২০২৪ নির্বাচন বিজেপির সঙ্গে লড়াইয়ের প্রথম শর্তটা জানিয়ে দিল। বিজেপির সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়তে হবে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়তে হবে। বিজেপি একটা দল যার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার কথা যাঁরা ভাবেন তাঁরা ভুল করেন, তাঁরা ক্রমশ শেষ হয়ে যান। ২০১৪ থেকে ২০১৯, ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দুটো বড় দল যাঁদের লোকসভায় রাজ্যসভায় বেশ কিছু সদস্য ছিল তাদের দিকে তাকান। বিজু জনতা দল, এমন নয় যে তারা রাজ্য বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে লড়েনি, কিন্তু তা ছিল ওই নির্বাচনের সময়ে মাত্র, তারপর তুমি কেন্দ্রে যা করার করো, আমি রাজ্যে যা করার করে যাব, এরকমই একটা বোঝাপড়া ছিল। সেই বিজেডি আপাতত হেরেছে, বিরাট হার, লোকসভাতে শূন্য এবং আগামী দিনে দল বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? না, সম্ভাবনা খুব কম। অন্যদিকে ওয়াই এস আর রেড্ডির ছেলে জগন রেড্ডি, ওয়াই এস আর কংগ্রেস, আমার সিবিআই কেস বা ইডি মামলা ওসব তুলো না,আমি তোমাকে কেন্দ্রে ডিস্টার্ব করব না, এক অলিখিত চুক্তি, কী হল? শেষ মুহূর্তে চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে জোট করে জগন রেড্ডি প্রায় সাফ, সাংসদ সংখ্যা ১৮ থেকে কমে ৪, বিধানসভায় টু থার্ড মেজরিটি ১৫১ থেকে ১১ জন বিধায়ক। এবার হয় কংগ্রেসের হাত ধরে ফেরার চেষ্টা করতে হবে না হলে শেষ। হ্যাঁ এটাই বিজেপির চরিত্র।
বিজেপির জন্মের আগে ছিল জনসঙ্ঘ, তো তাদের সঙ্গে ফ্রন্ট করেছে স্বতন্ত্র পার্টি, দর্শনের দিক থেকে খুব আলাদা কিছু নয়, তারাও হিন্দুত্বের কথা বলত, তারাও দেশের সংবিধানকে মেনে নেয়নি। তো সেই স্বতন্ত্র পার্টি কোথায়? কিন্তু তাদের শক্তিশালী জায়গাগুলোতে জনসঙ্ঘ বেড়েছিল। কিন্তু সেই বৃদ্ধি বিরাট ছিল না, জনসঙ্ঘ সেভাবে বাড়েনি, যতটা বাড়লে জাতীয় রাজনীতিতে কল্কে পাওয়া যায়। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের উত্থান জরুরি অবস্থার সময় থেকে, আরএসএস–জনসঙ্ঘে নেতা-কর্মীরা রাস্তায় ছিলেন কেবল নয়, হাত ধরেছিলেন প্রত্যেকের। সোশ্যালিস্ট জয়প্রকাশ নারায়ণের, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা নেতাদের, এমনকী তাদের আর্চ রাইভাল কমিউনিস্টদের নিয়েও তাদের কোনও আপত্তি ছিল না, এবং ওই প্রথম তারা দিল্লি সরকারের ভাগেদারি পেল, স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের কোনও অবদান নেই। বরং যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারা হঠাৎ সংবিধানের কথা বলল, তারা গণতন্ত্রের কথা বলল, তারা এই প্রথম দিল্লির সরকারে মন্ত্রী হল, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাদের এজেন্ডায় তো সবই ছিল, রামমন্দির থেকে ৩৭০ ধারা, গোহত্যা নিবারণ থেকে ইউনিফর্ম সিভিল কোড, তারা ভোলেনি একদিনের জন্যও, কিন্তু তখন তা নিয়ে একটা কথাও খরচ করেনি। তাদের ক্ষমতা বেড়েছে, তারা আরও বন্ধু বাড়িয়েছে, একদা আগুনখেকো সোশ্যালিস্ট জর্জ ফার্নান্ডেজও তাদের হাত ধরেছে, এনডিএ তৈরি হয়েছে, যুক্তফ্রন্ট, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, তার কত্ত শরিক, স্বাভাবিক শরিক ছিল শিবসেনা, আকালি দল, হিন্দুত্বের কথা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কথা তারা বলত। অস্বাভাবিক শরিক সোশ্যালিস্ট জেডিইউ, নাস্তিক ডিএমকে, আরও অনেক দল।
