একটা দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় থেকে উঠে আসে পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব, তাঁরা তাঁদের পূর্বসূরিদের নিয়ে চর্চা করেন, তাঁদের আদর্শকে সামনে রাখেন, তাঁদের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন, এটাই এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলে। ধরুন কংগ্রেসের রাজনৈতিক ঐতিহ্য, সেই ১৮৮৫-তে তৈরি হওয়া একটা দল, তাদের অজস্র নেতা, এক বিরাট স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাসে স্ববিরোধিতা আছে, সে ইতিহাসকে নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। কিন্তু এক বিরাট ইতিহাস আছে। দেশ স্বাধীন হল, তারপরেও বিরাট ইতিহাস, দেশের প্রথম শিল্পায়নের ইতিহাস, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চিকিৎসা মহাকাশ গবেষণার কেন্দ্র গড়ে তোলার ইতিহাস। চার চারটে যুদ্ধের ইতিহাস, চীন-ভারত যুদ্ধে হার কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তিনটে যুদ্ধে বিরাট জয়। সেই বিজয়ের ইতিহাস আছে। আবার এমার্জেন্সির কালো ইতিহাসও আছে। কিন্তু সবমিলিয়ে আলোচনা করতে গেলে জাতীয় কংগ্রেস এক দল যার দেশের স্বাধীনতা, দেশ গঠনে এক বিরাট ভূমিকার কথা প্রত্যেকেই স্বীকার করবে। অন্যদিকে ধরুন সমাজতন্ত্রীরা, কমিউনিস্টরা, তাঁদেরও লড়াই আছে, আলাদা লড়েছেন কিন্তু স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন, ব্রিটিশদের জেলে গেছেন, ফাঁসিতে চড়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাঁদের নেতারা আছেন, সেসব নেতাদের প্রজ্ঞা বা কাজ নিয়ে মানুষজনের শ্রদ্ধা আছে। অমন যে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় আমাদের দেশের, সেই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তো জয়প্রকাশ নারায়ণ, এক সমাজতন্ত্রী গান্ধীবাদী নেতা। এই বিশাল স্প্রেকটাম, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী আর কমিউনিস্টদের মধ্যে এক পরিষ্কার ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ছিল, যা দেশের সংখ্যালঘু মানুষজনকে আশ্বস্ত করেছে বারবার। দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়নি তা তো নয়, কিন্তু পাশে দাঁড়ানোর মানুষ ছিল। কাজেই কংগ্রেসের আজকের নেতারাও সেই নেতাদের উদাহরণ দিতে পারেন, দলের ইতিহাসকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন।
কিন্তু সমস্যা হল নরেন্দ্র মোদির, উনি বা ওনার দলের সেই ইতিহাস নেই যা তুলে ধরা যায়, যে ইতিহাস আছে তা লজ্জাজনক, তা বিশ্বাসঘাতকতার, তা তুলে ধরতে গেলেই আধুনিক ভারতের প্রতিটা স্তরে তাঁদের কদর্য ছবিটা সামনে এসে পড়ে। এক্কেবারে শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ওনারা বলেন জিন্নাহ পাকিস্তান চেয়েছিলেন, জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলে সাফ জানিয়েছিলেন মুসলমানদের পাকিস্তান চাই, হিন্দুদের জন্য থাক হিন্দুস্থান। সমস্যা হল জিন্নাহ সাহেব এসব কথা বলার বহু আগেই সাভারকর তাঁর বইয়ে এই দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা লিখে ফেলেছেন, সাফ জানিয়েই দিয়েছেন যে হিন্দু মুসলমানের একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়, তিনি গান্ধীজির বিরোধিতা করে বলেছিলেন উনি আসলে মুসলমানদের তোষণ করছেন। সেদিন ওই হিন্দু মহাসভা আর আরএসএস-এর