ছোটবেলায় স্কুলে দেখেছি, দু’ চারজনের বাঁদরামির জন্য গোটা ক্লাস কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আর পড়েছি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের হবুচন্দ্র রাজা, গবুচন্দ্র মন্ত্রী গল্পে দোষীকে খুঁজে না পেলেও একজন কাউকে খুঁজে শূলে চাপানোটাই ছিল যে রাজা আর মন্ত্রীর কাজ। সেরকম একটা ঘটনা দেখে ফেললাম। চাকরি চুরি হয়েছে, এ নিয়ে তো কোনও সন্দেহই নেই, কিছু লোকজন চাকরি পেয়েছেন অসাধু উপায়ে, কিছু লোকজন এই চাকরি চুরির মতো জঘন্য অন্যায় কাজ করেছেন, বঞ্চিত হয়েছেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা। এবং তা একসময়ে ধরাও পড়েছে, তদন্ত শুরু হয়েছে। আবার সেই তদন্ত যে সে নয়, সিবিআই করছে, বহু তথ্য পাওয়া গেছে বলে সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনেছি আমরা, কালীঘাটের কাকুর কথা তো সব্বার ঘরে ঘরে, বহু টাকা উদ্ধার হয়েছে মন্ত্রীমশাইয়ের বান্ধবীর ঘর থেকে, মন্ত্রীমশাইয়ের ঘরে জমির দলিল, তো তিনিও সেই কবে থেকেই জেলে, আমার আর ভালো লাগছে না বলার পরেও তাঁকে ছাড়া হয়নি। মহামান্য আদালতের আদেশে সিবিআই তদন্ত চলছে, এরই মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের রায় এল, সে রায় দিয়েছেন যে দুজন তাঁদের মধ্যে আছেন আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতি, কাজেই সেই রায় মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই। কিন্তু হুজুর মাই বাপ আপনাদের যাবতীয় সততা, প্রগাঢ় জ্ঞান এবং সততা নিষ্ঠা দিয়েই বিষয়টার পূর্ণ বিশ্লেষণ করার পরেই আপনারা রায় তো দিলেন কিন্তু অজ্ঞ মানুষজনের কিছু প্রশ্ন তো আছে, সাধারণ মানুষ তো প্রশ্ন করছে, হুজুর মাই বাপ সেগুলোই আপনাদের সামনে রাখলাম, আমার দোষ নেবেন না, মানুষ আর আপনাদের মধ্যে আমি তো কেবল দূত মাত্র, আর কে না জানে যে দূত অবধ্য। তো যে সারমর্ম বেরিয়ে এসেছে আমজনতার কাছ থেকে সেটাই বিষয় আজকে, চোর খুঁজে না পেয়ে সব্বার হাজতবাস?
রায় বের হওয়ার পরে চিটফান্ডের টাকা তছরুপ করা সাংবাদিকের কী উল্লাস, এদিকে সারা দেশ বেচে দেওয়ার কাজ যাঁরা প্রকাশ্যেই করছেন, সেই দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমে পড়েছে। আবার যাদের জমানাতে এই দুর্নীতি ঘটেছে, তাঁরা তাঁদের অবস্থান বোঝাতে গিয়ে ঠিক কী বলতে চাইছেন তাও বোঝা যাচ্ছে না, মানে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁরাও পড়েছেন ফাঁপরে। কিন্তু যেটা এক্কেবারে পরিষ্কার তা হল এই ২৬ হাজারের মধ্যে সেই হাজার দুই, তিন, চার বা পাঁচ কালো ভেড়া, ব্ল্যাক শিপদের বাদ দিলে বাকিদের কান্না স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এক অসহায় কান্না, যেখানে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় তাদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার আদেশ দিয়েছে, সেখানে অসহায় অক্ষম কান্না ছাড়া আর কিছু তো শুনতে পাওয়ার কথা নয়।
আরও পড়ুন: Aajke | অমিত শাহের বদহজম, স্বপ্ন দেখছেন শুভেন্দু মুখ্যমন্ত্রী হবেন
