নমস্কার আমি অদিতি, শুরু করছি কলকাতা টিভির আর নতুন নয়, ইতিমধ্যেই ৬৫ টা এপিসোড হয়ে গেছে,হাজির আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে, সাদা কালো। একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, মোদিজি ঠিক করে দিচ্ছেন কোন সিনেমা আপনি দেখবেন, কোনটা দেখবেন না?
গত শুক্রবার মালয়ালম ফিল্ম এমপুরান মুক্তি পেয়েছে। গুজরাট দাঙ্গার প্রেক্ষিতে এই ছবি তৈরি করা হয়েছিল, এবং স্বাভাবিকভাবেই ‘এমপুরান’ সেন্সর বোর্ডে আটকে গিয়েছিল, এবং ১২টি দৃশ্য বাদ দেওয়ার পরে চলচ্চিত্রটিকে মুক্তির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেবল তাই নয়, মুক্তির পরে ছবির নায়ক মোহনলাল তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন যে ছবির কিছু বিষয় দর্শকদের মনে আঘাত দেবে তা ওনারা বুঝতে পেরেই নিজেরাই ১২টা দৃশ্য কেটে ফেলে দিয়ে ছবি রিলিজ করেছেন। মানে দাঁড়াচ্ছে ওনারা ছবির স্ক্রিপ্টের সময় জানতেন না, ছবি শুটিংয়ের সময়ে জানতেন না, এডিট বা ছবি শেষ করার সময়েও জানতেন না যে এই ছবির বিষয় দর্শকদের মনে আঘাত দেবে, জানলেন কখন? যখন তাঁদের ছবি সেন্সর বোর্ড আটকে দিল। এরকম উদাহরণ কি একটা নাকি? অসংখ্য, পদ্মাবতীর পরিচালক ছবির নামটাই বদলে পদ্মাবত করে দিলেন, না রহেগা বাঁশ না বজেগা বাঁশুরি। এই মালয়ালম ছবির ক্ষেত্রে সেন্সর বোর্ড চলচ্চিত্রটির কিছু দৃশ্যে আপত্তি জানিয়েছিল, যা তাদের মতে, নাকি সামাজিক ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে আঘাত করতে পারে। ব্যস, ছবি তৈরির সেই শুরুয়াত থেকে বছর দেড়েক কেটে যাওয়ার পরে তাঁরা বুঝে গেলেন সেটা, বাদও দিয়ে দিলেন। হ্যাঁ এইভাবেই সিনেমা কোনটা হবে, তাতে কী দেখানো হবে, কোন ছবি মানুষের দেখা উচিত, সবটাই ওই মোদিজি, আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দল ঠিক করে দেবে। যেমন এক্ষেত্রে ওই মালয়ালম চলচ্চিত্রের পরিচালক, পৃথ্বীরাজ সুকুমারন, সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তকে নাকি সম্মান জানিয়েছেন এবং চলচ্চিত্রটিকে মুক্তির জন্য নাকি নিজে থেকেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে রাজি হয়েছেন। যদিও তিনি জানিয়েছেন, চলচ্চিত্রের মূল গল্পে কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি, শুধুমাত্র কিছু আপত্তিকর দৃশ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। এরকম বার বার ঘটে চলেছে। কেউ বলছেন না, অন্তত যে সব অভিনেতা, অভিনেত্রীদের আমরা দেখেছি মনমোহন সিং জমানাতে বহু বিষয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে, তাঁদের মুখে তালা, টিমটিম করে জ্বলছে এখনও প্রতিবাদের কয়েকটা প্রদীপ যাঁরা বলছেন এই সিদ্ধান্ত চলচ্চিত্রের শৈল্পিক স্বাধীনতা ও অভিব্যক্তি কেড়ে নিচ্ছে। বাংলার চলচিত্র মহলে তো আপাতত এই বিক্ষিপ্ত সময়ে মুজরো নাচ চলছে, ভাবা প্র্যাকটিস ছেড়ে আপাতত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন