রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, আমাদের রাজ্যে বুলডোজার চলবে না, বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে এই বুলডোজার সংস্কৃতি যায় না। মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, উৎসাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতি উৎসাহী সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ, এখনও দিল্লির দিকে তাকিয়ে থাকা আমলাদের কাছে এক পরিষ্কার মেসেজ, বুলডোজার চলবে না। কেন এই প্রসঙ্গ এল? কারণ ক’দিন আগেই আদালতের এক রায়ে বলা হয়েছে যে এই হোটেলগুলো কোস্টাল রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী সমুদ্রবেলা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে হওয়াতে তা বেআইনি। অতএব তাকে ভেঙে ফেলা হবে। ১৪০টা হোটেলের এক তালিকা এসেছে, সব ভাঙা হবে। আদালতের রায় কিসের ভিত্তিতে জানি না, কোন তথ্যের ভিত্তিতে আদালতের এমন সর্বনাশা রায় এসেছে জানা নেই, কিন্তু এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের কাজ হারাবে, তাদের রোজগার বন্ধ হবে, এক লপ্তে এই কয়েক লক্ষ মানুষের পেটে লাথি মেরে কোন পরিবেশ রক্ষা করব আমরা? জেলাশাসক যিনি নাকি আবার ওই কোস্টাল রেগুলেশন অথরিটির চেয়ারম্যান তিনি আদালতের রায় অনুযায়ী অবিলম্বে ওই হোটেল ভাঙার নির্দেশও দিয়েছিলেন, বাদ সাধলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বুলডোজার চলবে না। গতকাল সকালেও যে আশঙ্কার কালো মেঘ মাথায় নিয়ে তাঁরা বিভ্রান্তের মতো ঘুরছিলেন, তা বিকেলের পরে অনেকটাই কেটেছে, স্লোগান উঠেছে, দিদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। হোটেল মালিকদের কথা ছেড়ে দিন তাঁদের সংখ্যা তো ওই দেড়শো, কিন্তু হোটেলের কর্মচারী, পাশাপাশি মানুষজনদের মধ্যে ভ্যানওলা থেকে সবজি বিক্রেতা, ছোট চায়ের দোকান থেকে হোটেলের কর্মচারী, সেই সব হোটেলের বুকিং করেন যাঁরা সেই সব হাজার হাজার ট্রাভেল এজেন্ট, কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স ওয়ার্কার, সিকিউরিটি গার্ড আরও কত লক্ষ মানুষ দেখলেন আদালতের এই রায় আর তাঁদের দুশ্চিন্তার মধ্যে ঢালের মতো দাঁড়িয়ে আছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কাজেই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, আমাদের রাজ্যে বুলডোজার চলবে না: মমতা।
মানুষ বেড়াতে যাবে পাহাড়ে, পাহাড়ের গায়েই তারা থাকতে চায়, সমুদ্রের ধারে গেলে সমুদ্রের ধারে, জঙ্গলে গেলে জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু যবে থেকে পর্যটন এক শিল্প হয়ে উঠেছে, যবে থেকে এই পর্যটন শিল্প দুনিয়ার বহু কোটি কোটি মানুষের রোজগার হয়ে উঠেছে, বহু দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছে এই পর্যটন শিল্প, সেই তখন থেকেই পরিবেশ আর পর্যটনের জন্য হোটেল রিসর্টের কনস্ট্রাকশন নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে, এবং বেশ কিছু সময় ধরে পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখেই এইসব রিসর্ট, হোটেল গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু যা আগে তৈরি হয়ে গেছে? ধরুন, আরব সাগরে বড় ঢেউ উঠলে যে হোটেলের বারান্দায় জলের কণারা ভেসে আসে, সেই বিখ্যাত বোম্বে তাজ-এর কী হবে? মেরিন ড্রাইভের পাশে অজস্র হোটেলের কী হবে? গোয়ার সি-বিচে গড়ে ওঠা রিসর্টের কী হবে? পাহাড় টিলার ওপরে ফাইভ স্টার হোটেলের কী হবে? করবেট ন্যাশন্যাল পার্কের কোর এরিয়াতে যে রিসর্ট আছে, তার কী হবে?
