যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। জানা গেছে তৃণমূল নেতা দুলাল সরকার খুনে ‘মূল চক্রী’ তৃণমূলের মালদহ শহরের সভাপতি নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ স্বপন শর্মা। ইংরেজবাজারের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলরকে খুনের জন্য নাকি ৫০ লক্ষ টাকার সুপারি দেওয়া হয়েছিল। বুধবার এ খবর জানালেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার। পুলিশ আরও যা পেয়েছে তা হল, নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দুলালের নাকি বিস্তর গন্ডগোল ছিল। খুনের নেপথ্যে নাকি সেই আর্থিক লেনদেনেই আসল কারণ। যদিও কোন বিষয়ে ওই টাকার লেনদেন হয়, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বুধবার নরেন্দ্রনাথ এবং স্বপনকে আদালতে হাজির করানো হলে তিনদিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। আদালতে পুলিশ জানিয়েছে, টাকার লেনদেন, ফোনের কল রেকর্ডিং ইত্যাদি দেখে ওই দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে আরও তদন্তের প্রয়োজনে দু’জনকে হেফাজতে নেওয়া প্রয়োজন। আদালতে সরকারি আইনজীবী দেবজ্যোতি পাল শেষ বোমাটা ফাটিয়েছেন, জানিয়েছেন, ‘‘এটা রাজনৈতিক খুন।’’ এখন তৃণমূল নেতা খুনে যদি তৃণমূলেরই নেতা গ্রেফতার হন তাহলে তা তো রাজনৈতিক খুন বটেই কিন্তু সেসব পাশে সরিয়ে রেখেই পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে, সেই গ্রেফতারিতে বা পুলিশের কাজে কোনও হস্তক্ষেপ হয়নি, এটা কিন্তু এক দারুণ ব্যাপার।
সেই কবে থেকেই আমরা দেখেছি, জেনেছি, শুনেছি যে পুলিশ আসলে চলে রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশেই, তো ক্ষমতায় বসে আছে তৃণমূল, কিন্তু তারা পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি এটা একটা বড় ব্যাপার। এই সংস্কৃতি যদি ফেরানো যায়, আইনকে আইনের পথে যদি চলতে দেওয়া যায়, পুলিশকে যদি রাজনৈতিক চাপ অগ্রাহ্য করেই কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, ভাবুন তো এই সমাজটা কত ভালো হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক দল থাকবে তারা তাদের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে প্রচার করবে, সরকারে থাকবে, বিরোধী আসনে বসবে কিন্তু ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট হবে আইন মেনে, দোষীরা শাস্তি পাবে, সমাজটাই বদলে যাবে। কেন উঠছে এই কথাগুলো? কারণ এই মালদার ঘটনা এক ব্যতিক্রম, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে যে কোনও জমানাতেই দোষী রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় অনায়াসে দোষ করে, অন্যায় করে, জঘন্যতম অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে গেছে। হ্যাঁ, সেই জন্যই তো সাঁইবাড়ি থেকে কসবা আনন্দমার্গীদের জ্বালানো থেকে বিনোদ মেহেতা ডি সি পোর্টের হত্যা থেকে ভিখারি পাশওয়ান থেকে বহু হত্যার আসল দোষীরা উবে গেছে, ধরাই পড়েনি, শাস্তি হওয়া তো দূরের ব্যাপার। কাজেই এই হত্যা হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুলালবাবুর স্ত্রী জানিয়েছিলেন দলের কেউ কেউ জড়িত আছে, ক’দিনের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করা হল, এটা নাগরিক সমাজের কাছে স্বস্তির খবর।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | নন্দীগ্রাম, সন্দেশখালি, শুভেন্দু অধিকারী
এবার একটু অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে দেখা যাক, সমস্যাটা হল দল চালানো। একজন সিকি নেতার মিটিং আয়োজনে কত খরচ জানা আছে? এক তৃণমূলের নেতা, সাধারণ সম্পাদক, বিরাট কিছু ভেবে বসবেন না, তৃণমূলের অমন সাধারণ সম্পাদক অনেক আছে, আজ আছেন কাল নেই এমনও আছে, তিনি জেলায় মিটিংয়ে যাওয়ার আগে খাবার ও পানীয়ের কথা জেনে নেন। সিঙ্গল মল্ট ছাড়া তাঁর চলেই না। তারপরে গাড়িভারা নেন অনেকে, মঞ্চ, পতাকা, মাইক ডেকরেটর বিরাট ফিরিস্তি, তারপরে পোস্টার দেওয়াল লিখন। একজন নেতা বলছিলেন ওই সিকি সাইজের নেতার মিটিংয়ের জন্য নাকি ১০ লাখ হুউউশ করে খরচ হয়ে যায়। তাহলে ভাবুন ছয় না, আট আনা বারো আনা নেতাদের মিটিং খরচ কত হবে। তারপরে আছে নির্বাচন, সে তো হাতি পোষার খরচ। টাকা তুলতে হবে। এবার কোটি টাকা তোলার জন্য বাহিনী পুষতে হবে, এখন কাউন্সিলর, এমএলএ, পরের বার হওয়ার জন্য আবার খরচ লাগবে, তার টাকা তুলতে হবে। হুট বলতে ঝুট ক্ষমতা তো পদ্মপাতায় জল। চলে গেলে বাকি দিনগুলোর জন্য রসদ দরকার, তারজন্য টাকা জমাতে হবে। অতএব সিক্সটি ফর্টি রেশিওই হল সবথেকে ভদ্রস্থ হিসেব, মানে ১০০ টাকা তুলে ৬০ টাকা দলের, ৪০ টাকা নিজের, এনারা হলেন কোট আনকোট সৎ নেতা। তাহলে বুঝুন অসৎ নেতার রেশিওটা। কাজেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে হবে, অন্যায় করতে হবে, অপরাধের মধ্যেই থাকতে হবে।
সবমিলিয়ে এক কালচক্র, এক ভিসিয়াস সার্কল, যাকে আটকানোর কোনও উপায় জানা নেই। কেবল এই ঘটনার দিকেই চোখ রাখুন না, মালদার এক কাউন্সিলর, তাঁকে মারতে ৫০ লক্ষ টাকার সুপারি, ৫০ লক্ষ যিনি ইনভেস্ট করছিলেন, বা যাঁরা ইনভেস্ট করছিলেন তাঁদের ব্যবসাটা কত বড়? কত টাকার? আর সেটা ভাবলেই বুঝতে পারবেন একজন কাউন্সিলর এক মফস্সল শহরের, তিনি সরে গেলে বা তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করা যায়, তাহলে মোট টাকার লেনদেনটা কত? কত টাকার দুর্নীতি চলে? কাজেই একজনকে খুন করা হল, পুলিশ রাজনৈতিক দলের রং না দেখেই অপরাধীদের গ্রেফতার করল, খুব ভালো কথা কিন্তু পেছনে দুর্নীতির যে অর্থনীতি থেকেই গেল, যা মানুষের সামনে এল না, যে দুর্নীতি ধরা পড়লই না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা কবে শুরু হবে? এবং মাথায় রাখুন এমন ঘটনা কিন্তু ঘটেই চলেছে, কিছুদিন আগেই এক সুপারি কিলারের দল এসে কসবার কাউন্সিলারকে মারার চেষ্টা করেছিল, এবং এরকম ঘটনা ঘটছে, বাড়বে বলেই আমাদের ধারণা। আসলে উৎসমুখ খোলা রেখে, রোগের আসল চিকিৎসা না করে কেবল ব্যাথা সারানোর ট্যাবলেটে আর কতদিন কাজ হবে?