বাজপেয়ীর সরকারের সময় শরিক দলের সংখ্যা ২১, কেরালার সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টিও ছিল, সিপিএম ছেড়ে আসা নটবর বাগদিও ছিল, তৃণমূল ছিল, তেলুগু দেশম ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই অটল সরকার আবার নির্বাচিত হয়নি, বিজেপি দু’ পা পিছিয়েছে, কিন্তু শরিক বেড়েছে, কিছু শরিক ছেড়ে গেলেও, অন্যান্য অনেক শরিক এসেছে। ২০১৪-তে ২৪টা দল ছিল এনডিএ-তে, হ্যাঁ ২৪টা দল। কেউ কেউ ছেড়ে গেছে বটে, কিন্তু তাদের বিকল্পও খুঁজে নিয়েছে বিজেপি, পারেনি এই বাংলায়। ২০১৪-তে একাই বিজেপি ২৮২, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে সামান্য বেশি কিন্তু সেটা কিছুই নয়, বড় দল বিজেপি। ঠিক এইখান থেকে, এনডিএ-র বড় দলগুলোকে হয় ভাঙা, নয় গিলে খাওয়া শুরু করল বিজেপি। প্রথমে পালা ছিল তেলুগু দেশমের, অটল বিহারীর সময় এন চন্দ্রবাবু নাইডু ছিল একটা নাম, গোটা দেশে অন্ধ্র মডেলের চর্চা, চন্দ্রবাবুর চর্চা চলছিল, সে কী ব্যাপার। চন্দ্রবাবু কলকাতায় এলেন, সামনের সারিতে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, উঠে দাঁড়ালেন, প্রত্যেক মানুষ উঠে দাঁড়াল, স্ট্যান্ডিং ওভেশন, সে এক ব্যাপার। কিন্তু অলক্ষে আর একজনের ভুরু কুঁচকোচ্ছিল, কারণ তিনি গুজরাট মডেলকে সামনে আনতে চান, অন্ধ্র মডেল আর চন্দ্রবাবু নাইডুর জয়জয়কার তেনার পছন্দ হয়নি। তো ২০১৪তে ক্ষমতায় আসার পরেই তেলুগু দেশম বাদ কেবল নয়, সিবিআই মাঠে নামল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপির গ্রাফ নামছে, কেন পতন অনিবার্য?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ বহুবার এই চন্দ্রবাবুকে এক করাপ্ট লিডার বলেছেন। এরপর থেকে লাগাতার বিভিন্ন সময়ে ১৯টা দল এনডিএ ছেড়েছে, কেন? ওই গিলে খাওয়ার কৌশল বুঝে, এড়াতে গিয়ে চুরমার হয়ে গেছে, বিজেপি বেড়েছে রাজ্যে রাজ্যে, বিজেপির শরিক দল ধারাবাহিকভাবেই কমেছে। বিহারের দিকে তাকান, প্রথম যখন জোট হল বিজেপির সঙ্গে জেডিইউর, সেই জোটে বড় দল, ১০০-র বেশি আসন কার? জেডিইউর, ৫০-৫৫টা আসন বিজেপির, এখন? মুখ্যমন্ত্রী এখনও নীতীশ কুমার, কিন্তু বড় শরিক ঘাড়ের উপরে নয়, অনেক উপরে বিজেপি ৭৭, জেডিইউ ৪৫। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার কিন্তু দু’ দুজন বিজেপির উপমুখ্যমন্ত্রী। মহারাষ্ট্র? একই খেলা, শিবসেনা ছিল বড় শরিক, তাদেরই মুখ্যমন্ত্রী হত, কোনও প্রশ্নই উঠত না, তারপর ধীরে ধীরে বিজেপি বেড়েছে, শিবসেনা কমেছে, এখন একনাথ শিন্ডের শিবসেনা কাঠপুতুলের চেয়ে বেশি কিছু নয়, অজিত পওয়ারের এনসিপি তো মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পায়নি।
ওদিকে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা নিজেদের বাঁচাতে, আপাতত ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শক্তি শুধু নয় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ে নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন, না হলে দল শেষ হয়ে যেত, অজগর গিলে খেত। ওদিকে দেখুন আকালি দলকে, তাদেরও অবস্থা খারাপ, এক নয়া দলের কাছে হেরে ভূত, কারণ বিজেপি জমানার যাবতীয় দায় তাদের বইতে হচ্ছে, ক্ষীর খাচ্ছে বিজেপি, তারা কংগ্রেস গেলেই খুশি, থাকুক না আপ একটা কি দুটো রাজ্যে। এআইডিএমকে-র দিকে তাকান, তাদেরই সমর্থনে সামান্য জায়গা করার পরে, এখন তাদের দলীয় কোন্দল নিয়ে মাঠে নেমেছে বিজেপি, কিছুদিনের মধ্যেই তারা সম্ভবত দুর্বল গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে বেড়ে উঠবে, অন্তত চেষ্টা করবে। এবারের ভোটে ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছে। উত্তরপ্রদেশে রাজভরের সুহেলদেও সমাজ পার্টি, হরিয়ানার রাজ কুমার সাইনির দল লোকতন্ত্র সুরক্ষা পার্টি, উত্তরপ্রদেশের অপনা দল, এরকম বহু ছোট ছোট জনগোষ্ঠী, জাতি, উপজাতিদের নেতা, দলের সঙ্গে বিজেপি ছিল, একে একে তাদেরকে হয় গিলে খেয়েছে, না হলে তারা এখন কেবল কাঠপুতুল, শাহ–মোদি যেমন নাচাবেন, তেমন নাচবে। এটাই তাদের ভবিষ্যত, তারা লুঠমার চালাবে, এক চোখ বুজে তাদের দিকে নজর রাখবে বিজেপি, সব খাতায় লেখা থাকবে, কথা না শুনলে ইডি আসবে দুর্নীতি বের করতে, আবার পুনর্মূষিক ভব।
ঠিক এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহের ন্যাশন্যাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সে বড় শরিক দল বলতে আছে কেবল নীতীশ কুমারের জেডিইউ, তেলুগু দেশম আর লোক জনশক্তি পার্টি, এবং এরা প্রত্যেকেই বিজেপির এই অজগর বৃত্তির কথা হাড়ে হাড়ে জানে, জানে বলেই অনেক বেশি সাবধান। তবুও মিলিয়ে নেবেন বিজেপি তার চরিত্র অনুযায়ীই এই দলগুলোকে ভাঙবে, এবং নিজেদের সমর্থন জোগাড় করার চেষ্টা তারা চালিয়ে যাবে। সবচেয়ে প্রথম টার্গেট নীতীশ কুমারের জেডিইউ। তাহলে দাঁড়াল কী? আদতে এক গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী, ক্যাডার বেসড বিজেপি দল, যা নাকি আরএসএস-এর নির্দেশে ভারতের রাজনীতিতে আছে, তাদের যুক্তফ্রন্টের কৌশল হল নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানো। ধীরে ধীরে, কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহায়ক দলগুলোতে ভাঙন ধরিয়ে, তাদের নেতাদের ভেঙে এনে গিলে খাওয়া। তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার, এক হিন্দু জাতি, এক রাজনৈতিক দল বিজেপি, এক নেতা, এক ভাষার ভিত্তিতে এক হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করা। মধ্যের হাইফেন এই তেলুগু দেশম, শিবসেনা, সুহেলদেও সমাজ দল, জনতা দল ইউনাইটেড, লোক জনশক্তি পার্টি, অপনা দল, পিএমকে, এমডিএমকে, আরএসপি (বলশেভিক), নাগা পিপলস ফ্রন্ট ইত্যাদিরা ইতিহাস হয়ে যাবে, মিউজিয়ামে এই দলগুলোর ফ্ল্যাগ পাওয়া যাবে, আর না হলে এই দলগুলোই কিছুদিনের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াবে, বিজেপির বিরুদ্ধেই কথা বলবে। খুব বেশিদিন সময় লাগবে না, সামনেই মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার নির্বাচন, দুই রাজ্যের ফলাফল বলে দেবে বিজেপির শরিক দলের ক’জন বিজেপির সঙ্গে থাকবে, আর তখনই বিজেপি তার আস্তিনের তাস বার করবে।