পৃথিবীর গভীরতর অসুখের এই পর্যায়ে শৈশব এখন ডাকঘরের অমল। গত প্রায় সওয়া একবছর যাবত গৃহবন্দিত্বের এই রাহুমুক্তি আদৌ কবে হবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। এ এক অদ্ভুত আঁধার চারপাশে। শৈশবের দু’পায়ে তেপান্তরের মাঠ নেই, মাথার ওপর আকাশের ছাতা নেই। বৃষ্টিতে ভেজা নেই। ফুটবল-ক্রিকেট নেই। স্কুল নেই, ক্লাস শেষের মধুর ঘণ্টি নেই। চোখের সামনে রয়েছে শুধু ব্ল্যাকবোর্ড।
ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু করোনা এই ভবিষ্যৎকেও পঙ্গু করে দিয়েছে। ঘরে বন্ধ থাকতে থাকতে তাদের মনটাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। স্কুলের পরিবেশে শিশুরা গাছের মতো বেড়ে ওঠে। আর ঘরে বনসাইয়ের মতো। একসময় টোল-পাঠশালা ও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচর্যাশ্রম খুলেছিলেন। প্রকৃতির মধ্যে থেকে প্রকৃতির পাঠ নিত আশ্রমিকরা। আর এখন সেই খাঁচাবন্দি তোতাপাখির দশা আপামর পড়ুয়াদের। মনের বিকাশ তো দূরের কথা, পেটের মধ্যে খসখস-গজগজ শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। হয়তো এটা সত্য নয় যে, এখনকার বাচ্চারা সব মুখ্যু হয়ে গড়ে উঠছে। পারিপার্শ্বিক-দেশ-বিদেশ ও সাধারণ জ্ঞানের তাবড় শিক্ষা তারা পাচ্ছে ইন্টারনেট থেকে। কিন্তু, ক’জন? সীমাবদ্ধ রোজগারের পরিবারে কতজনের কাছে অসীম নেট জোগানের ক্ষমতা আছে? ফলত যা হওয়ার তাই হচ্ছে, লেখাপড়ার পাঠ গোটাতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোরকে। সরকার বিনি পরীক্ষায় পাশের বন্দোবস্ত করলেও, সেই শংসাপত্র ধুয়ে গোমূত্র ছাড়া আর কিছু জুটবে কি?
ডানা ভাঙা পাখি
শিশু-কিশোরদের মন ভেঙে গেছে। সারাদিন বাড়িতে থাকা বড়দের পক্ষেই মানসিক অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর উড়ন্ত শৈশবের মনের তো ডানা কেটে নিয়েছে করোনা। নাটকের চরিত্রাভিনেতার মতো ইউনিফর্ম পরে ছবিবাক্সের সামনে বসে থাকা। পাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ধেয়ে আসা চিমটি নেই। পেন্সিল লুকিয়ে রাখছে না সহপাঠী। তোর মা চাউমিন দিয়েছে? আমার দেখ পরোটা-আচার। অ্যাই আমায় একটু হালুয়া দে! পুরোটা একা খাস না! না এসব নেই। এখন সবাই একা! আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থাতেও বন্য মানুষ এত একা ছিল না। যে কোনও ঘরের বাচ্চাই এবার একদিন চিৎকার করে বলে উঠবে, ‘আমি একা! একমেবাদ্বিতীয়ম!’
নৈঃসঙ্গ কৈশোর
শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ তাই নয়। আত্মীয়, বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া-আসা, সামাজিক অনুষ্ঠান, নিদেনপক্ষে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও সম্পর্ক লাটে উঠেছে। মনের কথা বলার বা শোনার মানুষ নেই। ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপেও ক্লান্তি এসে যাচ্ছে। ওয়েব সিরিজও চোখে জ্বালা ধরাচ্ছে। আগে যে খাবারগুলোতে লোভ ছিল, এখন সেগুলোতে অরুচি এসেছে। এমনকী বাচ্চাদের মধ্যেও এখন অম্ল ও বায়ুরোগ দেখা যাচ্ছে।
খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিয়মমাফিক পৃথিবীটা ঘুরছে। কিন্তু বাচ্চারা সময়ের আগেই একলাফে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। একটা প্রজন্ম তৈরি হল যারা শিশুকালেই খুব কাছ থেকে মৃত্যুর ‘চিরানন্দময়’ স্বাদ পেয়ে গেল। সম্পর্কের সুতো পাক দিয়ে মোটা হয়ে ওঠার আগেই ছিঁড়ে গেল। স্কুলপড়ুয়ার পকেটে লজেন্স ওঠার আগেই স্যানিটাইজারের শিশি ঢুকে গেল। কলেজ পড়ুয়ার ঠোঁটে সিগারেট গোঁজার আগেই মুখ ঢেকে গেল মাস্কে। স্কুলের যে বন্ধুটার মা রোজ কষা কষা আলুর দম পাঠাতেন, তিনি মারা গেছেন। আর যে কলেজের বন্ধুটার বাবা অটো চালাতেন, তিনি এখন ঘরে বসা। বন্ধুটা এখন বাজারে সবজি বেচছে, অনলাইন ক্লাস করবে কখন….! কখন…!
পৃথিবীর অসুখে সকলেই অমল
Follow Us :