যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। পৃথিবীর সব্বাই যদি এক মতের হত, সব্বাই একই সুরে কথা বলত, কী বোরিং হত সেই পৃথিবী, কাজেই তর্ক বিতর্কে সাদা কালোর দ্বন্দ্বে নানান রং ভেসে উঠুক। মাও সেতুং বলেছিলেন, শত ফুল বিকশিত হোক, যত আগাছা নির্মূল হোক। তো ভনিতা ছেড়ে শুরু করি আজকের বিষয়। মোদিজির নতুন নাটক, এক দেশ এক ভোট। ১৯৩৮, অস্ট্রিয়া দখল করেছে জার্মানি, প্রায় প্রতিবাদহীন এক দখল, ঠিক সেই সময়ে এক স্লোগানের জন্ম হল, যা জার্মান জাতিকে এক অনিবার্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। সেই স্লোগান ছিল এক সাম্রাজ্য, এক জাতি আর এক নেতা। জার্মান সাম্রাজ্য, খাঁটি আর্য জাতি আর এক নেতা, অ্যাডলফ হিটলার। সেই ইতালি আর জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শক্তি গড়ে ওঠার সময়ে আমাদের দেশের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আনাগোনা ছিল ওই ইউরোপে, তারা ওই ফ্যাসিস্ট উত্থানকে খুব ভালো করে বোঝার পরেই সেই মডেলেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আমাদের দেশকে। বি এস মুঞ্জে ইতালি থেকে ফিরে এক সৈনিক স্কুল গড়ে তুললেন, যেখানে আজও সৈনিক শিক্ষা দেওয়া হয়, আর প্রার্থনায় নমস্তে সদাবৎসলে মাতৃভূমে ত্বয়া হিন্দুভূমে সুখং বর্ধিত অহং পড়া হয়। এই হিন্দুভূমি পূণ্যভূমিই যে এই দেশের নাগরিকত্বের পূর্বশর্ত তা মনে করা হয় প্রতিদিন। সেই মডেল মেনেই ওনারা এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চান, অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলো হবে নিয়মতান্ত্রিক, সাধারণ কাজকর্ম চালানোর জন্য, এক নেতা শাসন করবেন দেশটাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নয়, এক কেন্দ্রশাসিত কাঠামোই তাঁদের মনে ধরেছিল আর সেই তখন থেকেই তাঁরা এর জন্য উমেদারি করে গেছেন।
এবার হাতে ক্ষমতা পেয়ে তাঁরা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে তছনছ করার জন্যই এই এক দেশ এক ভোট বিল আনছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতোই একই সঙ্গে সবক’টা নির্বাচন হবে, মোদিজি অমিত শাহ প্রচার করবেন, টাকার বন্যা বইয়ে দেবেন, নির্বাচন কমিশন তো অনুগত ভৃত্য, কাজেই দখল নিতে চাইছেন সারা দেশ। আমাদের দেশে তো এক দেশ এক ভোট ছিল, ছিল না তা তো নয়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকার ভেঙেছে, ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট ভেঙেছে, অটলজির সরকারই একবার ১৩ দিন, অন্যবার ১ বছরের মাথায় ভেঙেছে। কাজেই আবার নির্বাচন করাতে হয়েছে, যদি করাতে হয়, তাহলে কি সেই সময়ের নির্বাচিত সরকারগুলোকে ভেঙে ফেলতে হবে? বা ধরুন রাজ্যে রাজ্যে সরকার ভেঙেছে, আলাদা করে নির্বাচন করাতে হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে কী হবে? এক বছরের মাথায় কোনও রাজ্য সরকার ভেঙে গেলে বা এক বছরের মধ্যে কোনও ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট ভেঙে গেলে বাকি চার বছর ধরে রাষ্ট্রপতি শাসন চলবে? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বজায় রেখে কোনওভাবেই এই এক দেশ এক ভোট করানো সম্ভব নয়।