একটা সোজা উপায় আছে, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বলা, এই শিক্ষামন্ত্রীকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে বলা, খুব সোজা একটা দাবি, গঙ্গারামপুরে ধর্ষিতা খুন হওয়া মেয়েটির বিচারের দাবিতেও সরকারের পদত্যাগ চাওয়া যায়, বেআইনি বাজি কারখানাতে আগুন লাগলেও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ২৬ হাজার মানুষের, শিক্ষকের, অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি চলে যাওয়ার আদেশের পরে সেরকম একটা দাবি তোলাই যায়। আসুন না সেইখান থেকেই আমাদের আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। ধরুন ওনারা পদত্যাগ করলেন, তারপরে? ওই ২৬ হাজারের চাকরির কী হবে? এই মুহূর্তে স্কুলে শিক্ষক অশিক্ষক কর্মচারীর চাহিদা কীভাবে মিটবে? ওই ২৬ হাজারের মধ্যে আসলে দোষী কারা, আসলে কারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে তাদেরকে কীভাবে চিহ্নিত করা যাবে? যাবে না তো? হ্যাঁ যাবে না। তাহলে পদত্যাগ করে কী হবে? সেই জায়গাতে তাঁরাই আসবেন যাঁরা সারা দেশটাকে লূঠমারের এক অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছেন তাঁদের আনা হবে? তাঁদের বকলমে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হবে? মাথায় রাখুন এই আমলে মোদি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আদানির সম্পদ বেড়েছে ৯২৯ শতাংশ, তাঁকে এনে বসানো হবে? কারণ আর তো কেউ নেই সামনে। নাকি তাঁদের বসানো হবে যাঁদের একজন বিধায়ককেও মানুষ নির্বাচিতই করেননি। কারা বসবেন? নাকি এক নৈরাজ্য চাই এই বাংলায়, যেটুকু হয়েছে সব ভোগে যাক, সব উল্টোপাল্টা করে দে মা লুটেপুটে খাই? এরকমটাও বলতেই পারেন, যা হবে দেখা যাবে এই সরকার বিদেয় হন। হ্যাঁ, এরকমটাও বলতেই পারেন, নৈরাজ্যবাদ তো রাজনীতির এক অঙ্গ, বিশেষ করে সুবিধেভোগী সেই সব মানুষজন যাঁদের সেই স্বচ্ছল অবস্থা আছে, নানান ফিকিরে রোজগার সরকারি চাকরি, সোজাপথেই ভালো রোজগার ইত্যাদি করার পরে কোনও দায়ই নেই, তাঁরা বলতেই পারেন, পরে কী হবে দেখা যাবে, আগে তো এনারা যাক। কিন্তু সবে যে গ্রামগুলোতে খানিক স্বচ্ছলতা বাড়ছিল, সবে যে মহিলারা দুটো পয়সা হাতে পেয়ে নিজেদের গলার জোর বাড়াচ্ছিলেন, সবে যে বাচ্চারা মিড ডে মিলে ভরপেট খাবার পেতে শুরু করেছিল, তাদের কী হবে? সেই বিরাট সংখ্যক মানুষের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে যে নৈরাজ্য তৈরি হবে তার দায় কে নেবে? এর থেকে ভালো হত নাকি যদি এই দুর্নীতির শেকড় ধরে টান দেওয়া যেত, যদি এই দুর্নীতিকেই এক্কেবারে বন্ধ করা যেত? কী ভাবে যাবে? এ তো হিন্দি ছবি নয়, এক হিরো ভিলেন পিটিয়ে শায়েস্তা করবে, তা তো সম্ভব নয়। তাহলে? প্রথম উপায় হল পুলিশ, তো রাজ্য সরকার বা মন্ত্রীই যেখানে দায়ী সেখানে রাজ্যের হাতের পুলিশ কী করবে? তাহলে পড়ে থাকে সিবিআই, বিশাল ক্ষমতা, তারা বের করবেন কোথায় এই আপরাধের শেকড়, তারাই প্রমাণ আর তথ্য এনে হাজির করবেন। তো এই ক্ষেত্রে কি সিবিআই কাজ করছে না। হ্যাঁ করছে, সিবি আই এক গুচ্ছ মন্ত্রীসান্ত্রী আমলাদের