যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। সেদিন এক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, প্রেসিডেন্সির ছাত্রী ২০১৯-এর শেষের দিকে ভর্তি হয়েছিল, ২০২২-এ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। এই তিন বছরে কলেজে যেতে পেরেছে ৮ মাস। অনলাইন ক্লাস কেমন হয় না হয় ইত্যাদি বিতর্কে যাচ্ছিই না, একজন ছাত্র সে তিন বছরের মধ্যে মাত্র ৮ মাস কলেজে যেতে পারল। শুনেই মনে হয়েছিল কত কিছু সে মিস করল, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, প্রেম, অপ্রেম, রাজনীতি, নতুন নতুন বিতর্ক। মানে আমাদের সেই দিনগুলোই তো স্মৃতির সবথেকে কালারফুল দিন তাই না, কারও কারও কালা জুটেছে, কারও জোটেনি, ব্রেক আপ, তর্ক বিতর্ক, মান অভিমানের সেই ক’টা বছর তাদের কেড়ে নিয়েছিল এক ভাইরাস। ঠিক এই রকম জানুয়ারির শুরুতে আমরা টের পাচ্ছিলাম, খবর আসছিল চীনে নাকি ছড়াচ্ছে, তারপর গৃহবন্দি সেই জীবন, দেশের কেবল নয় পৃথিবীর অর্থনীতি সেই যে বাগজোলা খাল হয়ে গেল, এখনও ওঠার নাম নিচ্ছে না। নাকি আবার নতুন করে সেই ভাইরাস নতুন চেহারায় ফিরছে।
খবরটা কেবল এসেছে আর ওমনি বাজার থেকে উবে গেল সাড়ে নয় লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ। শেয়ার বাজারে রক্তপাত। তাহলে আবার মাস্ক? আবার লকডাউন? আবার শৈশবের ছাদ দর্শন? আবার স্যানিটাইজার এবং মাস্ক? তো জানা যাচ্ছে যে এই ভাইরাস নাকি তেমন ভাইরাস নয়, এই ভাইরাস নাকি প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়, কাজেই মাস্ক পরুন, স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন, ইত্যাদি অ্যাডভাইস আসা শুরু হয়ে গেছে। অন্য সব কথা ছেড়ে দিন, আমার পাশের বাড়ির এক রত্তি ছেলেটা ৪ বছর বয়সে প্রথম লকডাউনের স্বাদ পেয়েছিল, প্রথমবার সারাদিন ২৪ ঘণ্টা মা আছে, বাবা আছে ঘরে, গল্প আছে, গান আছে, দিম্মার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স আছে, রান্নার রোজ নতুন এক্সপেরিমেন্ট আছে, হাইফাই সব এক্সপেরিমেন্ট, তাকে দেখি কাল মহানন্দে চিৎকার করছে আবার লকডাউন, আবার লকডাউন। এইটা হচ্ছে বাইরের চেহারা, অন্যদিকেও একটা চেহারা আছে, আসুন সেই অন্যদিকটাও দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো ।| কংগ্রেস কেরালায়, কংগ্রেস বাংলায়, কংগ্রেস দেশে
