ক’দিন আগেই এক কবিতা সম্মেলনের রেকর্ডিং দেখছিলাম, কবি মজা করেই বলছিলে যাহা খোদা, ওহি ভগবান মিলা, কহিভি খোদা, তো ভগবান হি মিলা, মসজিদ খোদা তো ভি ভগবান হি নিকলা…। হিন্দি খোদা শব্দের অর্থ গর্ত খোঁড়া, আবার খোদা মানে আল্লাহ, সর্বশক্তিমান, ইসলামে বিশ্বাসীরা সেটাই মনে করেন। হ্যাঁ, খানিকটা সেরকমই অবস্থা আমাদের, মসজিদ দেখলেই খোঁড়া হচ্ছে আর দাবি করা হচ্ছে তার তলায় মন্দির আছে। আসলে দেশ জুড়ে নতুন করে এক উন্মাদনা তৈরি করার এক চেষ্টা শুরু হয়েছে। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েও দেশের হিন্দু মানুষজনদের খুব বেশি হলে ৫০ শতাংশ ভোটও পাচ্ছে না বিজেপি, এটা স্পষ্ট যে দেশের হিন্দু মানুষজন বিজেপির হিন্দুত্বে বিশ্বাস করেন না। তাই সেই হিন্দুত্বকে আরও চাগিয়ে তোলার জন্য, অযোধ্যার পরে কাশী মথুরা তো ছিলই এখন সেই তালিকাতে আরও নতুন নতুন নাম জোড়া হচ্ছে। শাহজাহানের তৈরি তাজমহল যা নাকি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটা সেটাও নাকি আসলে তেজো মহল, শির ফুলিয়ে গলা ফাটিয়ে এই কথা প্রচার করা হচ্ছে, সম্ভলের ঘটনা তো জেনেই গেছেন, ৫ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তালিকাতে নতুন সংযোজন আজমের শরিফ। আজ নয় সেই কোন কাল থেকে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই আজমের শরিফের দরগাতে চাদর দিতে যান, সেটাও নাকি আদতে শিব মন্দির।
এই নিয়ে বাওয়াল শুরু হয়ে গেছে, তার মধ্যেই জানা গেল প্রধানমন্ত্রী নাকি আজমের শরিফে চাদর পাঠিয়েছেন আমাদের কিরেন রিজিজুর হাত দিয়ে, উনি গঙ্গায় ডুব নিজে দেবেন, কন্যাকুমারিকাতে ধ্যান নিজে করবেন, হিমালয়ের গুহাতে সমাধিতে বসবেন নিজে, রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠাতে নিজেই থাকবেন, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ এই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী আজমের শরিফে চাদর পাঠাবেন পিওনের হাত দিয়ে। কিন্তু পাঠাচ্ছেন তো? তো এই নাটকটা কেন? উনি সম্ভলের পাঁচ জন মারা যাবার ঘটনায় একটা কথাও বলেছেন? বলেননি। তাহলে এই নাটকটা কেন? আরও কদিন আগে দেশের প্রধানমন্ত্রীর গলায় হঠাৎই আরও এক অন্য সুর শোনা গিয়েছিল, তিনি যিশুখ্রিস্টের কথা বলেছিলেন, শান্তি, অহিংসা, সহিষ্ণুতার কথা বলেছিলেন। আসলে ধর্ম আরএসএস বিজেপির এক অস্ত্র, তারা সেটাকেই বারবার ব্যবহার করছে, করার চেষ্টা করছে। হিন্দু মানুষজনের অনেকেই ঋক, সাম, যজু, অথর্ব বেদ, ১০৮টা উপনিষদ ইত্যাদি না পড়লেও রামায়ণ পড়েছেন, মহাভারত পড়েছেন। যদি পড়ে নাও থাকেন, দেখেছেন তো? খেয়াল করে দেখুন তো, কোথাও মন্দির পেয়েছেন? মানে রাম সীতা মন্দিরে যাচ্ছেন, ১৪ বছরের বনবাসে, কোথাও পেয়েছেন। রামায়ণের সপ্তকাণ্ডে অযোধ্যার বর্ণনা আছে বহু জায়গায়, সেখানে কোথাও মন্দির আছে? নেই। মহাভারতে? কোথাও? পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে হস্তিনাপুরের নতুন