আরও পড়ুন: Aajke | আমি নির্দোষ: সঞ্জয় রায়
প্রায় সবক’টা জঙ্গলের কোর এরিয়াতে ফরেস্ট বাংলো আছে, সেগুলোর কী হবে? দিঘাতে অজস্র হোটেল আছে ওই সমুদ্রের ধারে, তাদের কী হবে? ৫০০ মিটার বেলাভূমি থেকে দূরত্ব, বেলাভূমি পাল্টে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে, তখন কী হবে? এসব জটিল প্রশ্ন কিন্তু সমাধান তো সম্ভব। আর সমাধান ওই বুলডোজারের মধ্যে লুকিয়ে নেই, নেই বলেই আদালতের এমন রায় আসার পরেও রাজ্যের মানুষের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, পারেন না বলেই সাফ জানিয়েছেন, বুলডোজার চলবে না। এবং আহাম্মক তো আছেই, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, থলি ভরে মালিকদের কাছ থেকে টাকা যাচ্ছে তাই মুখ্যমন্ত্রী আদালতের কথা মানছেন না। ও সুজনবাবু, এসব হোটেল কবে তৈরি হয়েছিল, মেদিনীপুরের দুই নেতা লক্ষ্মণ শেঠ আর স্বদেশ নায়েকের অনুমতি ছাড়া যে অঞ্চলে পিঁপড়েও ঘুরতে পারত না সেখানে ২০০০ সাল থেকে হোটেল রিসর্ট তৈরি হওয়া শুরু হয়। আপনার তো ভালো জানার কথা, র্যো জ ভ্যালি ২০০৭-এ বিরাট অনুষ্ঠান করে শুরু হয়েছিল, জানেন না সোনার বাংলা, সানা বিচ, কবে শুরু হয়েছিল? কে ছিলেন সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী? পর্যটন মন্ত্রীর কথাই বা ভুলি কী করে, জামার পকেটে লেনিন ঝোলানো থাকত। এবং মনে করিয়ে দিই এই কোস্টাল রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৮৬-তে আনা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৩ নম্বর ধারার মধ্যে জোড়া হয়েছিল ১৯৯১-এ, কোথায় ছিলেন তখন? এই বিরাট বিরাট হোটেলের মালিকেরা কত টাকার থলি নিয়ে আপনাদের দরজাতে হাজির হয়েছিলেন? হ্যাঁ, তখনও হাজির হতেন, এখনও হাজির হন, এ সবাই জানে, এ সত্য সবার জন্যই সত্য। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়, যা হয়ে গেছে সেখানে লক্ষ মানুষের জীবিকার প্রশ্ন জড়িয়ে, সেই মানুষদের জীবিকার প্রশ্ন নিয়ে কোথায় তাদের পাশে দাঁড়াবেন, তা নয় বিরুদ্ধ পক্ষ বেছে নিলেন অনায়াসে? শূন্য থেকে এবারে মাইনাসে যাওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন এই সিপিএম নেতারা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে মন্দারমণিতে ১৪০টা হোটেল ভাঙার নির্দেশ রুখে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জানিয়ে দিলেন বুলডোজার চলবে না। এই নির্দেশের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের জীবিকা হারানোর আশঙ্কাতে দিন কাটাচ্ছিলেন, তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। পরিবেশ না মানুষের রোজগার, কোনটা বেশি জরুরি? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
দুনিয়ার বড়লোক দেশগুলো বন কেটে উজাড় করেছে, বিশাল বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার বানিয়েছে, সমুদ্রতীরে রিসর্ট বানিয়েছে, জঙ্গলের মধ্যে খামার বাড়ি, হোটেল রিসর্ট, পাহাড় পর্বতের চূড়াতে হোটেল, লক্ষ লক্ষ টন রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ তারা রোজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ডাম্প করে, তাদের পরমাণু বর্জ্য আজ সারা পৃথিবীর সমস্যা। তারা সবচেয়ে বেশি জ্বালানি, ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করে, অথচ তারাই এখন পরিবেশ নিয়ে সবথেকে কঠোর নির্দেশ চাপাতে চায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ঘাড়ে। ঠিক সেরকমই আমাদের দেশেও পরিবেশের দোহাই দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ফরমান জারি করা হচ্ছে, যে ফরমান মানলে লক্ষ লক্ষ মানুষের রোজগার চলে যাবে। বন্ধ হোক এই নকল ভুয়ো পরিবেশ প্রেম। পরিবেশ আর সভ্যতার মধ্যের দ্বন্দ্ব আজ নয় বহু পুরনো, তার ভারসাম্য আমরা চাই কিন্তু তা আমজনতার পেটের বিনিময়ে নয়।