বলুন দেখি বিশ্বজোড়া সবথেকে বড় ব্যবসা কিসের? বলুন দেখি বিশ্ব জুড়ে সবথেকে বড় ইন্ডাস্ট্রি কিসের? বলুন দেখি বিশ্বে সবথেকে বেশি কী নিয়ে গবেষণা চলছে? সবকটার উত্তর কিন্তু এক এবং অভিন্ন। স্বাস্থ্য, ওষুধ আর হাসপাতাল। যে কোনও দিন গত সাত দিনের খবরের কাগজটা নিয়ে বসুন, বিজ্ঞাপনের হিসেব নিকেশ করুন, এক নম্বরে স্বাস্থ্য, মেডিক্যাল কলেজ থেকে নার্সিং হোম থেকে যোগব্যায়ামে ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে ম্যাগনেটিক বালা মায় ঝাঁড়ফুকে ক্যানসার সারানো হয়, হ্যাঁ এরাই এক নম্বরে। আর দু’ নম্বরে শিক্ষা। অথচ চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন অস্বাস্থ্য আর অশিক্ষায় দেশ আকণ্ঠ ডুবে আছে। স্বাস্থ্যের আবার বিভিন্ন রূপ, কেবল অসুখ সারানো নয়, কী খেলে অসুখ হবে না, তাও ওই একই কায়দায় বাণিজ্যের আওতায় চলে আসছে। এমন এমন খাবারের কথা বলা হচ্ছে যার নাম বছর পাঁচ ছয় আগেও ৯০ শতাংশ মানুষ জানতই না। শুনলাম চিয়া সিড খেলে ডায়াবিটিস সেরে যাবে, বস্তুটা কী? তা জানাতে ইউটিউব খুলুন। বিট রুট আর আমলকি দিয়ে কাঞ্জি তৈরি হবে, খেলেই পেটের রোগ থেকে মাথার রোগ যদি থাকে তা সেরে যাবে, ওদিকে খেলে লম্বা হয়, বুদ্ধি বাড়ে, তেমন পাউডার বড়ি তো আছেই। সেই তালিকাতেই মাস্ক, স্যানিটাইজার।
আমার পরিচিত এক বিজনেসম্যান ওই মাস্ক তৈরি করার যন্ত্র আনিয়েছিলেন, স্যানিটাইজার স্প্রে করার যন্ত্র আনিয়েছিলেন বুদ্ধি করে সেই শুরুতেই, বিনিয়োগের দশগুণ উঠে এসেছে। তিনি ফোন করলেন, আপনার কাছে কী খবর আছে বলুন তো? আবার ভাইরাস আসছে? গলার সুরে বোঝা গেল এলে তিনি আনন্দিতই হবেন। হ্যাঁ এটাই আসল ব্যাপার, আতঙ্ক বাজারে চাহিদা তৈরি করে। বেশ মনে আছে, বছর তিন চার আগে এক আতঙ্ক ছড়াল বাজারে নুন উধাও হয়ে যাচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে পাড়ার দোকানে নুন বেশি দামে বিক্রি শুরু হয়ে গেল। ঠিক সেইভাবেই আবার নতুন ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, ইমিউনিটি, মানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বাবা রামদেবের আমলা রস, অ্যালোভেরা রস বিক্রি বাড়বে, বাড়বে নানান ওষুধের চাহিদা, আসবে নতুন টিকা। মিলিয়ে নেবেন আর ফ্রিতে নয়, এবার ফেলো কড়ি মাখো তেল, না হলে হাঁপিয়ে মরো গোছের কথা ছড়িয়ে যাবে। তার প্রথম চিহ্ন আমরা দেখলাম শেয়ার বাজারে, সাড়ে ন’ লক্ষ কোটি টাকা কি কম কথা? কাজেই মাথায় রাখুন আপনি আতঙ্কিত হলে বাজারের চাহিদা বাড়বে। শেষ করব তার আগে কহানি মে একটু টুইস্ট দিয়ে যাই, একটু টেনশন, যা দেনে কা হ্যায় লেনে কা নহি, দিয়ে যাই? আচ্ছা যদি এই ভাইরাসের খবরটা সত্যি হয়? মানে আবার সেই অক্সিজেন আর প্যাকেটে মোড়া লাশ, চোখের সামনে অজস্র বন্ধুর মুখগুলো ভাসবে, ফোটোগ্রাফার রনি রায়, আমাদের অঞ্জন দা, শীর্ষ, শৌনকদা। হ্যাঁ সেই স্মৃতিই আমাদের আতঙ্কিত করে, যদি সত্যি হয়। তো একটু সাবধানে থাকুন, মাস্ক বাইরে গেলে পরুন না, ভাইরাস নো ভাইরাস জাপানিরা তো সারা বছরই ওই মাস্ক পরে কাটায়, আর হাত ধোবেন বারবার। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।