প্রাসাদ, রাজসভার, বিবরণ আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের, কোথাও মন্দির নেই। যাকে তথাকথিত সনাতন ধর্ম বলা হয়, সেখানে মন্দির নেই, ছিল না। কোনও দেবতার মন্দিরের কোনও উল্লেখ না আছে বেদে, না আছে কোনও উপনিষদে না আছে প্রাচীন পুরাণে। তাহলে পুজোটা কোথায় হত? বা পুজো কি আদৌ হত? পুজোর দায়িত্ব ছিল ঋষি মুনিদের হাতে, তাঁরা স্থান নির্বাচন করতেন। এবং পুজো বলে তো কিছু ছিল না। সাধারণ মানুষের হয়ে গোষ্ঠীপতি, রাজা কিছু কামনা করতেন, নিজের জন্যও করতেন। কী ধরনের কামনা? পুত্রসন্তানের কামনা, ভাল শস্যের কামনা, মারি বা মড়ক থেকে উদ্ধার পাওয়ার কামনা, অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে বাঁচার কামনা, শত্রু জয়ের কামনা, ভালো বৃষ্টির কামনা।
এইসব কামনার কথা নির্দিষ্ট দেবতার কাছে পৌঁছে দিতেই পুজো হত, যাকে পুজো না বলে যজ্ঞ বলাই ভালো। স্থান এবং দিক নির্বাচন করা হত কামনা অনুযায়ী। কারণ দশ দিকে আছেন দশ দেবতা, পূব দিকে গ্রহ হল সূর্য, মানে তখন সূর্যকে গ্রহই বলা হত, আর পূর্ব দিকের দেবতা হলেন ইন্দ্র। উত্তর আর পূর্ব দিকের মাঝখানকে বলা হয় ঈশান কোণ যেখানে থাকেন মহাদেব আর গ্রহ বৃহস্পতি। উত্তর আর পশ্চিমের মাঝখানে বায়ব্য কোণ, বুঝতেই পারছেন বায়ু দেবতা, আর গ্রহ সেই সূর্য। পশ্চিম দিকের গ্রহ শনি আর দেবতা বরুণ। উত্তর দিকে দেবতা কুবের আর গ্রহ বুধ। দক্ষিণ আর পূর্ব দিকের মধ্যস্থান হল অগ্নিকোণ। দেবতা অগ্নি আর গ্রহ শুক্র। দক্ষিণ দিকের দেবতা যম, ওই যে যমের দক্ষিণ দুয়োর, আর গ্রহ মঙ্গল। এসবের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু এত কথা বলা কারণ মন্দির ছিল না সনাতন ধর্মে, ছিল যজ্ঞ, যজ্ঞবেদি তৈরি হত যজ্ঞের প্রকারভেদে। বহু পরে সেই সনাতন ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৈরি হয়েছে, বৈদিক দেবতাদের সঙ্গে জুড়ে গেছে লোকায়ত রীতি আর তাদের দেবতারা, মনসা থেকে টুসু, ভাদু থেকে শনি, এমনকী শিবের আড়ালে পশুপতি। কিন্তু তখনও ছিল না নিত্যপুজো, ছিল বেদ পাঠ, ছিল সাম গান।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির থেকে বড় অনাথ এদেশে আর নেই
এরপর গোষ্ঠীপতিরা রাজা হলেন, রাজা হলেন মহারাজা। তাঁদের পূজ্য দেবতারাই রাজ্যের দেবতা, রাজ্যের মানুষের পূজ্য দেবতা। রাজা বৈষ্ণব, কাজেই শাক্ত বা শৈবদের হয় মত বদলাতে হয়েছে, মেনে নিতে হয়েছে বৈষ্ণব রীতিনীতি, না হলে দেশ ছাড়তে হয়েছে, জেলে পচে মরতে হয়েছে, শূলে চড়ানো হয়েছে। আবার শৈব রাজা এসে ধ্বংস করেছে বৈষ্ণব আখড়া তেমন উদাহরণও আছে, শৈব রাজা বৌদ্ধ মঠ, জৈন মঠ ভেঙে চুরমার করেছেন, এবং এসব হয়েছে মোগল, তাতার, শক হুনদের আসার অনেক আগেই। এই রাজারাই মন্দির তৈরি করলেন, সেই মন্দিরের গায়ে লেখা হল রাজার কীর্তি, পাথর খুদে বানানো হল ভাস্কর্য, যা সেই রাজার মহান কীর্তিকে তুলে ধরবে পুজো দিতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে। সেখানেই জমা হবে