ধরেছে, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ করেছে, তারা নাকি জানে কোথা থেকে টাকা এসেছে কোথায় গেছে, তাহলে সেই বিচারে ধরা পড়া তো উচিত কারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে কারা মেধার জোরে পেয়েছে, এখনও না পড়লেও এই তদন্তের ফলে আগামিদিনে সেই সত্যিটা তো বের হয়ে আসা উচিত। সেই সত্যি বের হওয়ার আগেই এই রায় দেওয়ার তাড়াহুড়োর পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে? এই যে এতজনকে গ্রেফতার করা হল, জেলে রাখা হল, জেলে আছেও অনেকেই, এর ভয়েজ রেকর্ড হচ্ছে, তার ঘরে টাকা পাওয়া যাচ্ছে, জামাই রাজসাক্ষী হচ্ছে, এগুলো কি নৌটঙ্কি? এগুলো কি মাদারি কা খেল? যদি না হয় হুজুর তাহলে, আমার প্রশ্ন নয়, লালমোহন বাবু দু’ চারটে প্রশ্ন করলেও আমি কোনও প্রশ্ন করি না, মানুষের প্রশ্ন তদন্ত শেষ হওয়ার পরে, দোষীদের বেছে বাদ দিয়ে এই রায় কি দেওয়া খুউউব কঠিন ছিল? শুনুন সেই প্রশ্নই আমাদের দর্শকরা করেছেন, আমরা কেবল জিজ্ঞেস করেছিলেম, ২৬ হাজার মানুষের চাকরি চলে গেছে, আপনাদের প্রতিক্রিয়া জানান। তদন্ত চলছে, তদন্তের থেকে বেরিয়ে আসা তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধীদের চাকরি না খেয়ে, সবার চাকরি এক লপ্তে খেয়ে নেওয়াটা কি ঠিক হল? হুজুর দেখুন এবং শুনুন মানুষ মানে আম জনতা কী বলছেন।
ত্রিপুরায় তখন ভরা বাম জমানা। মুখ্যমন্ত্রী সিপিএমের মানিক সরকার। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে দু’দফায় স্কুলশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক পদে ১০,৩২৩ জনকে নিয়োগ করেছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ওই নিয়োগ নিয়ে মামলা হয় ত্রিপুরা হাইকোর্টে। গোটা প্যানেল বাতিল করেছিল আগরতলার উচ্চ আদালত। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল মানিকের সরকার। কিন্তু ২০১৭ সালে শীর্ষ আদালতও সমগ্র প্যানেল বাতিলের নির্দেশই বহাল রাখে। আবার এই সেদিন জানা গিয়েছিল বিভিন্ন কেন্দ্রে নিট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বের হয়ে গেছে, তাদের সবটা খুঁজে বের করা গেছে? তারপরে কি মেডিক্যাল কাউন্সিলিং বন্ধ করা হয়েছে? সেই পাশ করা ছাত্রছাত্রীরাই কি এখন ডাক্তারি পড়ছে না? সুপ্রিম কোর্ট সেদিনে কেন রায় দিল না যে গোটা প্যানেল বাতিল করা হচ্ছে? সেদিন সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল ১) Affecting over 2 million students, a retest or counseling cancellation would delay education. ২) impact on students from disadvantaged backgrounds, risking educational access. ৩) Delaying counseling would push back medical course starts, affecting training and placements. এটাই তো স্বাভাবিক বিচার, কিছু লোক দোষ করেছে, তার দায় সবাই নেবে কেন? তারমানে একই রকম বা প্রায় একরকম ক্ষেত্রে নানান রায় আসে, তাই আমাদের যা বলার তা হল ২৬ হাজার মানুষকেই আতান্তরে না ফেলে, কেবলমাত্র কালো ভেড়াগুলো, ব্ল্যাক শিপগুলোকে ছেঁটে ফেলা কি এক্কেবারে অসম্ভব?