আমরা এক অদ্ভুত ফেসবুক পৃথিবীতে বাস করি। যেখানে প্রতিটা মানুষ নৈতিকতার কথা বলে, সততার কথা বলে, কারও দুঃখে কষ্ট পায়। এখানে সবাই সৃষ্টিশীল, এখানে কেউ গান গায় তো অন্যজন সুর দেয়, একজন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক তো অন্যজন বিরিয়ানি শুঁকেই বলে দিতে পারে তার চালের নাম। এখানে সব্বাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সিলেকটিভ অন্যায় অবশ্যই, ধরুন পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সিবিআই বা ইডি ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পার্থের এই চুরি কাণ্ডের প্রতিবাদ, বা ধরুন কেষ্ট মোড়ল তো তিহারে, কাজেই সেই অনাচার দুরাচারের প্রতিবাদ। আমরা প্রতিবাদ করি ইউক্রেন যুদ্ধের বা গাজা স্ট্রিপে বোমা ফেলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। যেখানে খবরটা ট্রেন্ডিং, মানে অনেক লোকে লাইক দিচ্ছে বা কমেন্ট করছে সেখানেই আমাদের চোখ থাকে, বিষয় নয়, যাহা চোখ কাড়ে সেই পানে ধায় আমাদের প্রতিবাদ, ভালোলাগা, ভালোবাসা, লাইক লাভ অ্যাংরি বা টেক কেয়ার। আমি যদি বলি আপাতত সেই থিওরি মেনেই তিলোত্তমার মায়ের কষ্ট প্রত্যেক বুকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ওই থিওরি মেনেই, ওটাই ট্রেন্ডিং, আমি জানি বিপ্লবীরা এসে আমার গলার মাপ চাইবেন। চান তাতে ক্ষতি নেই, তবু আমি জিজ্ঞেস করব, তিলোত্তমার মায়ের কষ্ট যাঁরা বুঝতে পারছেন, যাঁরা সেই ব্যথা অনুভব করতে পারছেন, যাঁরা সেই ধর্ষণ, হত্যা আর অবহেলার বিরুদ্ধে দোষীদের শাস্তি চাইছেন, যাঁরা সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাত জাগছেন, মিছিল করছেন, রাত দখল করে দিন বদলানোর কথা বলছেন, সেই তাঁরা চুপ কেন কোন্ননগরের বিক্রমের ঘটনায়? সেটাই বিষয় আজকে, তিলোত্তমার মা, কোন্নগরের মা।
এক অদ্ভুত আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার নেতৃত্ব প্রতিদিন তাঁদের গোলপোস্ট বদলে বদলে দিচ্ছেন। প্রতিদিন। জুনিয়র ডাক্তারদের বন্ধু সহকর্মী খুন হয়েছেন, ধর্ষিতা হয়েছেন, সেই ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত বলে মনে করছেন তাঁরা। যে সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করা হয়েছে সে নাকি নিতান্ত এক বোড়ে। এবং তাঁদের ধারণা এই কলকাতা পুলিশও এই তদন্ত ঠিক করে চালাবে না, তারাও কাউকে কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, কাজেই সেই তদন্তের ভার গেল সিবিআই-এর হাতে, রাতারাতি।
আরও পড়ুন: Aajke | উৎসবে ফিরুন: মমতা
এবার কাজে ফিরুন, না তাঁরা জানালেন, তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত মনে করছেন না। বেশ, ততদিনে মামলার দেখরেখের ভার নিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত, তো তেনারা সিআইএসএফ-এর ব্যবস্থা করলেন, ওমনি তিন কোম্পানি সিআইএসএফ এসে হাজির, হাতে এলএমজি, কার্বাইন, একে গোত্রের অস্ত্র। এবারে কাজে ফিরুন, না, তাঁদের দাবি কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দিতে হবে। তারপর তাঁরা ডিসি নর্থকে সরাতে বললেন। এদিকে আবার বসেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা, তাঁরা জানালেন অনেক হয়েছে এবারে ফিরুন, রাজ্য সরকারকে বললেন সব সুরক্ষার দায় নিতে হবে, বললেন এই কর্মবিরতির জন্য কোনও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। আর জুনিয়র ডাক্তারদের বললেন আজ, মানে মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে তাঁদের কাজে ফিরে আসতে হবে। ওঁরা এরপরে রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার ইস্তফাও চাইছেন। আন্দোলন প্রতিবাদ আমাদের মৌলিক অধিকার, কিন্তু সেই আন্দোলনের একটা যৌক্তিকতা তো থাকতে হবে, স্বাস্থ্য পরিসেবার মতো এক জরুরি ব্যবস্থা আজ এক মাস হতে চলল জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের কর্মবিরতি চালিয়েই যাচ্ছেন। এবং তাদের সমর্থনে মানুষও পথে। ভালো। কিন্তু সেই একই আরজি করে কোন্নগর থেকে একজন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক রোগী আসলেন, তখনও ব্লিডিং হচ্ছে। তাঁর মা, বাড়ির লোকজনেরা একবার এ বিল্ডিং সে বিল্ডিং করছেন, কারও দেখা পাচ্ছেন না। সেই কোন্নগরের মা কাঁদছেন হাউ হাউ করে, তাঁর একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে। একজন ডাক্তার, যিনি শঙ্কর গুহনিয়োগীর লড়াইয়ে একদা শামিল হয়েছিলেন, যিনি গরিবস্য গরিবদের চিকিৎসা করার শপথ নিয়ে সেই লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন, সেই পুণ্যব্রত গুণ জানালেন ছেলেটি এমনিই মারা গেছে, কারও কোনও গাফিলতিই নেই। আশ্চর্য। একজন আইপিএস অফিসার বলছেন, আমি কোনও টাকা দেওয়ার কথাই বলিনি, তিলোত্তমার মা বলছেন দিয়েছে, মানুষ সেটাই মানছে, আমরাও মানছি অথচ এক মা বলছেন আমার ছেলে চিকিৎসা পায়নি, ওঁর কথা শুনতে আমরা রাজি নই? কেন? কারণ ছেলেটি ডাক্তার ছিল না? মেধাবী ছিল না? তার অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে বলে? তিলোত্তমার মায়ের কষ্ট আমরা অনুভব করলাম আর কোন্নগরের মা একলা বসে কাঁদবে? আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, তিলোত্তমার মৃত্যু নিয়ে উত্তাল বাংলা, প্রতিদিন মিছিল, মিটিং চলছে আর কোন্নগরের মা নিয়ে একটা কথাও নেই কেন? যে ২৪ জন মানুষ এই ধর্মঘটের সময়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন তাঁদের নিয়ে কেউ কথা বলবে না? কেন বলবে না?
এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফলে যদি আর এক প্রবল অন্যায়েরই জন্ম হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে কোথাও বিরাট একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। ভুল হচ্ছে কারণ আমাদের এই সোজা সরল প্রতিবাদের আগুনে বেশ কিছু মানুষ রুটি সেঁকে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আন্দোলন হোক, কারও প্রাণের বিনিময়ে নয়। আমরা তিলোত্তমার মায়ের পাশে আছি, থাকব। আমরা কোন্নগরের মায়ের সঙ্গেও আছি, আমরা বিক্রমের মৃত্যুর বিচার চাইছি, দোষীদের শাস্তি চাইছি।