অতুল সম্পদ, সে সম্পদের অছি পুরোহিত ব্রাহ্মণরা শুরু করলেন নিত্যপুজো। সনাতন ধর্ম সিন্ধু নদী অববাহিকার নীচের ভূমিতে জন্ম দিল কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা, জন্ম দিল প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের। দক্ষিণের রাজারা পাথর কেটে মন্দির বানানোয় উৎসাহ দিলেন, দাক্ষিণাত্য জুড়ে সেই মন্দিরগুলো আসলে চালুক্য, গঙ্গা, পল্লব, চোল রাজাদের রাজনৈতিক কেন্দ্র, সেখানেই তাদের বীরত্ব আর শৌর্যের গাথা, যে যখন ক্ষমতায় এসেছে, সে তখন অন্যেরটা ভেঙে নিজের জয়গাথা লিখিয়েছে। উত্তরে তখনও কাঠ আর মাটি, কাজেই মন্দির নির্মাণ হলেও তা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু সেই চালুক্যরা যখন হর্ষবর্ধনকে হারিয়ে উত্তর ভারতেও এলেন, তখন তাদের আনা কারিগরেরাই তৈরি করল উত্তর ভারতের বিভিন্ন মন্দির, আজ যে কেদারনাথের মন্দিরে আমরা যাই, সে মন্দিরের মূখ্য পূজারী কর্নাটকের ভিরশৈভা কমিউনিটির, মন্দিরের গঠন দক্ষিণের রীতি মেনেই তৈরি, যজ্ঞেশ্বর বা বাগেশ্বরেও শিব মন্দির, তাও ওই একই ধারায় তৈরি। এরপর থেকে উত্তর ভারতেও মন্দির তৈরি শুরু হয়, আকারে খানিক বদলও আসে।
প্রতিহার বংশের রাজারা সোমেস্বর নামের এক জায়গায় তীর্থক্ষেত্রে দানধ্যান করতেন, চালুক্যরা দাক্ষিণাত্য থেকে এসে সেই প্রতিহারদের হারায়, ওই সোমেস্বরেই তৈরি করে সোমনাথ মন্দির, আবার সেই বীরগাথা এবং এক বিশাল ধনসম্ভার। বার বার সেই মন্দির ভাঙা হয়েছে, লুঠ হয়েছে ধনরত্ন, মহম্মদ গজনির সময়ে একবার নয় বেশ কয়েকবার এই লুঠপাট চলে। মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ধ্বংসের এক আঁকা ছবি পাওয়া যায়, যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মন্দির ছিল দাক্ষিণাত্যের মন্দিরের মতোই। কিন্তু সেই ধ্বংসের উপর স্বাধীনতার পরে বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগে নতুন মন্দির তৈরি হয়, সেই সময় একটা বিতর্ক হয়, মন্দির কি রাষ্ট্রের পয়সায় হবে? গান্ধীজি আপত্তি করেন, মন্দিরের জন্য টাকা আসে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে, মন্দির তৈরি হয়, একেবারেই উত্তর ভারতীয় ধাঁচের, সে মন্দির তৈরির উদ্যোগে ছিলেন সেই সময়ে নেহরু মন্ত্রিসভার খাদ্য ও খাদ্য সরবরাহ দফতরের মন্ত্রী কে এম মুনশি, বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং মহাত্মা গান্ধী। প্যাটেল গান্ধী দুজনেই মারা যান, মন্দির উদ্বোধনে আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ। এ নিয়ে নেহরুর আপত্তি ছিল, কিন্তু রাজেন্দ্র প্রসাদ বা কে এম মুনসি তাঁর আপত্তি শোনেননি। অর্থাৎ এখানেও দেখুন মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে থাকে রাজনীতি। আওরঙ্গজেবের ইতিহাস বলছে তিনি কামাখ্যা মন্দিরের জমি দান করেছিলেন, মন্দির নির্মাণের খরচ জুগিয়েছিলেন, কেন? আওরঙ্গজেব সেকুলার ছিলে বলে? আসলে তাঁর সময়ে এক বিরাট প্রতিরোধ আসতে শুরু করেছিল ওই উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে, অসম থেকে, তিনি সেই বিদ্রোহ দমন করেন, তারপরেই সাহায্যকারী ব্রাহ্মণ মন্ত্রণাদাতাদের খুশি করার জন্যই এই দান করেছিলেন, সেটাও ছিল মন্দিরের রাজনীতি, কখনও মন্দির ভেঙে রাজনীতি, কখনও মন্দির গড়ে রাজনীতি।
