আদি আর নবর লড়াই আজকের নয়, বহু প্রাচীন। প্রাচীন মানুষদের মাথায় জমাট বাঁধে তাঁদের অভিজ্ঞতা, সে অভিজ্ঞতা যেন হিমালয়, তাকে নাড়ানো কঠিন। সে অভিজ্ঞতা এক অলিখিত নিয়মাবলি, এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করে, তাকে উল্লঙ্ঘন করা কঠিন হয়। অন্যদিকে নবীনের দল হারে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে, যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে। তারা নিয়ম মানে না, বাধা মানে না, তার মাথায় ঘোরে সেই অমোঘ প্রশ্ন, কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারিদিকে তার বাঁধন কেন? ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাঁধন, সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পর আঘাত কর্।
মাতিয়া যখন উঠিছে পরান, কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!
উথলি যখন উঠিছে বাসনা, জগতে তখন কিসের ডর!
সে নিয়মকে অতিক্রম করে নতুন নিয়ম তৈরি করে, নতুন অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরে তারপর সেই অভিজ্ঞতাই আবার তাকে প্রাচীন করে তোলে। একে অন্যের পরিপূরক হলেও নবীন আর প্রবীণের, আদি আর নবর লড়াই আজকের নয়, যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। রাজনীতিতে তো তা এক বিরাট আকার ধারণ করে। ভারতবর্ষের সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকেই তাকান না, এমনকী গান্ধী-নেহরুর মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অবশ্য প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাতেই যায় শাসনের ভার কিন্তু কিছুদিন পরেই নেহরুর মৃত্যু এবং সেই আদি নব দ্বন্দ্ব কেবল নয় আদি কংগ্রেস, নব কংগ্রেসও তৈরি হয়ে গেল। একদিকে প্রবীণ পক্ককেশ নেতাদের দল অন্যদিকে এক গুঙ্গি গুড়িয়া ক্রমশ ইন্দিরা হয়ে উঠছেন। সেই লড়াই অন্য দলেও হয়েছে, সমাজবাদী দলের রাশ ছিনিয়ে নিয়েছেন অখিলেশ, লালু জেলে, হাল ধরেছেন তেজস্বী। আদবানি, জোশি, উমা ভারতীরা গেছেন অস্তাচলে, এন টি রামারাওকে বসিয়ে রেখেই চেয়ার দখল করেছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। স্তালিন করুণানিধি থাকাকালীনই রাশ নিজের হাতে নিয়েছিলেন, এরকম বহু উদাহরণ আছে। আমাদের বাংলাতেও কি নতুন করে আদি-নবর দ্বন্দ্ব শুরু হল? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে তৃণমূল আদি, তৃণমূল নব এবং তাদের বিভিন্ন গল্পগাছা।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলায় নতুন বছরে কি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হবে?
তৃণমূলে এক বিরাট সময় ধরে আদি নব এসব নিয়ে কোনও বাওয়াল ছিল না। ছিল না কারণ পুরোটাই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পোস্ট একটা বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। আমি বলছি না, প্রবীণ তৃণমূল নেতারা এই কথা অনায়াসে বলতেন। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের পর থেকে একটাই পোস্ট এটা বলা বন্ধ হয়েছে, সেখানেও একটা ক্ষমতা কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। দলের এক অংশ সেদিকে ভিড় জমিয়েছেন। বলা বাহুল্য এনারা বয়সে তরুণ, টিম অভিষেক বললে ভুল হবে না। অন্যদিকে এতদিন মমতার অনুগত কিন্তু সিনিয়র নেতারা কোন দুঃখে অভিষেক শিবিরে যাবেন? বা বলা ভালো, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ বলে হাঁক দেবেন? পুরনো কিন্তু বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীনেরা কিন্তু সেই হাঁক দিতে দ্বিধাবোধ করছেন না। এবং তার সঙ্গে অভিষেক এক অন্য পথে দলকে নিয়ে যেতে চান। কিছু শিক্ষিত মানুষ আসুক, কর্পোরেট ধাঁচের