে কেরালাতে মুখোমুখি লড়ে যাচ্ছে কংগ্রেস আর সিপিএম। দু’ দলের নেতা প্রকাশ্যেই দু’ দলকে বিজেপির বি টিম বলে বিবৃতি দেন, সেটা প্রকাশ্যেই, জনসভাতেও মানুষকে বলেন যে ওদেরকে ভোট দিলে আসলে বিজেপির লাভ হবে কাজেই আমাদের ভোট দিন। মানে সারা ভারতে বিজেপি তাদের শক্তিকে সংহত করেছে, তাদের শক্তিকে বাড়াচ্ছে, কেরালাতে তারা সামনের বিধানসভাতেই ভালো ফল পেতেই পারে, এখনই তারা প্রায় ১৬ শতাংশের কাছাকাছি, তারা ২০২৪-এ ভোট বাড়িয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। এবং প্রতিটা নির্বাচনে তারা বাড়ছে, ওদিকে কংগ্রেস সিপিএম কাজিয়া চলছে, তারা আর তিন চার শতাংশ ভোট বাড়াতে পারলে বিধানসভাতে তাদের জোর দেখাতে পারবে, ইন ফ্যাক্ট দক্ষিণে তাদের কর্নাটকের পরে কেরালাই হতে পারে সেই রাজ্য যেখানে তারা ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। ওড়িশাতে কংগ্রেস বিজেডির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করে তোলার জায়গাতে নেই, বাংলাতে অধীরকে সরিয়ে কেবল শুভঙ্করকে বসানো হয়েছে মাত্র।
আমাদের দেশের বিরোধীদের দুটো ফ্রন্ট-এর লড়াই আছে, এক হল আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে বিজেপির লড়াই, সেখানে তারা অনেকটাই সফল আর তাদের লড়াই আরও তীব্র হচ্ছে, বিজেপির ইডি সিবিআই আক্রমণের মুখে দাড়িয়েও সাতলিন থেকে অখিলেশ, মমতা থেকে তেজস্বী, উদ্ধব বা শরদ পওয়ার লড়ে যাচ্ছেন। অন্য ফ্রন্টটা হল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির লড়াই। সেই লড়াইয়ে বিজেপি ১০০ মাইল এগিয়ে, তার কারণ হল কংগ্রেসের ফেলে আসা ইতিহাস, জরুরি অবস্থা, বংশানুক্রমিক শাসন, আর নরেন্দ্র মোদি বা আরএসএস বিজেপি চায়ও সেটা। আগে কংগ্রেসকে শেষ করে দাও, তারপর আঞ্চলিক দলের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে। এখনও যে দলের ২০ শতাংশ ভোট আছে তাদের ছাড়া কোনও বিরোধী জোট হওয়া সম্ভব নয়, আবার আঞ্চলিক দলগুলোকে মর্যাদা না দিয়ে বিজেপি বিরোধী জোট হওয়াটাও অসম্ভব। ঠিক এই জায়গাটাতেই উল্লসিত বিজেপি নেতৃত্ব। এই সেদিনেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন ইন্ডি জোট আর কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আরএসএস-বিজেপির ১১ বছরের শাসন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়নি, অর্থনীতির হাল বেহাল, তাদের আমলে বেকারত্ব রেকর্ড ছুঁয়েছে, টাকার দাম পড়ছে, শেয়ার বাজার টলমল করছে, সংসদে আইন এনে লাগু করতে পারছে না সরকার, চারিদিকে তীব্র হিন্দুত্বের স্লোগান দেশকে সমাজকে ভাঙছে কিন্তু এত কিছুর পরেও তারা টিকে রয়েছে কেবল নয়, নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে কারণ বিরোধীরা ছিন্নভিন্ন। তারা নিজেদের নিজেদের স্বার্থ নিয়েই পড়ে আছে, অন্য কিছু ভাবার সময় কই আর সেই জায়গাতে যাঁরা ভেবেছিলেন গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে, তারা হতাশ, কংগ্রেস হেডলেস চিকেনের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছটফট করছে, বামপন্থীরা জনবিচ্ছিন্ন, আর আঞ্চলিকদলগুলো তাদের নিজেদের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ।