কী শাসক দল, কী বিরোধী দল, নির্বাচনের আগে কেবল জিতবো না, বিরাট ভাবে জিতব, এটাই বলে থাকে। অমিত শাহ দিল্লির নির্বাচনে বলেছিলেন অব কি বার বিজেপি সরকার, পেয়েছিলেন ৮টা আসন। এই বাংলার প্রত্যেকের মনে আছে, অবকি বার দো শ পার, পেয়েছিলেন ৭৭। এবং এটাই ট্রেন্ড, নির্বাচনের আগে প্রত্যেক দলই জিতছিই, এমনটাই বলে। এক চূড়ান্ত ব্যতিক্রম আমরা দেখলাম দিন তিনেক আগে। অসমের গুয়াহাটিতে এক সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী, শুরুয়াতি প্রশ্নই স্বাভাবিক ভাবেই ছিল চার রাজ্যে নির্বাচন, কী ফলাফল আশা করছেন। উনি বললেন, রাইট নাউ, উই উইল প্রবাবলি উইন তেলেঙ্গানা, উই আর সার্টেনলি উইনিং মধ্যপ্রদেশ, উই আর সার্টেনলি উইনিং ছত্তিশগড়। রাজস্থান, উই আর ভেরি ক্লোজ, অ্যান্ড উই থিঙ্ক উই উইল বি এবল টু ডু দ্যাট। মানে হল আমরা তেলেঙ্গানায় সম্ভবত জিতব, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ে জিতবই, রাজস্থানে কাঁটে কি টক্কর, কিন্তু ওটাও আমরা জিতে যাব। অবকি বার দো শ পারের মতো হুঙ্কার নয়, এক অন্য রাজনৈতিক ধারার জন্ম দিচ্ছেন রাহুল গান্ধী। বলেছেন দুটোতে জিতবই, তেলেঙ্গানা আর রাজস্থানেও জেতা সম্ভব। আসুন রাজ্য ধরে ধরে দেখা যাক কী হতে চলেছে। প্রথমেই বলি নির্বাচন কিন্তু চার নয় পাঁচটা রাজ্যে হবে, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা আর মিজোরামে। ইজোরামে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে বিজেপির সরকার, কিন্তু সে জোটের দফা রফা, এএনএফ নিজেরাই সবকটা আসনে লড়বে জানিয়ে দিয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে মিজোরামে এমএনএফ-এরই সরকার হবে। এমএনএফ কেন বিজেপিকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে? কারণ মণিপুরের আদিবাসীদের উপর অত্যাচার, হ্যাঁ গোটা নর্থ ইস্ট এইভাবেই বিষয়টাকে দেখছে। তার মধ্যে যোগ হয়েছে হিন্দু বনাম খ্রিস্টান দ্বন্দ্ব, যা মণিপুরে বিজেপিকে সাহায্য করবে, কিন্তু বাকি উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করবে।
এবার চলুন তেলেঙ্গানায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাজ্যের রাজনৈতিক লড়াই ছিল বিজেপি আর টিআরএস, আপাতত যা ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সমিতি, বিআরএস-এর মধ্যে। সেই সময় আমরা বিআরএস-এর নেতা সি চন্দ্রশেখর রাওকে দেখছিলাম বিজেপির বিরুদ্ধে মহাজোট তৈরি করার ডাক দিতে, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করতে, নীতীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু বছরখানেক হল তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ক্রমশ তিন নম্বর জায়গা থেকে দু’ নম্বরে এসেছে। কর্নাটকে জয়ের পরে এখন জোর গলায় বলছে আমরা তেলেঙ্গানা জিতে যাব। ওদিকে বিজেপি বন্দি সঞ্জয় কুমারকে সরিয়ে আপাতত হাত কামড়াচ্ছে। ডিসট্যান্ট থার্ড হওয়া ছাড়া তাদের গতি নেই। রাজ্য রাজনীতির বাইনারি আপাতত কংগ্রেস আর বিআরএস-এর মধ্যেই আটকে গেছে। এর মধ্যে হায়দরাবাদে হয়ে গেল কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক, জনসমাবেশে উপচে পড়েছিল ভিড়। এখনও মাস দুই দেরি আছে নির্বাচনের, কিন্তু বলাই যায় এটা আপাতত এনিবডিজ গেম, কিন্তু এনিবডিজ মানে? কংগ্রেস আর বিআরএস, বিজেপি রেস থেকে ছিটকে পড়েছে। বিআরএস-এর প্লাস পয়েন্ট হল ঢালাও ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি স্কিম, প্রত্যেক শ্রেণির মানুষ কিছু না কিছু পেয়েছে। আর কংগ্রেসের প্লাস পয়েন্ট হল দলের মধ্যে এক নতুন জোয়ার। সব মিলিয়ে অ্যাডভান্টেজ বিআরএস কিন্তু কংগ্রেস জিতলে সেটা বিরাট এক খবর হবে। তার মানে তেলেঙ্গানাতে বিজেপির হার নিশ্চিত কেবল নয়, এখন থেকেই ২০২৪-এর পিছু হঠা শুরু হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: বিজেপি ধীরে ধীরে ৮০-র দশকের কংগ্রেস হয়ে উঠছে
