কেবল আজকের খবরের কাগজটা খুলুন, চার চারটে দুর্ঘটনার কথা পাবেন। চার ক্ষেত্রেই দুজন বাইক চালক আর দুজন পিছনে বসে থাকা সওয়ারি মারা গেছেন। সবচাইতে বয়স বেশি যাঁর তিনি ৫৬ আর সবচেয়ে কম যিনি তিনি ২২ বছরের এক তরুণী। যেটা উল্লেখ করার সেটা হল এঁরা চারজনেই হেলমেট পরে ছিলেন। কিন্তু দুর্ঘটনার পরে মৃত্যু এড়াতে পারেননি। এঁদের মধ্যে আবার একজন অ্যাপ বাইকে বাড়ি ফিরছিলেন, ওলা উবের থেকে অনেক কম খরচ। কাজেই সেই ২২ বছরের যুবতী একজন ইনটার্ন সাংবাদিক বাড়ি ফিরছেন সেই বাইক বুক করে, রাস্তায় হঠাৎ ব্রেক কষে বাইকটি, মেয়েটি ছিটকে পড়েন রাস্তায়, মারা যান কিছুক্ষণের মধ্যেই। কেবল আজকের কাগজ নাকি? যে কোনও দিন কাগজ খুলুন, প্রতিদিন একাধিক কিশোর, কিশোরী, যুবক, বিভিন্ন বয়সের মানুষ মারা যাচ্ছে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে। এমনও নয় যে তাঁরা প্রত্যেকেই রেকলেস গাড়ি চালাচ্ছিলেন, এমনও নয় যে তাঁরা সবাই হেলমেট পরেছিলেন না, কিন্তু মারা যাচ্ছেন। আমাদের এক বন্ধুর হবু স্ত্রী বিয়ের মাত্র দিন পাঁচ আগে তার ভাইয়ের বাইকের পিছনে বসে বিয়েরই কিছু জিনিস কিনতে বাজার গিয়েছিলেন, রাস্তায় ওইরকম এক দুর্ঘটনাতে মারা যান, হ্যাঁ মাথায় হেলমেট ছিল। দুর্ঘটনা কি অন্য কিছুতে ঘটছে না? ঘটছে তো। কিন্তু এরকম রোজ? প্রতিদিন দুজন পাঁচজন, চারজন করে কেবল এই বাংলাতেই মারা যাচ্ছে, অন্যান্য শহরের কথা বাদই দিলাম। হিসেবই নেই একদিনে বাইক দুর্ঘটনাতে কতজন মারা যাচ্ছেন, কতজন গুরুতর আহত হচ্ছেন। আমার ধারণা গড়ে শ’ খানেক মানুষ তো বটেই। মানে বছরে ছত্রিশ সাঁইত্রিশ হাজার মানুষ। আর তাই সেটাই আজকের বিষয়, ডেথ অন হুইলস, দু’ চাকার যমদূত।
কথাটা শুনেছিলাম উজবেকিস্তানে গিয়ে, আমাদের গাইড আক্রম বলেছিল, এক অদ্ভুত বর্ম পরা একজনকে বাইকে চেপে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কি রুল? বলেছিল না, কিন্তু ডেথ অন হুইলস নিয়ে মানুষের ভয়ের কারণেই এখানে খুব কম বাইক চলে, চড়লেও লোকে পিছনে বসে না মানে যাকে বলে পিলিয়ন রাইডিং তা প্রায় নেই আর সারা গায়ে এমন বর্ম নামায়। আমেরিকাতে এই রেকলেস বাইক ড্রাইভিংয়ের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল, কিন্তু সেখানকার ট্রাফিক রুলের জন্যই তা এখন কমেছে, ইউরোপেও বাইক আছে কিন্তু রাস্তায় বের হলেই আমাদের মতো ১০০টা বাইক দেখতে পাবেন না।
আরও পড়ুন: Aajke | রাজ্যপাল বলেছেন উনি আনসেফ
আর সব থেকে বড় যেটা তফাৎ তা হল বাইকের চাকা। আমাদের দেশে পাবলিক ভেহিকলস-এর হাল খুউউব খারাপ। কাজেই বহু মানুষ কম দামে একটা বাইক কিনে ফেলেন মূলত দুটো কারণে। ১) চাকরি, রোজগারের জন্য। ডেলিভারি সার্ভিস থেকে ক্যুরিয়ার সার্ভিস থেকে অ্যাপ বাইক ইত্যাদির জন্য। ২) নিজেকে সেই ঘোড়ায় সওয়ার রাজপুত্র হিসেবে ভাবতে চান, দেখতে চান অনেকেই, যা প্রতিদিন বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়। এবারে খেয়াল করুন ইউরোপে বা আমেরিকাইয় বাইক আমাদের মতো সস্তা নয়, অনেক বেশি দামি এবং তা এত মাইলেজ দেয় না। দুটো কারণে, প্রথমটা হল তার সুরক্ষা ব্যবস্থার উপরে বিরাট খরচ হয়, দুই হল চাকা অনেক মোটা হওয়ার ফলে ফ্রিকশন বেশি, মাইলেজ কম। আমাদের এখানে কম দামে বাইক দেওয়ার জন্য এই দুটো পয়েন্টকেই উপেক্ষা করা হয়। এক তো ব্রেক ইত্যাদি সবচেয়ে অবৈজ্ঞানিক, সুরক্ষার লেশমাত্র সেখানে নেই, বরং সাডেন ব্রেক পিলিয়ন রাইডারের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। আর চাকা সরু করার ফলে ফ্রিকশন কম, মাইলেজ বেশি, কাজেই মানুষের কাছে কম পয়সাতে অনেক বেশি রাস্তা পার করা, এই প্রচণ্ড মূল্যবৃদ্ধির দিনে তা অনেকের কাছে সবথেকে বেশি আকর্ষণীয়। কাজেই কেনো বাইক তারপর হাওয়ার সঙ্গে কথা বলো, এটাই তো বিজ্ঞাপনের ভাষা। তারপর সেই হাওয়ায় ভাসবে রক্ত, ঘিলু, মজ্জা, বউ মা বা সন্তানের কান্না, তাতে কী? হাওয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে তো তখন শ্মশানে পুড়ছে, হাওয়া বয় শন শন, তারারা কাঁপে। কিন্তু হৃদয়ে কোনও জং লাগে না, সেই আধভাঙা বাইক আবার গ্যারেজে সারিয়ে অর্ধেক বা তারচেয়েও কম দামে বিক্রি হয়ে যায়, আবার কোনও দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষায় থাকে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রতিদিন বাইক দুর্ঘটনা হয়, সে কি কেবল চালকের ভুলে? নাকি বাইকে দুর্ঘটনা ঘটাটাই স্বাভাবিক? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
কোথাও তো একটা লাগাম দেওয়া দরকার, কোথাও তো কিছু কড়া নিয়ম কানুন দরকার, যা বাইক চালককে সাবধান করবে, নিয়ম না মানলে জেল জরিমানা হবে, কেবল ফাইন নয়। অন্যদিকে সুরক্ষার ব্যবস্থা কমিয়ে, মাইলেজ বাড়ানোর নাম করে দাম কমানো হচ্ছে, আর বাড়ছে দুর্ঘটনা। ১৪০ কোটির দেশে ৩৬০০০ মৃত্যু প্রতি বছরে সত্যিই তেমন কিছু নয়, কিন্তু সেই তরুণী যদি আপনার বোন হয়? দিদি হয়? সেই যুবক আপনার সন্তান হয়? সেই প্রৌঢ় আপনার বাবা হন? তাহলে? কোন সংখ্যায় গুনবেন তাকে? সেই শোক যখন ঘুরে ফিরে আসবে মাথায়, তখন কি মনে হবে না ওই বাইকে চড়ার জন্য আমি তাকে ক’বার বারণ করেছিলাম, ডেথ অন হুইলস নিয়ে আমি তাকে ক’টা কথা বলেছিলাম? বলেননি, এখন বলুন, দেরি হওয়ার আগেই বলুন।