Thursday, June 26, 2025
HomeCurrent Newsআলাপন ‘টেক্সট বুক আমলা’

আলাপন ‘টেক্সট বুক আমলা’

Follow Us :

আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের স্কুলের সহপাঠী ছিল। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম। উনি ছিলেন ৭৬-এর প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এবং আমার ৭৭-এ মাধ্যমিক। খুব ভাল ছাত্র ছিলেন আলাপন, মাধ্যমিকে তৃতীয় স্থান পেয়েছিলেন। তারপর সবাই ভেবেছিল, কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ আইআইটি’তে যায়, নরেন্দ্রপুরে মেধাবী ছাত্র হিসাবে আলাপনও হয়তো এমনই কোনো পেশা বেছে নেবে। কিন্তু উনি সেটা করেননি। আলাপন হিউম্যানিটিস নিয়ে পড়েছিলেন এবং তখনই তিনি বলতেন যে, তিনি একজন প্রশাসক হতে চান। প্রশাসনের ইতিহাস পড়তেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পর কি ভাবে ব্রিটিশ প্রশাসন কাজ করত, এই বিষয় গুলিতে ওঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। এহেন আলাপন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ফার্স্ট ক্লাস পান, আইএস পরীক্ষায় প্রথম হন। এরপর এম.এ করে সেই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছিলেন ৮২-৮৩ সালে। ৮৪ সালে আমিও সাংবাদিকতায় এলাম। তারপর ৮৭ সালে আইএএস হলেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘আমলার মন’ নামে বাংলায় একটা বইও লিখেছেন। এই আলাপন কোনো দিনই কোনো রাজনৈতিক দলের খুব একটা অ্যাক্টিভিস্টও ছিলেন না। বরং রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ার জন্যই হোক বা নিজে কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট মননের জন্যই, উনি ভারতীয় দর্শন এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের হিন্দু সংস্কার আন্দোলনে কি ভূমিকা ছিল এই সব বিষয় নিয়ে অনেক বেশি পড়াশোনা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ সম্পর্কে ওনার খুব আগ্রহ ছিল। ইতিহাস নিয়েও পড়াশোনা করতেন তিনি। তখন রথীন সেনগুপ্ত ছিলেন মুখ্যসচিব। রথীনবাবুকেও আলাপনের খুব পছন্দ হয়েছিল। আর উনিও আলাপনকে খুব স্নেহ করতেন। রথীন বাবু আলাপন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ও ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। দেখবে একদিন মুখ্যসচিব হবে।’ রথীনবাবু তো অনেকবার বলেছেন যে, ‘আলাপন তুমিও একদিন এ রাজ্যের মুখ্যসচিব হবে।’ তাঁর কথামত আলাপন মুখ্যসচিব হলেন কিন্তু তিনি সেদিন জানতেন না যে, বাংলার মুখ্যসচিব হিসাবে শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ মে, ২০২১, এভাবে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যেকার যুদ্ধে সে বেচারা হয়ে যাবে বলির পাঁঠা। আলাপন বিয়ে করেন সোনালী চক্রবর্তীকে। তিনি প্রয়াত বিশিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কন্যা। সোনালী আলাপনের ক্লাসমেট ছিলেন। একই বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখালদার ক্যান্টিনে তাঁরা যৌথভাবে অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছেন। দু’জনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে ওনাদের বিয়ে হয়। তাঁদের এক পুত্রসন্তান আছে। নাম মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেও প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র ছিল এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের বিশিষ্ট অধ্যাপক। স্কুলে খুব ভালো রেজাল্টও করেছিল মিলিন্দ।