এটা তো গেল বিরোধীদের যুক্তি, এবং এটা তো ঘটনাই যে আমাদের দেশে ১৯৫২ আর ১৯৫৭ তে মোটামুটি ওই এক দেশ এক নির্বাচনই হয়েছিল। কিন্তু তারপরে রাজ্য সরকার ভাঙা শুরু হল, বা ভেঙে গেল, তখন থেকেই আলাদা আলাদা রাজ্যে আলাদা সময়ে নির্বাচন শুরু হল। কিন্তু যাঁরা এই এক দেশ এক ভোটের বিল আনছেন, যাঁরা ড্রাফট করেছেন তাঁদের তো কিছু যুক্তি আছে, সেটা শুনে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: ইভিএম-এ ঘাপলা করে জিতেই চলেছে বিজেপি
দুটো বিষয় সত্যি ভাবার মতো, এক হচ্ছে খরচ আর দুই হচ্ছে এই নির্বাচন হতেই থাকার ফলে সরকারের কাজকর্ম থমকে থাকা। নির্বাচন বিধি লাগু হয়ে গেছে অতএব সরকার ঠুঁটো জগন্নাথা। এই দুই সমস্যাকে সামনে রেখেই এই এক দেশ এক ভোট আনার কথা বলা হচ্ছে। কত খরচ? গণতন্ত্র বজায় রাখতে প্রথম খরচ নির্বাচনের, তার হিসেবটা দেখুন। ১৯৫২-তে আমাদের দেশের প্রথম নির্বাচনের জন্য খরচ হয়েছিল ১০.৪৫ কোটি টাকা, তখনকার জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু ৬০ পয়সা। ৫৭-তে খরচ কমে দাঁড়ায়, ৫.৯ কোটিতে, মাথাপিছু ৩০ পয়সা। ৬২-তে ৭.৩২ কোটি টাকা, মাথাপিছু আবার সেই ৩০ পয়সা, নেহরু মারা গেছেন ৬৭-তে ভোট, ১০.৮ কোটি টাকা খরচ হলো, মাথাপিছু ৪ পয়সা। ২০১৪-তে তা একলাফে বেড়ে দাঁড়াল ৩৮৭০ কোটি টাকায়, ৪ গুণ খরচ বাড়ল, ৪৬ টাকা মাথাপিছু খরচ হলো। ২০১৯-এ ৬৫০০ কোটি টাকা মোট খরচ, মাথাপিছু খরচ ৭২ টাকা। মানে ৫২-র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার খরচ মাথাপিছু ৬০ পয়সা, ২০১৯ সালে সেই গণতন্ত্রকে বজায় রাখার খরচ মাথাপিছু বেড়ে দাঁড়াল ৭২ টাকায়, মানে ১২০ গুণ। আর ২০২৪-এ খরচ কত? ৭৩০০ কোটি টাকা, এবং মাথায় রাখুন এটা কিন্তু কেবল রাষ্ট্রের খরচ, রাজনৈতিক দল, তাদের প্রচারের হিসেব এর মধ্যে নেই। হ্যাঁ এই খরচে লাগাম দিলে রাজনৈতিক দলের টাকার চাহিদা কমবে আর তা কমলে দুর্নীতিতেও খানিক লাগাম পড়বে।
এক দেশ এক ভোট কোথায় হয়? বিশ্বের প্রায় সমস্ত উন্নত দেশেই হয়, তার প্রথম কারণ হল সেখানে শিক্ষার প্রসার, সেখানে দলের আনুগত্য, সেখানকার রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা। এর কোনওটার সঙ্গেই আমাদের কোনও মিল নেই। যার ফলে ১) রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় যা সম্ভব, আমাদের মত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সেটা প্রায় অসম্ভব। বিল তো এসে গেল, এবার দেখার, সেই বিল পাশ হয় কি না আর পাশ হওয়ার পরে লাগু হয় কি না। কারণ মোদি সরকার বহু এমন গুরুত্বপূর্ণ বিলও পাশ করিয়েছে যা লাগু হয়নি, বা ফেরত নেওয়া হয়েছে। নাটকের মঞ্চে পর্দা তো উঠে গেল, দেখা যাক আগে আগে হোতা হ্যায় কেয়া।