তাঁরা, কোথাও কোনও প্রতিবাদ নেই। ২০১৪-এর পর থেকে ভারতের সিনেমা জগৎ, বিশেষ করে বলিউড, বেশ কিছু সিনেমার মুক্তির আগে সেন্সর, বিক্ষোভ আর বদল, বয়কটের মুখে পড়েছে। এর পেছনে প্রায়ই হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গোষ্ঠী আর সমাজের চাপ আছে, আর সেটা গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই। এটাই ২০১৪ র পর থেকে রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটা ছবি, নরেন্দ্র মোদির জমানার ছবি। সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন ভারতে সিনেমা সেন্সর করে। তাদের যে বিষয়গুলো আপত্তিজনক মনে হয়— যেমন যৌনতা, হিংসা, বা রাজনৈতিক কথা— সেগুলো কেটে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কিন্তু তার এক নতুন প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। ২০১৪-এর পর থেকে সরকারি চাপের পাশাপাশি কিংবা রিলিজের বহু আগে থেকেই তাদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, মিছিল, বয়কটের ডাক আমরা শুনেছি। তাঁরা সরাসরি বলছেন এই সিনেমাগুলো হিন্দু-বিরোধী বা হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি অসম্মানজনক, অতএব এগুলোকে রিলিজ করতে দেব না, রিলিজ হলে চলতেই দেব না। পদ্মাবত, পিকে, হায়দর, থেকে এমপুরান সেই কথাই বলছে। এবারে চলুন অন্যদিক থেকেও বিষয়টাকে দেখা যাক।
হ্যাঁ, ওনারা শুধু কী চলবে না সেটাই বলছেন না, কোনটা চলবে কোনটা চালাতে হবে সেটাও বলে দিচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদি নিজে হাজির থাকছেন সেসব সিনেমার শোতে, বলছেন কাশ্মীর ফাইলস সবার দেখা উচিত, বলছেন যে কেরালা স্টোরিকে ট্যাক্স ফ্রি করা হল। একটা গ্র্যান্ড পরিকল্পনা আছে এর পেছনে। ২০১৪-এর পর থেকে বলিউড হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদের জোশ বাড়ানোর জন্য সিনেমা বানাচ্ছে, আপনি এতদিন দেশপ্রেমিক ছিলেন না, এবারে দেশপ্রেমিক হন, হয়ে উঠুন, মুসলমানেরা কীভাবে হিন্দুদের উপরে অত্যাচার করেছে, সেটা দেখুন, না ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা নয়, সে সব ছবি বানানো বন্ধ। যেটা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডাকে তুলে ধরছে। দুটো মূল ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে। ১) হিন্দুত্ব মানে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যা ভারতকে হিন্দু দেশ হিসেবে দেখে, আর মুসলিম-খ্রিস্টানদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে। ২) জাতীয়তাবাদের জোশ মানে তীব্র দেশপ্রেম, যেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজতে থাকে। বলিউডের আপাতত এই দুটো কাজ, হিন্দুত্ববাদকে তুলে ধরা, হিন্দুদের উপরে মুসলমান অত্যাচারের কাহিনিকে এনলার্জ করে মানুষের সামনে হাজির করা আর পাকিস্তান বিরোধী এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে এক উদ্ভট দেশপ্রেমের ছবি বানানো। ২০১৪-এর পর থেকে ইন্ডাস্ট্রির কিছু অংশ বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, অবশ্যই প্রাপ্তির বিনিময়ে, অন্যদিকে যারা সরকারের বিরুদ্ধে বলত, যারা সিনেমাকে এক প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত তাঁরা হয় সাররিয়েল কিছু বিষয়ে ছবি করে বিদেশ ভ্রমণ করছেন, না হলে হাত মিলিয়েছেন আরএসএস-বিজেপির সঙ্গে। অতএব বদলাচ্ছে সিনেমা। ২০১৪-এর পর যে সিনেমাগুলো হিন্দুত্ব আর দেশপ্রেমের জোশ ছড়িয়েছে, তার ক’টা উদাহরণ দেওয়া যাক।
পিএম নরেন্দ্র মোদি (২০১৯): মোদির বায়োপিক, ২০১৯-এর ভোটের সময় মুক্তি পায়। এটা বিজেপি আর হিন্দুত্বের পোস্টার বয় মোদিকে লার্জার দ্যান লাইফ করে তোলার চেষ্টা। দেশের আর কোন জীবিত নেতাকে নিয়ে এমন ছবি হয়েছে, এটা কুইজের প্রশ্ন হতেই পারে।
আর্টিকল ৩৭০ (২০২৩): বিজেপির আর্টিকল ৩৭০ তুলে নেওয়ার গল্প, জাতীয় ঐক্য আর হিন্দুত্বের জয় বিজেপির নির্বাচনী এজেন্ডাকে তুলে ধরে।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস (২০২২): কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গল্প, মুসলিমরা অত্যাচারী, হিন্দুরা নির্যাতিত। বিজেপি হিন্দুত্বের বিরোধী-সংখ্যালঘু ভাবনার সঙ্গে খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ। কাজেই এই ছবি বিজেপি রাজ্যে ট্যাক্স ফ্রি হয়।
দ্য কেরালা স্টোরি (২০২৩): কেরালার মেয়েদের ইসলামে ধর্মান্তর আর আইএসআইএস-এ যোগের গল্প। মুসলিম-বিরোধী, হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে মিলে এক ঝাঁঝালো ককটেল।
উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক (২০১৯): পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেনার স্ট্রাইকের গল্প। দেশপ্রেমের জোশ জাগায়, ‘নয়া হিন্দুস্তান’ বলে চিৎকার শুনেছি সিনেমা হলেই, মনে হচ্ছিল সেই মানুষগুলোকে ছেড়ে দিলে তারা পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে এখনই বর্ডারে চলে যাবে। অসংখ্য, অসংখ্য এরকম সিনেমা, কিছুদিন আগেই ছাবা দেখলাম, আরও অনেক। কেবল সিনেমা নয় ওটিটি সিরিজেও একই হাল।
২০১৪-এর পর থেকে এমন সিনেমা বেড়েছে, বিশেষ করে ভোটের সময় দেখেই সেগুলোকে রিলিজ করা হচ্ছে। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ বা ‘আর্টিকল ৩৭০’ বক্স অফিসে হিট, গবেষণা বলছে, প্রায় ৪০টা সিনেমা এই ধরনের হয়েছে কেবল ২০১৪-র পর থেকে। বিজেপি ট্যাক্স ছাড় আর প্রচার দিয়ে এগুলোকে সাহায্য করে, ফলে নির্মাতারা সরকারের বিরুদ্ধে ছবিতে কিছু থাকলে নিজেরাই বাদ দিয়ে দেন, প্রতিবাদী কোনও কথা আছে তেমন সিনেমাতে পয়সা ঢালতে ভয় পায়। এবং তাকিয়ে দেখুন প্রতিবাদবিহীন টলিউড, কলিউড, বলিউডে রোজ ছবি তৈরি হচ্ছে, তার নায়ক নায়িকা ঝাড়পিট আর রোমান্সের নয়া নয়া তরিকাতে আমরা মুগ্ধ, অন্যদিকে সেই সব বিকিয়ে যাওয়া পরিচালকেরাই তুলে ধরছে হিন্দুত্ব আর জিঙ্গোইজমের ঝান্ডা, কারণ আরএসএস–বিজেপি–মোদিজি এখন ঠিক করে দেবেন আপনি কোন সিনেমা দেখবেন, কোন সিনেমা দেখবেন না।