আলাপন হয়তো দিল্লিতে কাজ করেনি। কিন্তু সে অনেক গুলো জেলায় কাজ করেছে। আলাপন হাওড়ার জেলাশাসক ছিলেন, এবং পরবর্তীতে উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক হয়েছিলেন। আলাপন যখন হাওড়ার জেলাশাসকের পদে, তখন একটা কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ মিটিয়ে ছিলেন। আমি সাংবাদিক হিসাবে সেটা নিয়ে খবর করি। বিষয়টা ছিল, গঙ্গার ধারে যে রাস্তাটা গেছিল সেটা ছিল ফোরশোর রোড, সেটা পোর্ট ট্রাস্টের জমি। কিন্তু পুরসভার সেটা দেখভাল করার কথা, যা তারা করত না। আবার পুরসভার অন্তর্গত জিটি রোড, ভারতের সবথেকে সংকীর্ণতম জিটি রোড হাওড়া, সেখানে প্রতিদিন ভীষণ রকমের যানজট হত। কিন্তু আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জেলাশাসক থাকাকালীন এই দুটি সড়ক পথকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেন। অর্থাৎ, ফোরশোর রোড দিয়ে দক্ষিণ দিকে গাড়ি যাবে। আবার দক্ষিণ থেকে মধ্য হাওড়া হয়ে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত জিটি রোড হয়ে গাড়ি শুধু আসবে। ফলে এই দুটি সড়ক পথকে ‘ওয়ান ওয়ে’ হিসাবে কাজে লাগানো হয়েছিল। এই ব্যবস্থা বহাল করতে পোর্ট ট্রাস্ট এবং পুরসভার সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি মিটিয়ে ছিলেন সেই সময়কার জেলাশাসক আলাপন। যা এক প্রকার কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যেকার বিবাদ বলেই ধরে নেওয়া যায়। তখন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে যে সাফল্য আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছিলেন, এবারের কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের মাঝে তিনি যেন কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন। একটা দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হতে হয় তাঁকে। এখন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে তিনি মুখ্যসচিবের পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারতেন, যা তিনি করেননি। যার বদলে কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এবং এই অবস্থায় আলাপনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর কেন্দ্র রাজ্য টানাপোড়েন এবং একাধিক পত্রাঘাতের পর ৩১ মে সোমবার মুখ্যসচিব পদ থেকে অবসর নেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর মঙ্গলবার অর্থাৎ ১ জুন থেকে প্রচুর বৈঠক করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নব নির্ধারিত মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
উনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি হোম হয়েছিলেন। সমস্ত ভিআইপিরা এলে তিনি প্রোটোকলের দায়িত্ব থাকতেন। তাঁদেরকে আনতে যেতে হতো। এই কাজটা আলাপন খুব উপভোগ করতেন এবং অনেক ভিআইপিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় রয়েছে। ওনার একটা দুর্বলতা ছিল। সেটা হল, উনি কখনোই দিল্লিতে কাজ করেননি। অবসরপ্রাপ্ত আমলা জওহর সরকার সিনিয়র হিসেবে বলতেন, ‘আলাপন তোমার দিল্লিতে একটু কাজ করা উচিৎ। তাহলে একটু এক্সপোজার হবে এবং আর ১০টা ক্যাডারের অফিসারের সঙ্গে মেলামেশা হবে।’ কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক উনি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কখনোই বেরোননি। কিন্তু যখন প্রথম আইএস হয়ে মুসৌরিতে ট্রেনিং নিতে গেছিলেন তখন একজন সিনিয়র আইএস অফিসার তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তিনি একবার আলাপন সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন যে, ‘প্রথম যখন ও ট্রেনিংয়ে এসেছিল, ওরকম মেধাবী আইএস দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। এত পড়াশোনা, ভারতীয় দর্শন থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতা, প্রশাসনের ইতিহাস, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস, এই সবকিছু ওর ছিল নখদর্পণে।” আলাপনের ভূয়সী প্রশংসা করতেন বাঙালি অন্ধ্রপ্রদেশের ক্যাডারের অফিসার অভিতাভ ভট্টাচার্য। তিনি একথা বারবার বলতেন।