এক কাঠামো তৈরি হোক, রিসার্চ টিম, সোশ্যাল মিডিয়া টিম থাকুক, ওই আই প্যাক ইত্যাদিও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বা নব তৃণমূলের বেশি পছন্দ। হুড়মুড় করে চোর চোট্টা অশিক্ষিত কিন্তু বহুদিনের খুঁটিকে বাদ দিয়ে আপাত সৎ শিক্ষিত এক কাঠামো হোক, দলের জন্য টাকা লাগুক, লাগবেও, তা আনার ব্যবস্থা হবে কিন্তু বালি চুরি, কয়লাচুরি বা গরু পাচার করে নয় এমন একটা কথা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ এক ধরনের শুদ্ধিকরণও বটে। আবার দলের কিছু লোকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তোলাবাজি, অন্য দলের মানুষদের নির্বাচনে নমিনেশন দিতে না দেওয়া এসব নিয়েও অভিষেক সরব। ওদিকে প্রাচীনপন্থীরা এসব তো আগের জমানা থেকে ইনহেরিট করেছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তোলাবাজি, অগণতান্ত্রিক কাজকর্মে তাঁদের দক্ষতা বরং বেড়েছে। এই দুই ধারণার দ্বন্দ্ব লেগেছে।
প্রবীণেরা মনে করছেন চ্যাংড়া ছেলে কত ধানে কত চাল চেনে না, ভোটে হারাবে। নবীনেরা মনে করছে রাজনীতির কাঠামোটাকে পাল্টাতে হবে, কিন্তু রাজনীতি করার উদ্দেশ্য কি তারা বদলাতে পারবে? দু’ পয়সা কামাই না হলে পলিটিক্স করব কেন? এই প্রশ্ন কি উঠবে না? যদি পঞ্চায়েত প্রধান হওয়ার জন্য ১০ লাখ খরচা হয় তাহলে দু’ তিন কোটি রোজগার তো করতে হবে, এর বিপরীতে যে আদর্শ তা কি অভিষেক দিতে পেরেছেন? প্রবীণেরা জানেন তা সম্ভব নয়, কাজেই ওসব ছোটখাট মাস্তানি, তোলাবাজিতে চুপ করে থাকতে হবে, তাঁরা নিজেরাও অন্য পথে তো চলছেন না। সব মিলিয়ে এক গোলমেলে লড়াই। সেই লড়াই কি শুরু হয়ে গেছে তৃণমূলে? কিছু মানুষ এরকম ভাবছেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন ওই আদি ও নব তৃণমূলের কারও কাছেই কি অন্য কোনও অপশন আছে? বা এই লড়াইকে ইস্যু করে তৃণমূলে শরদ পাওয়ারের এনসিপি-র মতো এক ভাঙন কি সম্ভব? সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন, সেই প্রশ্নই আমরা আমাদের দর্শকদের করেছিলাম, আদি তৃণমূল আর নব তৃণমূলের যে লড়াই, সংঘাত, দ্বন্দ্ব বেধেছে তা কি তৃণমূলকে আড়াআড়ি ভেঙে দিতে পারে? শুনুন কী বলছেন মানুষজন।
কমিউনিস্ট পার্টিতে অবশ্য আদি নবদের কোনও দ্বন্দ্বই নেই। সেখানে পলিত কেশ ইকুয়ালটু নেতা, একমুখ কালো দাড়ি, ঝাঁকড়া চুল নিয়ে যাঁরা ক্ষমতা দখল করলেন হয় তাঁরা মারা গেলেন বা তাঁরা ক্ষমতা থেকে যখন সরলেন তখন প্রতিটা চুল পেকেছে, আসনে বসে থাকার মতো অবস্থাও নেই। সেখানে নবীন প্রবীণের লড়াই হয় না, এক গোষ্ঠীর প্রবীণের নেতৃত্বে প্রবীণ নবীনের দল অন্য গোষ্ঠীর প্রবীণ ও নবীনদের সঙ্গে লড়ে যেতে থাকেন, তার এক গালভরা নামও আছে ইনার পার্টি স্ট্রাগল। খুব কম বয়সেই, নবীন অবস্থাতেই কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় এসেছেন এমন একজনের নামই আপাতত মনে পড়ছে, সিপিআইএমএল লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক বিনোদ মিশ্র মারা যাওয়ার পরে ৩৮ বছর বয়সে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য দলের হাল ধরেন। তবে আড়ে বহরে এই দল এত ছোট যে এই ব্যতিক্রম কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যতিক্রমই থেকে গেছে। ৬৫ বছর বয়সে মহম্মদ সেলিম সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন, ৬৮ বছর বয়সে বিমান বসু রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন। এটাই কমিউনিস্ট পার্টির ধারা। সে তুলনায় ইন্দিরা, রাজীব, রাহুল, অখিলেশ, তেজস্বী, স্তালিন, চন্দ্রবাবু, জগন রেড্ডি ইত্যাদিরা অনেক আগেই দলের রাশ হাতে পেয়েছেন। বাংলায় কি সেই রাশ অভিষেকের হাতে আসছে? কাল সেই আলোচনায় নামব।