সেই স্কুলে থাকতে আমরা ফিউচার ডুম-কে ফুটুর ডুম বলা শুরু করেছিলাম, গতকাল হঠাৎ সেটা আবার মনে পড়ল। এক গদগদ ছবি থেকেই এই ধারণা। সুকান্ত মজুমদার মন্ত্রী হয়েছেন, হোক না হাফ প্যান্টুল মন্ত্রী, মন্ত্রী তো। তো তিনি এলেন দিলীপবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। কেন ভাই? কী চাই? এমনিতে ওই সুকান্তবাবুর সঙ্গে দিলু ঘোষের কি খুব সখ্য আছে? পাগলেও বলবে না। কিন্তু ওই যে শত্রুর শত্রু আমার মিত্র, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। ওদিকে দলে শুরু হয়ে গেছে মুষলপর্ব, এ বলছে মহিলা নিয়ে ফুর্তি হত, সে বলছে তিনটে ঘুঘুর বাসা, আরেকজন বলছে কাঠি করেছে। আর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিচ্ছিরি রকমের ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে এবারে টিকিট বিতরণের সময়ে শুভেন্দুর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার পরে এরকম এক ফলাফল যে তাঁদের খুশি করবে না সে তো স্বাভাবিক। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে বিজেপির যত প্রাচীন তাঁরা জড়ো হচ্ছেন এক জায়গায়। শুভেন্দু অধিকারী কেন দল ছেড়েছিলেন? রামমন্দির করার জন্য? হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার জন্য? ইউনিফর্ম সিভিল কোড লাগু করা জন্য? একেবারেই নয়, উনি বুঝেছিলেন তৃণমূলে ওনাকে দু’ নম্বর হয়েই থাকতে হবে, এই কোট আনকোট বঞ্চনার কথা যখন ওনার মাথায়, ঠিক তখন বিজেপি তাঁকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিল যে এধারে আসুন, নেতৃত্ব দিন, মুখ্যমন্ত্রী হন, সিম্পল। অনেকে বলেন ওই নারদা ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য নাকি শুভেন্দু বিজেপিতে গিয়েছিলেন। ওসব অতি তুচ্ছ বিষয়, কনসিডারেশন একটাই ছিল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া আর কিচ্ছুটি নয়, কিন্তু সেটাই এখন প্রশ্নের মুখে। আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে। শুভেন্দু অধিকারীর ফুটুর ডুম।
তিনি নেমেছিলেন গুছিয়েই, অনেকের ধারণা তিনি ওই ২০২১-এর আগে হঠাৎ করে বিজেপিতে চলে এলেন, তা তো নয়। ২০১৯-এ বিজেপি ১৮টা আসন পেল, বামের ভোট হুউউস করে রামে, এক ঝটকায় বিজেপির ভোট ৪০.৭ শতাংশ, তৃণমূলের ভোট কত ছিল? ৪৩.৩ শতাংশ। সারা দেশে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে আর ঠিক সেই সময় থেকেই শুভেন্দুর কাছে এক আড়কাঠি এসে এক বিকল্পের ছবি তুলে ধরেন। ওনারই কথামতো তিনি দলে থেকেই, মন্ত্রিত্ব নিয়েই ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন, বিভিন্ন জেলাতে কথাবার্তা চালাতে থাকেন। একটা পরিকল্পিত দলত্যাগকে হঠাৎ দলত্যাগে তৈরি করে মিডিয়া অ্যাটেনশন-এর ব্যবস্থা তৈরি হল, শুভেন্দু কি দল ছাড়বেন? আরে বাবা দল ছাড়া ঠিক হয়েছে আড়াই বছর আগে, কিন্তু মিডিয়া গাড়ির পিছনে ছুটছে, অভিষেক-শুভেন্দু গোপন মিটিংয়ে কি মিটিবে সমস্যা? কোনও সমস্যাই ছিল না, উনি যে বিজেপিতে আসবেন, আর কে কে আসবে সে সব ঠিক করাই ছিল।
আরও পড়ুন: ইডি এখনও একই খেলা চালিয়ে যাচ্ছে, সম্ভবত দেওয়াল লিখন পড়ে উঠতে পারেনি
