রাহুল গান্ধী হাঁটছেন, ১০০ দিন পার হয়ে গেল। ৭ সেপ্টেম্বর কন্যাকুমারিকা থেকে শুরু হয়েছিল, কেরল, তামিলনাডু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান হয়ে হরিয়ানা পার করে এবার ঢুকবে দেশের রাজধানীতে। দিল্লির রাজপথে কংগ্রেসের মিছিল, বহু বহুদিন পরে মানুষ দেখবে, ২০০০ কিলোমিটার রাস্তা পার করে ৫২ বছরের রাহুল গান্ধী দেশকে চেনার চেষ্টা করছেন, চিনছেন। এই সেদিন বললেন, কী কংগ্রেস, কী বিজেপি, দেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশের মানুষের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা মনে করে না। এ সত্য এই যাত্রার নির্যাস, ৪৭ সাল থেকে গণতন্ত্র, ৫২ সাল থেকে ভোট, নির্বাচন, গত ২০১৯=এ ১৭তম লোকসভা তৈরি হল, কত সরকার এল, কত দল, কত প্রতীক চিহ্ন, কত মিছিল, ভাষণ, র্যালি। সেই ৫২ সাল থেকেই রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচন এলেই রোটি কপড়া আউর মকানের কথা বলেন, আমাদের ২৪ বছর পরে স্বাধীনতা অর্জন করা এক দেশ বিশ্ব ক্ষুধার অঙ্কে আমাদের চেয়ে উপরে। কারণ? কারণ রাজনৈতিক নেতাদের মুখ আছে ভাষণ দেন, মানুষের কথা শোনার কান তাঁদের নেই, ধৈর্য তো নেইই। ২০০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে রাহুল গান্ধী এই সারসত্য বুঝেছেন, কেবল বুঝেছেনই নয়, বলেওছেন। স্বাধীনতার পরে সবথেকে বড় রাজনৈতিক ইভেন্ট ভারত জোড়ো পদযাত্রা হয়েই উঠতে পারত এক নির্বাচনী অস্ত্র, অনেকেই সমালোচনায় মুখর, কেন এই পদযাত্রা গুজরাত থেকে শুরু হল না? কেন মহারাষ্ট্র থেকে ঠিক নির্বাচনকে তাক করে গুজরাতে ঢুকে পড়া হল না, রোজ কংগ্রেস সমেত বিরোধীদেরই প্রশ্ন করতে থাকা অর্ণব গোস্বামী রাহুল গান্ধীকে এই প্রশ্নই করেছেন, বাকিরাও তাই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এই পদযাত্রা যদি গুজরাত থেকে শুরু হত, বা নির্বাচনের আগেই গুজরাতে ঢুকে যেত, এই নেশন ওয়ান্টস টু নো-এর চিল্লানোসরাস এবং তার যত শাকরেদরা আছে, তারা গলা ফাটাত, এ আবার ভারত জোড়ো যাত্রা নাকি? এ তো নির্বাচনী প্রচার। মোদিজিও পেয়ে যেতেন মুখোমুখি রাহুল গান্ধীকে, পারিবারিক শাসন, পাপ্পু বলে গলা ফাটাতেন তিনিও। খুব সযত্নে রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেস এই ফাঁদে পা দেননি। আসলে কী, রাজনীতিরও একটা ফলিত দিক আছে, যাকে প্রয়োগের দিকও বলা যায়, তা হল নির্বাচন, সরকার টিকিয়ে রাখা, সরকার আর জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ইকুয়েশন সামাল দেওয়া, একে গ্রাউন্ড পলিটিক্স বলাই যায়। অন্যটা হল রাজনৈতিক আদর্শ, উন্নয়ন, মানুষের চাহিদা, প্রকৃতি আর সভ্যতার সন্তুলন ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়। একে অন্যের পরিপূরক তো নিশ্চয়ই কিন্তু দুটোরই আলাদা চর্চা হওয়া উচিত। একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝাই, ধরুন মার্কসবাদ বা গান্ধীবাদ এক দর্শন, তা দেশের সমাজের অর্থনীতি, উন্নয়ন, মানুষের এবং সভ্যতার অগ্রগতির কথা বলেছে। কিন্তু সিপিএম, সিপিআই বা কংগ্রেসের দৈনিক রাজনীতিতে কি সেই দর্শনের প্রতিফলন ছিল? না ছিল না, খানিক গান্ধী, খানিক নেহেরুর অর্থনৈতিক পথে চলা শুরু করলেও, ৮০-র দশক থেকে সেই পথ ছেড়ে অন্য পথে চলা শুরু করে কংগ্রেস, বিশ্বায়ন, খোলাবাজার, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেচে দেওয়া, এবং এসবই ছিল তার মূল দর্শনের বিরোধী, তাহলে করছিল কেন? তাদের মনে হয়েছিল এই পথেই দেশের উন্নয়ন হবে, প্রচুর মানুষ চাকরি পাবে, মাস প্রডাকশন জিনিসপত্রের দাম কমাবে। মোদ্দা কথা হলও সেদিনও কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি ছিল রোটি কপড়া মকান নৌকরি, তারই ব্যবস্থার জন্য তারা গান্ধী বা নেহেরুর দর্শনের ঠিক বিপরীতে পথ হাঁটা শুরু করেছিল। সিপিএম তার আদর্শ নিয়ে আরও গভীর জলে, আসলে যাদের আদর্শ একচেটিয়া পুঁজি আর সামন্তবাদকে হটিয়ে দিয়ে কৃষক শ্রমিকদের সরকার তৈরি করা, তারা এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়েছে। বুদ্ধ, বিমান, নিরুপম, সূর্যকান্ত বাংলার উন্নয়নের জন্য একচেটিয়া পুঁজি তো বটেই, বিদেশি পুঁজি আনতেও দ্বিধা বোধ করেননি, কেন? ওই একই কারণ, যে রাজ্যে আছে সেখানকার যুবকদের চাকরি চাই, বেসরকারি মেডিক্যাল/ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে তুলতেই হবে, রাজ্যের হাতে টাকা কই? কিন্তু তা করতে গেলে পুঁজিকে ডাক দিতে হবে, অথচ তাদের কর্মসূচি বলছে ওই ব্যক্তিগত পুঁজিরই অবসান চাই, ঘেঁটে ঘ। কেরলেও ওই একই খেলা চলছে, যা বলছেন তা আপাত বাস্তব, কিন্তু আদর্শ বিরোধী। এমনটা কেন? কারণ হল কংগ্রেস বা কমিউনিস্টদের দর্শনে আদতে সমাজ, সামাজিক ভূমিকা ছাড়াও অর্থনীতি নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট মতামত আছে, সামাজিক অর্থনৈতিক সেই অবস্থান ধরে রাখা বেশ কঠিন, এক প্রচলিত ধার্মিক সামাজিক রাজনৈতিক দেওয়াল ভেঙে এগিয়ে চলা কঠিন বইকী। তেমন চলার জন্য, আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক চর্চা থাকা জরুরি, সে আদর্শ এমনি এমনি বেঁচে থাকবে, এমনটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই। সেই দিক থেকেই কংগ্রেসের এই ভারত জোড়ো যাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস তার শেকড়ে ফেরার চেষ্টা করছে, স্বধর্মে ফেরার এই প্রচেষ্টা এই সময়ের দাবি, যে সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা এক তামাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, উগ্র হিন্দুত্ব আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদ নিয়ে আরএসএস–বিজেপি গোটা দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির উত্থান পতন খুব সাময়িক ব্যাপার, বছর ১০-১৫-২০র মধ্যেই এক শুয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা হতে দেখেছি আমরা, কিন্তু সমাজ? তা যদি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, সামাজিক ন্যায় অন্যায়, ভালো মন্দ বোধ যদি হারিয়ে যায়? যদি আমরা ভালো প্রতিবেশী হতে ভুলে যাই, যা খ্রিস্টানরা বলে, বা রাতে খাবার আগে খোঁজ নিতে ভুলে যাই পড়শির ঘরে খাবার আছে কি না, যে খোঁজ নিতে বলেছে ইসলাম। আমরা যদি উপনিষদের বসুধৈব কুটুম্বকম ভুলে যাই তাহলে আমরা শেকড়হীন উদ্বাস্তু হয়েই জীবন কাটাব, সেটাই কি কাম্য? কাম্য নয়। তাই শেকড়ে ফেরাটা জরুরি। আর এই শেকড়ে ফেরার প্রচেষ্টা যে আদতে ধর্মীয় জিগির তুলে দেশকে বিভাজন করা, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়ে দেশকে টুকরো করার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, তা বুঝতে পেরেছে মোদি-শাহের দল, পেরেছে বলেই ন্যাশনাল মিডিয়া প্রথমে এটা কংগ্রেস নয় রাহুলের