এবার ছত্তিশগড়, থ্যাঙ্কস টু নরেন্দ্র মোদি, যিনি যত্ন করে দলের প্রত্যেক সিনিয়র নেতাদের একে একে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছেন। সে লালকৃষ্ণ আদবানিই হন কী উমা ভারতী, কী নিতিন গড়করি, কী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। সেই তালিকাতেই আছেন রমন সিং, কাজেই ছত্তিশগড়ে বিজেপি নির্বাচনের আগেই হেরে বসে আছে। একথা সেখানকার বিজেপি নেতারাও বলছেন, আর ভূপেশ বাঘেল এক অসাধারণ পাঁচ বছর উপহার দিয়েছেন ছত্তিশগড় মানুষজনকে। ভাবতে পারেন, শহর ঘেঁষা এক গ্রামে প্রচুর ইউটিউবার গজিয়েছিল। কেউ পলিটিক্স, কেউ বেড়ানো, কেউ খাওয়াদাওয়া, কেউ মোটিভেশন ইত্যাদি নিয়ে জমজমাট ইউটিউব প্রোগ্রাম করছিলেন। তাঁদের জন্য সরকার ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করে এক দুর্দান্ত স্টুডিও বানিয়ে দিয়েছেন। দুটো কাজ হল, ইউটিউবারদের খরচ কমল, আর এই সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সিয়াররা সবাই মিলে গুণকীর্তন করতে শুরু করলেন। তাঁদের রোজগার বেড়েছে, আরও নতুন নতুন ইউটিউবার তৈরি হচ্ছে। বাঘেল সরকার বলেছে আবার ক্ষমতায় এলে প্রত্যেক মহকুমাতে এরকম স্টুডিও করে দেবেন। এখানে অতি বড় বিজেপিও জেতার ক্ষীণ সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছে না।
এরপর চলুন মধ্যপ্রদেশ, মামাজির শাসন, শিবরাজ সিং চৌহান। একসময় ওঁর দলে সভাপতি হওয়ার কথাও হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রিত্বের কথাও শোনা গেছে। সেই তিনি আপাতত একলা, তাঁকে আগামী নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মুখ করা তো দূরস্থান, তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা দলে পাল্টা গোষ্ঠী বানিয়েছেন সেই সব নেতাদের আসন ঘোষণা করা হয়ে গেল। ২৩০টা আসনের মধ্যে দু’ দফায় ৩৯টা করে মোট ৭৮টা আসনের প্রার্থী তালিকা বের করে দিয়েছে বিজেপি। এরমধ্যে তিনজন কেন্দ্রে মন্ত্রী, একজন, নরেন্দ্র সিং তোমর তো ক্যাবিনেট মন্ত্রী। তাঁকে দাঁড় করানো হল যাতে ভিন্দ, গোয়ালিয়র অঞ্চলে দল ভালো ফল করে। এদিকে গোয়ালিয়র হল জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার জায়গা, ৭৮ জনের মধ্যে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা মাত্র ৫ জন। প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল, মন্ত্রী, তাঁকে দিল্লি থেকে এনে এমএলএ করার টিকিট দেওয়া হল, যিনি জীবনে কোনও দিন এমএলএ ইলেকশন লড়েননি। সেই উমা ভারতী অনুগামী প্যাটেল তাঁর টুইটারে লিখেছেন, এতবড় দায়িত্ব দেওয়ার জন্য দলকে ধন্যবাদ। বুঝতেই পারছেন, তাঁর মেজাজের পারদ কতটা চড়েছে। ওদিকে ফাগগুন সিং কুলস্তে, ইনিও মন্ত্রী, বছর সাতেক আগে দল থেকে এঁকে তাড়ানো হয়েছিল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বিনিময়ে টাকা নিয়েছিলেন বলে, তাঁকে এবার এমএলএ-র টিকিট দেওয়া হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে চান। এঁরা ছাড়া আরও চারজন সাংসদকেও এমএলএর টিকিট দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে দলের মধ্যে ঘমাসান লড়াই চলছে। এবং দলের এক সাধারণ সম্পাদক, যাঁকে কিছুদিন আগে বলা হয়েছিল বড় দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা শুনে তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন দল যা কাজ বলবে আই তাই করব। সেই কৈলাস বিজয়বর্গিকে এমএলএর টিকিট দেওয়া হয়েছে, সেটাও আবার তিন বার কংগ্রেসের জেতা আসন। মানে খুব সোজা, বাঘ মারলে মার, না হলে মর। এবং আরও একটা জিনিসও অমিত শাহ আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর ছেলেকে টিকিট দেওয়া হবে না। সবমিলিয়ে মধ্যপ্রদেশ জুড়ে দলের মধ্যে বিদ্রোহ, শিবরাজ সিং চৌহানের বিরুদ্ধে চরম অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি। বিজেপির নিজেদের দলীয় সমীক্ষা বলছে ২৩০-এ ১০০ পার করলে হয়। ওদিকে কমলনাথ হিন্দুত্ব আর সেকুলারিজম নিয়ে এক জবরজস্ত ককটেল বানিয়েছেন। সারা রাজ্যে পদযাত্রা করেছেন, সিন্ধিয়া সরে যাওয়ায় আর দিগ্বিজয় সিং এর রাজ্য রাজনীতিতে আর কোনও শখ না থাকার ফলে দলে কোন্দল নেই। এটাই প্লাস পয়েন্ট। বিজেপি সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা দলে কোন্দল, আর সরকারের বিরুদ্ধে ভালো রকমের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি। এখানে কংগ্রেস ১২৫-১৩০ পেতেই পারে, বিজেপি ১০০-র কাছাকাছি থাকবে।
এবার রাজস্থান, সেখানে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অশোক গেহলট আর শচীন পাইলটের আকচা-আকচি। এখন তা থেমেছে, কোন ফর্মুলায় থামল জানা নেই, থেমেছে। অন্যদিকে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে নিয়ে দলে প্রবল সমস্যা। দলের গ্রাস রুট ওয়ার্কাররা অবশ্যই বসুন্ধরার পক্ষে, কিন্তু দিল্লির নেতারা বসুন্ধরা রাজেকে এক চুল জায়গা দিতে রাজি নয়। শোনা যাচ্ছে তাঁকে টিকিটও দেওয়া হবে না। শোনা যাচ্ছে রাজস্থানেও বেশ কিছু সাংসদ আর মন্ত্রীদের প্রার্থী করা হবে। সেখানে বসুন্ধরাকে সরিয়ে মুখমন্ত্রী হওয়ার লড়াইতেও একজন নন অনেকেই আছেন। শোনা যাচ্ছে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকেও নাকি মাঠে নামানো হতে পারে। মোদিজি গেলেন জয়পুরে, বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার দিকে তাকালেনও না, রোড শোতে তাঁকে দেখাও গেল না। এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী আপাতত জি টোয়েন্টি শেষ, মহিলা আসন সংরক্ষণ বিল পাশ করিয়ে তিনি আপাতত ফুল ইলেকশন মোডে। ২৫ তারিখ রাজস্থানের জয়পুর আর মধ্যপ্রদেশের ভোপালে জনসভা করলেন। মধ্যপ্রদেশে ৬ মাসে এই নিয়ে সাতবার গেলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর বিজেপির প্রবীণ নেতা, তাত্ত্বিক দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্মদিন, এই দিনেই ১৯৯০-এ আদবানি গুজরাতের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেছিলেন, সেদিন মোদি ছিলেন আয়োজনের দায়িত্বে। এবার সেই দিনেই তিনি পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের প্রচারের ভেরী বাজালেন। মজার কথা হল গলায় সংশয়, সেই কনফিডেন্স কই? ভোপালে বললেন মধ্যপ্রদেশকে মন মে মোদি, মোদিকে মন মে মধ্যপ্রদেশ। না, শিবরাজ সিং চৌহানের নামও নেই। ২০১৫-তে বলেছিলেন, অনেকদিন পরে আবার বললেন, কংগ্রেস এখন আর্বান নকশালদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে, ৬৯-এর নকশালবাড়ি আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়েই মহিলাদের বললেন, যদি কংগ্রেস জিতে যায়, তাহলে আপনাদের অধিকার কেড়ে নেবে। মোদিজির মনে ভয় ধরেছে। হেরে যাওয়ার কথা বলছেন। বলতে ইচ্ছে করছে, ইয়ে ডর মুঝে অচ্ছা লগা, বহত অচ্ছা লগা।