নমস্কার আমি অদিতি, শুরু করছি কলকাতা টিভির আর নতুন নয়, ইতিমধ্যেই ৬৫ টা এপিসোড হয়ে গেছে,হাজির আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে, সাদা কালো। একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, ধাঁধার চেয়েও জটিল হল সিপিএম।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যাত্রা শুরু করেছিল সেই ১৯২৫-এ। দল গঠন হয়ে দলের প্রথম সম্মেলন, বা পার্টি কংগ্রেস হতে হতে সেই ১৯৪৩। তারপরে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস হয়েছিল মাদুরাইয়ে, পরে নবম কংগ্রেস হয়েছিল ওই মাদুরাইতে, এবারে আবার সেই মাদুরাইতে শুরু হচ্ছে ২৪তম পার্টি কংগ্রেস। এরমধ্যে তৃতীয় চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন অজয় ঘোষ, ষষ্ঠ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হবার পরে তিনি মারা যান, দায়িত্ব নেন শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে,এরপরে সপ্তম পার্টি কংগ্রেস হয় কলকাতায়, দল ভেঙে যায়, সিপিএম তৈরি হয়। না, তারপর থেকে এই বাংলা থেকে কেউই সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক হননি। সেই ১৯২৫-এ যাত্রা শুরু করে আরএসএস আজ দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছে, কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ কলেবরে, প্রভাবে খাটো হয়েই চলেছে। একদা বাংলা, ত্রিপুরা আর কেরালার মধ্যে কেরালাই হাতে পড়ে আছে, সেটা চলে গেলে সংসদীয় গণতন্ত্রে সিপিএম আরও গুরুত্ব হারাবে। শুরুর দিকে এক ধরনের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ছিল কমিউনিস্টদের, এমনকী জওহরলালের মতো এক সমাজতান্ত্রিক ঘোর ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও আক্ষরিক অর্থেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মকে এক ধরনের শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা বলেই মনে করতেন। অন্যদিকে সমাজবাদীদের সঙ্গে ছিল নানান ঝামেলা, সবমিলিয়ে কমিউনিস্টরা সেই শুরুয়াতি দিনগুলোতে খানিক একলা চলো রে নীতি নিয়েই চলতেন। তারপর এই বাংলাতে ক্ষমতা দখলের জন্যই তাঁরা যুক্তফ্রন্ট তৈরি করলেন কিন্তু সেখানেও তাঁদের হেজিমনি বজায় রাখতে গিয়েই সেই যুক্তফ্রন্ট ভেঙেছে, এরপর এসেছিল জরুরি অবস্থা, ওদিকে বহুদিন জনবিচ্ছিন্নতায় ভুগতে থাকা আরএসএস জনসংঘ বুঝেছিল, এই সুযোগ হাত থেকে যেতে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির এক অংশ থাকলেন কংগ্রেসের সঙ্গে আর সিপিএম কনফিউজড, তাঁরা না পারলেন ঝান্ডা ফেলে জয়প্রকাশ আন্দোলনে ঢুকে পড়তে, না পারলেন একক শক্তির বলে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বড় কোনও লড়াই গড়ে তুলতে। ওদিকে জনসংঘীরা কিন্তু ঝান্ডা ইত্যাদি ফেলেই জনতা দলে ঢুকে গেলেন, সারা ভারতে না হলেও উত্তর ভারতে তাঁদের সংগঠন ছড়িয়ে গেল। জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পরেই এক ঝটকায় জনসংঘীরা দেশের ক্ষমতার ভাগেদার, দেশের রাজনীতিতে একটা জায়গা করে নিলেন। কমিউনিস্টরা বাংলার মসনদ পেয়েই খুশি। এবং সেই থেকে শুরু হয়ে গেল কোয়ালিশন সরকারের খেলা। আসুন সেটাকে অন্যদিক থেকে বোঝার চেষ্টা করি।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | মোদিজি ঠিক করে দিচ্ছেন কোন সিনেমা আপনি দেখবেন, কোনটা দেখবেন না?