পদযাত্রা বলা শুরু করল। খুব একটা কাজে দিল না, উলটে হঠাৎ করেই হিমাচলের জয় পেয়ে কংগ্রেস আরও একটু উজ্জীবিত হল। এরপর প্রচার পদযাত্রার কোনও প্রভাব নেই। কদিন আগে যে মিডিয়া বলত কংগ্রেস রাস্তায় নেই, মানুষের সঙ্গে নেই, তারাই এখন বলছে রাস্তায় থাকা কংগ্রেসের এত বড় রাজনৈতিক ইভেন্ট-এর কোনও প্রভাবই নেই। কিন্তু সেই গোদি মিডিয়ার প্রভুরা? তারা কিন্তু টের পেয়েছে, বিভিন্ন স্তরের মানুষ জুড়ে যাচ্ছেন এই পদযাত্রায়, ঠিক তখন মোদি সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডব্য রাহুল গান্ধী এবং অশোক গেহেলটকে চিঠি লিখে বলেছেন কোভিড সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে বাতিল করা হোক ভারত জোড়ো যাত্রা। এই যাত্রা চলতে থাকলে দেশে কোভিড ছড়িয়ে যাবে। আচ্ছা ঠিক এই মুহূর্তে কোভিড সংক্রমণের হার কত? ২০ ডিসেম্বরে ৭ দিনের গড় সংক্রমণ হল ১৫৫, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই সংক্রমণকে উদ্বেগজনক মনে করছেন। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি ২০২১-এ মার্চ এপ্রিলে জনসভার পর জনসভা করে যাচ্ছেন এই বাংলায় তখন দেশে সংক্রমণ ছিল গড়ে তিন লক্ষের কিছু বেশি। তখন অবশ্য মনসুখভাই হেলথ মিনিস্টার ছিলেন না, তখন উনি কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্টিলার্জ দেখতেন, কিন্তু হলফ করে বলতে পারি তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকলেও, তাঁর এই চিঠি লেখার ধক হত না, ইন ফ্যাক্ট তিনি হঠাৎ এই চিঠি লিখে বসলেন তেমনও তো নয়, নির্দেশ এসেছে তাই তিনি চিঠি দিয়েছেন। আইন বাঁচানো সেই চিঠি বলছে, আপনারা কোভিড প্রোটোকল মেনে মাস্ক পরে দো গজ কি দূরি বজায় রেখে পদযাত্রা করুন, আর না হলে পদযাত্রা স্থগিত রাখুন। আরও মজার কথা হল এই মনসুখ ভাই, নরেন্দ্র ভাই, অমিত ভাই এরা মিলে কদিন আগে গুজরাত দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, র্যালির পর র্যালি, তখন কোভিড প্রোটোকল কোথায় ছিল? চিঠি লিখেছিলেন? না কি র্যালিতে মুখ ঢেকে হেঁটেছিলেন? রইল গুজরাতে প্রচারের সময়ে নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদির ছবি, আপনারাই দেখুন। তাহলে? আসলে কোথাও অস্বস্তি হচ্ছে বইকী, পাপ্পু বন রহা হ্যায় পলিটিসিয়ান, ভয় হচ্ছে বইকী দিল্লির রাজপথে কমল হাসান, ডিএম কে নেতা কানিমোঝি এই পদযাত্রায় যোগ দেবেন, তাই চিঠি পাঠিয়েছেন। আসলে গত কয়েক দশকের মধ্যে এতবড় পলিটিক্যাল ইভেন্ট হয়নি, কোনও ধর্মীয় জিগির না, ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে স্লোগান নয় কিন্তু মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা বলা হচ্ছে, দেশের বেহাল অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছে, মানুষ পা মেলাচ্ছেন, দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পীরা এগিয়ে আসছেন, হ্যাঁ রাজরোষে পড়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও এগিয়ে আসছেন। কংগ্রেস ফিরছে তার শেকড়ে, অন্তত ফেরার এক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, বছর শেষে এর থেকে ভাল সুখবর আর কীই বা হতে পারত? অগণন মানুষের ক্লান্ত পদযাত্রা শেষে এক রাস্তা তো বেরিয়ে আসবে, আমরা আগ্রহ নিয়ে বসে আছি তা দেখার জন্য।
Html code here! Replace this with any non empty text and that's it.