ইংরেজরা এসেছে, শুরুর দিকে নয়, কিন্তু ১৯০০-র গোড়া থেকেই ইংরেজ শাসকরাও এই ধর্ম আর উপাসনালয়কে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে, ১৯০৫-এ বাংলা ভাগের ঘোষণা ছিল সেই রাজনীতিরই অঙ্গ। দেশ স্বাধীন হল, এরপর যতদিন গেছে তত বেশি করে মন্দিরের রাজনীতি সামনে ফিরে এসেছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছিল অজস্র, যেমন মঠ ভেঙে মন্দির হয়েছিল, মসজিদ ভেঙেও মন্দির হয়েছিল, কিন্তু আগে সে সবই তো ছিল রাজা, নবাব, সম্রাট, সুলতানের রাজনীতি, মন্দিরকে তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে, তাঁদের বীরগাথার বিজ্ঞাপন করতে। আজ আরএসএস–বিজেপির রাজনীতির ভিত্তিই হল ওই মন্দির এবং তাদের হিন্দু ধর্ম। কেন তাদের বলছি? কারণ হিন্দু ধর্মের এমন স্বরূপ তো ছিল না, সিন্ধু অববাহিকার মানুষদের হিন্দু বলা হত, সেটা মানুষের ধর্ম ছিল না, সেখানে ভগবানও একজন ছিলেন না, ধর্মের রীতিনীতিও এক ছিল না, হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য প্রতিবাদী ধর্ম, যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না, তাঁরাও ছিলেন, যারা অজ্ঞেয়বাদী, অ্যাগনস্টিক, তাঁরাও ছিলেন, এক ধর্মের মানুষদের অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে লড়াই ধর্ম নিয়ে তো হয়নি, তাদের শাসকদের মধ্যের ললড়াইয়ে তাদের উলুখাগড়া হতে হয়েছে। আজ আরএসএস–বিজেপির জমানায় ঠিক সেই কাজই হয়ে চলেছে, ২০২৪-এর নির্বাচন যুদ্ধে জেতার জন্য মন্দিরের রাজনীতিকেই হাতিয়ার করেছেন তাঁরা। একই ছবি কর্নাটকের ভোটেও দেখেছিলাম, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন কর্নাটকে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য নির্ধারিত সংরক্ষণ তুলে তা লিঙ্গায়েতদের বা ভোক্কালিগাদের দেওয়া হবে। এতদিন যে ৪ শতাংশ সংরক্ষণের ভাগিদার ছিলেন ওই পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের একাংশ, সেই সংরক্ষণের ৪ শতাংশ ভাগ করে দেওয়া হচ্ছিল লিঙ্গায়েত বা ভোক্কালিগাদের মধ্যে। লক্ষ্য সেই ধর্মের মেরুকরণ। আসলে এই ধর্ম আর মন্দিরের ইস্যু কেড়ে নিলে আরএসএস–বিজেপির হাতে পেনসিলও পড়ে থাকবে না। সেদিন মধ্যযুগে রাজারাজড়ারা যে মন্দির রাজনীতির সূত্রপাত করেছিলেন, আজ দেশকে সেই অন্ধকারেই ঠেলে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে রুখতে হবে, ধর্ম হয়ে উঠুক এক ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ব্যক্তিগত জীবনাচরণ, তা যদি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, তাহলে জানবেন, তা ধর্ম নয়, তা অন্যায়, তা পাপ।