সেই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর স্তাবক, এমন পরিচিতিও কোনোদিনই ছিল না। উল্টে তিনি রাজ্যেরর স্বরাষ্ট্রসচিব হতে পারেননি বলে প্রশ্ন উঠেছিল যে, তিনি সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন তাঁকে না করে কেন উত্তীয় ভট্টাচার্যকে সেসময় স্বরাষ্ট্র সচিব করেছিলেন। কিন্তু সেসময় উত্তীয় ভট্টাচার্যের কাজকর্মের রেকর্ড ভালো হয়নি। যেকোনো কারণেই হোক উত্তীয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর রসায়ন কাজ করেনি। পরবর্তীকালে আলাপনকেই স্বরাষ্ট্র সচিব করা হয়। তারপর তিনি মুখ্যসচিব হন। বরং এর আগে যিনি মুখ্যচসচিব ছিলেন সেই রাজীব সিনহার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসায়ন অনেক ভালো ছিল, এরকম একটা ধারণা করা হয়। কিন্তু আলাপনকে স্বরাষ্ট্রসচিব না করলেও তাঁর স্ত্রী সোনালীকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করায়, সেই সময় একটা আলোচনা হয়েছিল যে, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় নাকের বদলে নুরুন পেল, তাঁর স্ত্রীকে উপাচার্য করা হল। নিন্দুকেরা এমন সব কথাও বলেছিল। কিন্তু আলাপনের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তিনি নিজে থেকে কখনোই কথা বলেন না। তাঁকে বলা হত টেক্সট বুক আমলা। আজও কিন্তু তাঁকে নিয়ে এত কান্ড হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নিজের কোনো মন্তব্য নেই। তিনি একবার আমায় বলেছিলেন, আমরা আমলারা ‘আই ফিল’- এই কথাটা কোথাও লিখতে পারিনা। সব সময় লেখা হয় ‘ইট ইজ ফেল্ট’ অর্থাৎ আমি মনে করি। এমন মনে করা হচ্ছে এটাই হল দস্তুর।
এহেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখন কি হবে সেটাই দেখার! তিনি ইচ্ছে করলে নিজেই ইস্তফা দিয়ে দিতে পারতেন। ইস্তফা দিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে তিনি নিজেই আজ অবসর নিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। মুখ্যমন্ত্রীর কান্ডারী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আজ চিঠি পাঠিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে কেন্দ্র কি ব্যবস্থা নেয়? নাকি একটা সংঘর্ষ বিরতির পথে যায়? নাকি বিষয়টা নিয়ে হাই কোর্টে মামলা হয়? কেননা, কেন্দ্র কিন্তু এরই মধ্যে ক্যাট এবং হাই কোর্টে ক্যাভিয়েট দাখিল করে রেখেছে। সুতরাং সেখানে রাজ্য সরকারের মামলা হওয়ার সম্ভাবনাটা কেন্দ্রও মাথায় রেখেছে। কিন্তু আইনের পথে যাওয়ার থেকে আমরা সবাই আশা করছি, যদি দু’পক্ষরই শুভবুদ্ধির উদয় হয়। করোনা আক্রান্ত সময়ে, সাইক্লোন আক্রান্ত সময়ে, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যেওর এই জটিলতা এবং বিরোধ বোধহয় এড়ানোর প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সোমবার ‘মন কি বাত’এ বলেছেন, যে কেন্দ্র-রাজ্য হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সুতরাং এখন আশায় বাঁচে চাষা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Video thumbnail
Iran | মা/রের চোটে ছালচামড়া গুটিয়ে গেল ইজরায়েলের, পাশে নেই ট্রাম্প,মাথা খারাপ হয়ে গেল নেতানিয়াহুর?
03:59:35
Video thumbnail
Donald Trump | NATO বৈঠকে ট্রাম্পকে চাইছে ইউরোপ, বিশ্ব রাজনীতিতে এ কোন খেলা?
01:49:52
Video thumbnail
Donald Trump | রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহ ট্রাম্পের, আবার কোন ফন্দি?
02:17:50
Video thumbnail
Weather Update | প্রবল দুর্যোগের পূর্বাভাস, ভাসবে কোন কোন জেলা? দেখুন বড় আপডেট
01:49:00
Video thumbnail
Good Morning Kolkata | সকালের গুরুত্বপূর্ণ খবর, দেখুন একনজরে সরাসরি
03:16:04
Video thumbnail
Stadium Bulletin | দ্বিতীয় টেস্টে ভারতের কী করা উচিত?
00:51
Video thumbnail
Iran-Israel | চুলোয় যাক যু/দ্ধবিরতি, ইরানে আরও ভ/য়ঙ্কর হা/মলার ছক ইজরায়েলের, ট্রাম্পের মুখ চুন
02:52:25
Video thumbnail
Stadium Bulletin | ঋষভকে নিয়ে কেন মন্তব্য নয় গম্ভীরের?
00:31
Video thumbnail
Stadium Bulletin | 83-বাস্তবের সঙ্গে কোথায় মিল?
00:26
Video thumbnail
Bangla Bolche | Avro Sen | কালীগঞ্জ কি তৃণমূল মডেল?
01:05

Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39