তরফে তীব্র গান্ধীঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল যার সরাসরি ফল গান্ধী-হত্যা। কিন্তু আমাদের মহামতি নরেন্দ্র মোদির দুর্দশাটা একবার কল্পনা করুন। তিনি গান্ধীঘাটে গিয়ে ফুলমালা দেবেন, চরকা কাটবেন আবার সাভারকরকে গুরু বলে পুজোও করবেন, যাঁরা গান্ধী হত্যাকারী গডসেকে পুজো করেন তাদের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে রাজনীতি করবেন। ছেড়েই দিন গান্ধীর কথা, বল্লভভাই প্যাটেল, মাঝেমধ্যেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব না পাওয়া নিয়ে আমাদের চৌকিদার অনেক কথা বলেন কিন্তু তাঁর মাথায় থাকে যে এই বল্লভভাই প্যাটেল গান্ধী-হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগেই সাভারকরকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, আরএসএস হিন্দু মহাসভার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, তাঁর নিজের ভাষায় এক সাম্প্রদায়িক উন্মাদ চিন্তাভাবনা গান্ধীজিকে কেড়ে নিল আমাদের কাছ থেকে। প্যাটেল আর গান্ধী একসঙ্গে পুজো তো করাই যায়, কিন্তু প্যাটেলও ভারতরত্ন আর সাভারকরও ভারতরত্ন এই স্ববিরোধিতায় ভুগতে থাকা মোদিজি মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে তখন যখন বিভিন্ন দলের নেতারা, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম নিতে থাকেন, এমনকী সাধারণ মানুষ গান্ধীজি, নেতাজি, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিংয়ের নাম নিতে থাকেন তখন বেচারা আমাদের প্রধানমন্ত্রী বসে ভাবেন কার নাম নেওয়া যায়?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চিন্ময় মহারাজের জেল নিয়ে কেঁদে আকুল না হয়ে একটু ভারতবর্ষের জেলের দিকে তাকানো যাক?
কংগ্রেস্র নেতারা আগের প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী দলের নেতাদের নাম নিয়ে থাকেন অনায়াসে, আমাদের মোদিজির পক্ষে সেটাও সম্ভব নয়, তিনি অটলবিহারীর নাম নিতে গেলেই মনে পড়ে যায় সেই গুজরাট দাঙ্গার কথা যখন এই অটলজি ওনাকে রাজধর্ম পালন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজও তিনি সেই কথা মাথায় রেখেছেন, তিনি তাঁর দেশের একপ্রান্ত জ্বলছে, সেই মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারছেন না, রাজধর্ম পালন করার কথাও বলতে পারছেন না কারণ তাঁর মাথায় রয়েছে সেই কথা, “রাজধরম পালন করো।” উনি নিজেকে এতই ভালোবাসেন যে তাঁর পূর্বসূরি অটলবিহারি বাজপেয়ী যে দেশের জন্য কিছু করেছিলেন তা বলতে ওনার কষ্ট হয়, প্রতিটি বক্তৃতায় মনে করিয়ে দেন যে ২০১৪-র আগে দেশে তো কোনও কাজই হয়নি, ওনার মুদ্রাদোষ এখন এটাই যে হম আনে কে বাদ মুঝে লগা…। মানে উনি আসার পরে ওনার মনে হয়েছে যে ভারতবর্ষ পিছিয়ে পড়েছিল উনিই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু উনি এতটাই অনাথ যে ওনার দলের একজনকেও, ওনার আদর্শের একজনকেও উনি উদাহরণ হিসেবে সামনে রাখতে পারেন না। কিছুদিন আগে মনমোহন সিংহ মারা গেলেন, যে মনমোহন সিংহকে উনি বোবা প্রধানমন্ত্রী, নিকম্মা প্রধানমন্ত্রী বলতে ছাড়েননি, তাঁকে মানে সেই মনমোহন সিংকে কংগ্রেস দল অপমান করেছে পদে পদে আর তা নাকি ওনাকে কষ্ট দিত, মিডিয়াকে এই কথা জানালেন। কিন্তু একটা ইন্টারভিউতে এই কথা বলা আর সেই মানুষটাকে নিজের আদর্শ হিসেবে সামনে রাখা তো এক নয়, সম্ভবও নয় কারণ এই মানুষটাই হুইল চেয়ারে বসে সংসদে