যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, এ তো সবাই জানেন। এক পরিচালক নায়কের জন্য নয়, তার জন্য ছবি হিট হয়েছে বলেই মনে করে, এক প্রযোজক মনে করে তার বিরাট প্রোমোশনের জন্যই ছবি চলেছে, না হলে পরিচালক তো ফ্লপ মাস্টার। একজন প্রকাশক মনে করে তার জন্য লেখক করে খাচ্ছে, একজন কবি মনে করে তার কবিতা না হলে পত্রিকা তো উঠেই যেত। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট মনে করে গায়কের গলা তো তার বানানো, সুরকার মনে করে তার সুরের জন্যই গায়কের পপুলারিটি। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। উর্দুতে এর জন্য এক দারুণ শব্দ আছে, গলতফহমি, ভুল ধারণা। আসলে ইনসিকিওরড মানুষেরা নিজেদের বেলুনে নিজেরাই ফুঁ দিয়ে তাকে বিরাট করে তোলার চেষ্টা করে, ভেতরে নিখাদ হাওয়া, কিন্তু সে তার বিরাটত্ব নিয়ে মজে থাকে, এমন আমরা দেখি। আর এই বাংলাতে তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল কাঁথির খোকাবাবু শুভেন্দু অধিকারী। উনি বলেন এবং মনে করেন যে উনিই করেছিলেন নন্দীগ্রাম আন্দোলন, উনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের। উনি মনে করেন যে ওনার তৈরি করা জমিতে এসে নেতাগিরি করেছেন মমতা ব্যানার্জি। সবচেয়ে বড় মূর্খামি হল উনি মনে করেন নন্দীগ্রাম আন্দোলনটা নন্দীগ্রামেরই আন্দোলন ছিল। এসব মনে করে রাতে দু’ খানা বেশি রুটি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, পরদিন আবার বদহজম গ্যাস অম্বল, অতএব আবার ভুলভাল বুকনি।
এটা ঘটনা যে পূর্ব মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের বেশ পুরনো প্রভাব প্রতিপত্তি, এটাও ঘটনা যে পূর্ব এমনকী পশ্চিম মেদিনীপুরেও শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী রাজনীতি করেছেন এবং এই এলাকাতে, জেলায় তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব আছে। কিন্তু নন্দীগ্রাম এক আন্দোলন যা সারা পৃথিবীর জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের আন্দোলনের আইকন, এক উদাহরণ। ওটা স্রেফ নন্দীগ্রাম বা মেদিনীপুরের ব্যাপার নয়। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া ছিল না? ছিল বইকি, তা সত্ত্বেও ২০০৬-এ বুদ্ধ ভট্টাচার্য ক্ষমতায় বসেছিলেন ২৩৫ জনের সমর্থন নিয়ে। কিন্তু এক জমি আন্দোলন বামেদের জমি কেড়ে নিল, তাদের সমর্থনভূমি, এই বাংলার লক্ষ লক্ষ গরিব চাষি, খেতমজুর, সংখ্যালঘু মানুষদের সমর্থন চলে গেল। কেন? তার মূল কারণ মমতা ব্যানার্জির জমি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াই। সেই অর্থে সিঙ্গুরের লড়াই আর নন্দীগ্রামের লড়াই ছিল এক সূত্রে বাঁধা। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মমতা, সারা রাজ্যের বামফ্রন্ট বিরোধী মানুষজন মমতার সমর্থনে নেমেছিলেন। আসলে আমাদের এই বাংলার রাজনৈতিক জমিতে এক বামপন্থা আছে, রাজনৈতিক লড়াইয়ে এক বামপন্থা আছে যা সেদিন মমতা তুলে নিয়েছিলেন। ভাবুন না সিপিএম বামফ্রন্ট কারখানার মালিকদের জন্য লড়ছে আর উল্টোদিকে মমতা লড়ছেন গরিব চাষি, খেতমজুরদের জন্য। এই লড়াইয়ের প্যায়দল সেনানি অনেক অনেক ছিল, এই লড়াইয়ে তাঁর পাশে অনেকেই ছিলেন, কিন্তু তাঁরা মমতার সঙ্গে ছিলেন, শোভন ববি অরূপ বেচা দোলা পূর্ণেন্দু ছিলেন, তেমনিই ছিলেন শিশির অধিকারী বা শুভেন্দু অধিকারী। নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত গ্রহ বা উপগ্রহের দল। কিন্তু হঠাৎই নিজের এই বিভ্রান্তিকে আরও বিকশিত করে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য শুভেন্দু দলবদল করলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার। এবং তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতে চাওয়ার মধ্যে তো কোনও অন্যায় নেই, গন্ডগোলটা হল তিনি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মুকুটটা পরতে চান, যা আদতে তাঁর মাথার থেকে কমসম করে ১০ সাইজ বড়। আর মহাজ্ঞানীরা বলে গেছেন বড়দের চটিতে পা গলানো ভারী অন্যায়।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ভাইরাস সত্যি, ভাইরাস মিথ্যে
এবার অন্য দিক থেকে বিষয়টাকে দেখা যাক। প্রতিদিন উনি জল দিয়েছেন সেই জমিতে, যে জমিতে আন্দোলন গড়ে উঠছে, উনি সেই মাটির লোক, প্রতিদিন সকালে সন্ধেয় তাঁকে সংগঠনের কাজে যেতে হয়েছে, আন্দোলনের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করতে হয়েছে, আন্দোলন করতে যা যা রসদ লাগে তার জোগান দিতে হয়েছে, এবং সেই সময়ে সাংবাদিকেরা তাঁকে ওই মাটিতে লেগে থাকতে দেখেছেন, তার প্রভাব আমরা নির্বাচনেও দেখেছি, ওই নন্দীগ্রাম আসন থেকে তিনি জিতেওছেন। আজ যদি তিনি সেই আন্দোলনের শিরোপা নিজের মাথায় চড়াতে চান, তাহলে ভুলটা কোথায়? সত্যি বলতে কি, বহু কষ্ট করেই ওনার মুখ থেকেই শোনা এই কুযুক্তিগুলোকে আপনার সঙ্গে রাখলাম। আসলে শুভেন্দুবাবু তো কেএফসি-তে যাননি, খাননি। সেই আমেরিকা থেকে কেএফসি এসে কলকাতা কাঁপাচ্ছে, জেনারেশন জেন নেক্সট থেকে দাদু দিদিমা পর্যন্ত কেএফসি খাচ্ছেন, মুচমুচে অথচ নরম মাংস। কিন্তু যে দোকানে খাচ্ছেন তারা সব ফ্রাঞ্চাইজি, ফর্মুলা এসেছে সেই আমেরিকা থেকে, প্রচার পরিকল্পনা তাঁদের, ব্র্যান্ড তাঁদের নইলে অমন মুচমুচে চিকেন ভাজা তো বহু জায়গাতেই পাওয়া যায়।
ঠিক সেইরকম নন্দীগ্রামের আন্দোলনের ফরমুলা এসেছিল কালীঘাট থেকে, সেখান থেকেই ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস। আর এসেছে মমতা ব্র্যান্ড। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে নন্দীগ্রাম আন্দোলন, না হলে কী হত? গেছেন তো শুভেন্দু সন্দেশখালিতে, একবার নয় বার বার, বক্তৃতা দিয়েছেন, টাকা ছড়িয়েছেন, মিথ্যে প্রচার করেছেন, সব করার শেষে ওই সন্দেশখালিতে নিজের দলের পরিচিত মুখটিকেও ধরে রাখতে পারলেন না, সুজয় মাস্টার এখন তৃণমূলে। সন্দেশখালির ব্যর্থতাই বুঝিয়ে দেয় এক হাতে এক নন্দীগ্রামের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা শুভেন্দুর কাম্য নয়, রইল বাকি ওনার নিজের কথা, সব কথায় কান দেবেন না, মহাজ্ঞানী মহাজনেরাই বলে গেছেন পাগলে কি না বলে ছাগলে কী না খায়।