হ্যাঁ, সব্বাই শেষ পর্যন্ত সেই দম রাখতে পারেননি, সাহস ছিল না, বা তাঁদের সামনে বিরাট কোনও গাজর ছিল না। কিন্তু যাঁদের সামনে ছিল সেই রাজীব ব্যানার্জি, উত্তরপাড়ার বিধায়ক সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল, বা তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী হবেন এই আকাঙ্ক্ষায় রুদ্রনীল ঘোষের মতো আহাম্মকেরা দলে দলে যোগ দিলেন বিজেপিতে, চার্টার্ড বিমানে গেলেন দিল্লি। মঞ্চে মঞ্চে যোগদান মেলা চলছে, শুভেন্দু এক জনসভাতে নিজেই ফাঁস করে দিলেন, অমিত শাহকে প্রণাম করে জানিয়ে দিলেন, বহু আগে থেকেই তিনি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তো দলে এসেই প্রথমেই ওনার চরিত্র অনুযায়ী সবটার কন্ট্রোল নেওয়া শুরু করলেন, জিতছেন তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীও হচ্ছেন, কাজেই শ্যাডো মন্ত্রিসভাও তৈরি করা শুরু হল। কেউ কেউ নাকি সে লিস্টে না থাকতে পেরে ভারি অভিমান করেছিলেন। তো সেসবের পরে? ৩৮.১৫ শতাংশ ভোট পেল বিজেপি আর তৃণমূল? ৪৮.২ শতাংশ। বিজেপির আসন ৭৭, তাও বিধানসভা বসতে না বসতেই খসতে শুরু করল। তখন তিনি সবটা ওই দিলু ঘোষের অপদার্থতা আর কিছু পুরনো লোকজনের অকর্মণ্যতা ইত্যাদি বলে বুঝিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। এবার ২০২৪, আগের কথা মনে রেখে হাত খুলে দেওয়া হল শুভেন্দুর, উনি ইচ্ছে খুশি মতন ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলেন। কিন্তু মাথার উপরে মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে কাজ করা আর নিজেই সবটা করার মধ্যে ফারাক আছে, রাম ধ্যাড়ান ধ্যাড়ালেন। অনেকের বক্তব্য, কেবল তাঁর চয়েজ অফ ক্যান্ডিডেটের জন্য অন্তত গোটা চারেক আসন হারিয়েছে বিজেপি, আর এই বাজারে তার দাম কম নয়। এবং বিষয়টা এখানে থেমে নেই বিজেপি তলার আর উপরের সারি জুড়ে এক প্রবল শুভেন্দু বিরোধী গোষ্ঠী তার শক্তি বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে শুভেন্দু মুখে যাই বলুন আদতে বুঝেছেন যে ওনার চালে বিস্তর গন্ডগোল হয়ে গেছে, উনি এখন ত্রিশঙ্কু, ঝুলছেন। মুখ্যমন্ত্রী? ছেড়ে দিন, বিরোধী দলনেতার পদটাও কি বেশিদিন ধরে রাখতে পারবেন? মনে হয় না। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনে এই বাংলায় বিজেপির এই ফলাফলের পরে শুভেন্দু অধিকারীকেই দায়ী করছে দলের বহু কর্মী সমর্থক, বলছে উনি ভুলভাল টিকিট দিয়ে আর ভুল প্রচার করেই দলকে হারিয়েছেন। আপনাদের মতামত কী?
রাজ্যে আদি নব বিজেপি নতুন লড়াই শুরু হয়েছে, আর কিছুদিনের মধ্যে অন্তত একজন এমপি তো খসে পড়বেই। এবং বিপদ আরও বাড়বে যদি এর উপরে কংগ্রেসের চার পাঁচ পার্সেন্ট ভোট জড়ো হয় তৃণমূলের সঙ্গে, ২০২৬-এ এ রাজ্যে বাম আলাদা, কংগ্রেস আর তৃণমূল এক সঙ্গে লড়লে বিজেপি ৪০-৫০টার বেশি আসন পাবে না। ২০২৬-এ শুভেন্দুর বয়স ৫৫, হাতে ৫০টা এমএলএ, মুখ্যমন্ত্রীর কূর্সি ক্রমশ দূরে আরও দূরে সরে যাচ্ছে না? এবং যদি এরমধ্যে বিজেপির সরকার পড়ে যায়? পড়ে যাবেই এ কথা বলছি না কিন্তু যদি পড়ে যায়, বিজেপির ভোট রকেট গতিতে নামবে, সেক্ষেত্রে ছবি আরও ঝাপসা। তাহলে গোলপোস্ট ২০২৬ থেকে সরিয়ে ২০৩১-এ নিয়ে যেতে হয়। ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকবে ওনার গোলপোস্ট, ওনার টার্গেট। এখন তো নতুন করে ভাটা লেগেছে, উত্তরবঙ্গে যে ফাটল হয়েছে কোচবিহারে, সেখান থেকেই ফাটল বাড়বে। এবার সব মিটে গেছে, মতুয়ারা এবারে তো বুঝে নিতে চাইবে, এরকম আরও হাজারো সমস্যা ঘিরে ধরবে শুভেন্দু অধিকারীকে। সংখ্যালঘু ভোট ভাগ না করতে পারলে, দুই বুথ লেভেল পর্যন্ত সংগঠন না গড়ে উঠলে, রাজ্য বিজেপির এই চুড়ান্ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বন্ধ না হলে আর কেন্দ্রে বিজেপির সরকার এরকম নড়বড়ে থাকলে শুভেন্দুকে ভূতের রাজার বর পেতে হবে, ভূতের রাজার বর পেলেই একমাত্র ওনার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি দখল করা সম্ভব, তাছাড়া ওনার লক্ষ্য সেই কুর্সি অধরাই থেকে যাবে।