জরুরি অবস্থার পরে কেবল জনসংঘীরাই উঠে এলেন তা তো নয়, জায়গা পেলেন সমাজতন্ত্রীরাও, লালু, মুলায়ম, নিশীথ, জর্জ ফার্নান্ডেজ, শরদ যাদব ইত্যাদিরা মাঝমাঠেই ছিলেন এবং তাঁরা দেশের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন। এই জাতিগত ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশই ছিল দেশের গরিবগুর্বো মানুষ যাদের রাজনীতির আখড়ায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা ছিল কমিউনিস্টদের, তাঁদের বদলে সে মাঠের খেলোয়াড় হলেন সমাজতন্ত্রী বা সমাজগণতন্ত্রীরা, ওদিকে আপার কাস্ট ব্রাহ্মণ, গর্বিত হিন্দুদের চাহিদা পূরণে এগিয়ে এল আরএসএস–বিজেপি।
কমন্ডল আর মন্ডল রাজনীতির ঘমাসান লড়াইয়ে অনেক পিছিয়ে পড়লেন কমিউনিস্টরা, কিন্তু টিকে ছিলেন বাংলা, ত্রিপুরা আর কেরালাতে। সমাজতন্ত্রীরা সীমাবদ্ধ থাকলেন গোবলয়ে, দক্ষিণে ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছে ডিএমকে, এআইডিএমকে, তেলুগু দেশম, শিবসেনা তাদের ভাষা আইডেন্টিটি পলিটিক্স নিয়ে। আর এরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে কমিউনিস্টদের জমি কেড়ে নিয়েই তাঁদের শক্তি বাড়িয়েছে। ক্রমশ সেই আইডেন্টিটি পলিটিক্স ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতায় এল, ওড়িশাতে ক্ষমতায় এল। কমিউনিস্টরা তখনও চোখের মণির মতো ধরে রেখেছিল বাংলা, ত্রিপুরা আর কেরালাকে। তাঁরা একসময়ে বিরাট শক্তিশালী ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, দিকপাল সমস্ত নেতা সেখান থেকে এসেছেন, বিরাট বিরাট লড়াই হয়েছে, সে সব ইতিহাসের পাতায় চলে গেল। তাঁরা হরকিষণ সিং সুরজিতের আমল থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে ভালো ড্রাফটসম্যান হয়েই থেকে গেলেন, কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম লেখা, জয়েন্ট পিটিশন দেওয়া, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা, এসব চিঠি আর দলিল মুসাবিদা করার ক্ষেত্রে তাঁরা হয়ে থাকলেন আন প্যারালালড, এই সেদিন পর্যন্ত ইন্ডিয়া জোটের এমন কিছু ডকুমেন্টে সীতারাম ইয়েচুরি বিরাট ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু মাঠের রাজনীতি, ভোটের রাজনীতি সেখানে তাঁরা এক ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া শক্তি, দেশ জুড়েই। সেই তাঁদের পার্টি কংগ্রেস ২৪তম পার্টি কংগ্রেস শুরু হল মাদুরাইতে, যখন বাংলার বিধানসভাতে তাঁদের একজন সদস্যও নেই। জর্জি ডিমিট্রভ দিয়ে গিয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের তত্ত্ব, কমিউনিস্টরা বড় শত্রুকে হারানোর জন্য যুক্তফ্রন্ট তৈরি করবে, কিন্তু এরই মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা বাড়িয়ে চলবে, এটাই ছিল মূল কথা। কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি, যুক্তফ্রন্ট করেছে দেশের সব দলের সঙ্গে, হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই সব দলের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপি, অকালি দল, সমাজবাদী, কখনও এআইডিএমকে, কখনও ডিএমকে, আবার কখনও বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস থেকে শুরু করে শিবসেনাকেও সমর্থন করার ইতিহাস তাঁদের আছে। কিন্তু এই যাবতীয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের শেষে তাঁদের শক্তি আরও কমেছে, ইন ফ্যাক্ট তাঁরা এখন কেরালা বাদ দিলে অন্যের আলোয় আলোকিত, দুজন এমপি তামিলনাড়ু থেকে, ডিএমকের সঙ্গে সমঝোতা ভেঙে গেলে দুটোর একটাতেও জেতার ধারেকাছেও থাকবেন না, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় রাজস্থানের সিকরের আসনে অমরা রাম জিতেছেন, সমঝোতা না হলে অর্ধেক ভোটও পাবেন না। কেবল একটা আসন কেরালার আলাথুর জিতেছে সিপিএম নিজের কব্জির জোরে। সেই সিপিএম এখন আর এক জোটেও আছে, তাঁরা অবশ্য ইন্ডিয়া ব্লককে জোট বলেন না, কী যে বলেন তা অবশ্য মানুষ বোঝে না। যেমন ধরুন আজই তাঁদের পার্টি কংগ্রেসের শুরুয়াত যেখানে এই বাংলার প্রতিনিধিরা মনে করেন তৃণমূল হল বিজেপির বি টিম, সেই পার্টি কংগ্রেসের কেরালার প্রতিনিধিরা বলেন কংগ্রেস হল বিজেপির বি টিম, অথচ এনাদের বাংলায় মুখপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে ইন্ডিয়া ব্লক একযোগে বিরোধিতা করবেন ওয়াকফ বিলের, এর থেকে বড় ধাঁধা আর কোথাও দেখেছেন? সিপিএম এখন এক বিরাট কনোনড্রাম, এক বিশাল ধাঁধা।