এসেছিলেন তাঁর বিরোধিতা করার জন্য। এখন মাঝেমধ্যেই বলেন প্রণবদা, মানে প্রণব মুখার্জিকে নাকি কংগ্রেস জায়গা দেয়নি, তাঁর কন্যাকে ডেকে রাজনীতি করছেন, তাঁর কন্যা বেঁচে থাকতে রাজনীতির প্রথম পাঠেও সফল নন, মমতা সোনিয়া করে আখের গোছাতে না পেরে এখন নতুন রাস্তায় চলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাথায় রাখুন এই প্রণব মুখার্জির সাহায্য ছাড়া ইউপিএ-১ বা ইউপিএ-২ হত না, বিজেপিকে আটকানোর জন্য ওনার চাণক্যসুলভ চালগুলোর কথা মানুষ মনে রাখবে। সেই প্রণবদাকে নাকি কংগ্রেস অপমান করেছে, যে দল প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি করল, তারা নাকি প্রণবদাকে দলে জায়গা দেয়নি, কে বলছেন? আমাদের নরেন্দ্র মোদি।
আসলে সমস্যা হল উনি অনাথ, ওনার মতো অনাথ এর আগে কেউ ছিল না। অটল বিহারী বাজপেয়ী জানতেন তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা, তিনি জওহরলাল থেকে গান্ধী, প্যাটেল থেকে সুভাষ বোস, দেশের এর আগের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীকে সন্মান জানিয়েছেন, তিনি নিজেও যে সরকার চালাতেন তার মধ্যেই ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ, নীতীশ কুমার, শারদ যাদব মমতা ব্যানার্জির মতো অবিজেপি বেশ কিছু নেতা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সমস্যা আলাদা, উনি সমষ্টিতে বিশ্বাস করেন না, যাঁদের বিশ্বাস করেন তাঁদের সামনে তুলে ধরতে পারেন না, ওনার কোনও ইতহাস নেই, আত্মপরিচয়হীন এক অনাথ মানুষ যিনি প্রতি পদে আমি আমি এবং আমি ছাড়া কিছুই বোঝেন না। যার ফলে দেশের জন্য ৮ বছরেরও বেশি জেলে থাকা জওহরলাল নেহরুকে তিনি দেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করেন, তাঁর আদত সংগঠন, আরএসএস সংবিধান সভাতে যোগ দেয়নি, সংবিধানকে মেনে নেয়নি, সংবিধান ড্রাফটিং কমিটির চেয়ারম্যান তাঁদের কাছে ছিল এক দলিত মাত্র, যাঁর অধিকার নেই হিন্দু কোড নিয়ে কথা বলার, ঠিক এই ভাষায় তাঁরা সেদিন আক্রমণ করেছিলেন বি আর আম্বেদকরকে। এখন তাঁকে আঁকড়ে ধরে নতুন প্রচারে নেমেই বুঝতে পেরেছেন যে সেমসাইড গোল হয়ে যাবে, সেদিন যখন সংবিধান সভা তৈরি হচ্ছিল তার মাথায় ওই সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আম্বেদকরকে বসিয়েছিল কে? কংগ্রেস দল ইচ্ছে করলেই সেখানে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বা সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বা কৈলাসনাথ কাটজুকে বসানোর কথা বলতেই পারতেন, ইন ফ্যাক্ট তেমন কথা উঠেও ছিল, কিন্তু দেশের দলিত মানুষজন, পিছিয়ে পড়া মানুষজনের প্রতিনিধি হিসেবেই খুব সচেতনভাবে গান্ধীজির পরামর্শে তাঁকে ড্রাফটিং কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। সেদিন যাঁরা এই সংবিধানকে মানতে অস্বীকার করেছিলেন সেই সংঘ প্রচারক নরেন্দ্র মোদি আজ আম্বেদকরের কথা বলছেন, কিন্তু তিনি নিজেও জানেন তা কতটা বেমানান। তিনি সাভারকরের কথা অনর্গল বলতে চান, কিন্তু গান্ধী হত্যাকারী সাভারকরের কথা বলতে পারেন না, বরং সারাটা জীবন ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে যাওয়া গান্ধীজির জন্মদিন আর মৃত্যুদিনে নিয়মমাফিক রাজঘাটে হাজিরা দিতে হয় তাঁকে এর থেকে দুর্ভাগা আর কেই বা হবেন। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী সত্যিই অনাথ, আক্ষরিক ও সার্বিক অর্থেই তিনি বড্ড একলা।