বুধবার দুপুরে নিউটাউনের সাপুরজি আবাসনে সুখবৃষ্টি অ্যাপার্টমেন্টে এসটিএফ (স্পেশাল টাস্ক ফোর্স)-এর সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা পড়ে পঞ্জাবের ২ দুষ্কৃতী। তাদের নাম জয়পাল সিংহ ভুল্লার ও যশপ্রীত সিং। ঘটনার পরে পুলিশি তদন্তে ফ্ল্যাটের মালিকের হদিশ মিলেছে। জানা গেছে, তিনি কলকাতার সিআইটি রোড এলাকার বাসিন্দা। ২৩ মে তার থেকে মাসিক ১৫ হাজার টাকা ভাড়ায় চুক্তিতে ১১ মাসের জন্য নিউটাউনের সাপুরজি আবাসনের এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় দুষ্কৃতীরা। দুষ্কৃতীদের এই ফ্ল্যাটের খোঁজ কে দিয়েছিল, তা জানতে ফ্ল্যাট মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, সুমিত কুমার নামে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ওই নামেই কাগজপত্র রয়েছে। যার মাধ্যমে ঘর ভাড়া জোগাড় করেছিল জয়পালরা, সেই ব্যক্তির সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে ফ্ল্যাট মালিককে। অপরদিকে জানা গেছে, সাপুরজি আবাসন রাজারহাটের অভিজাত আবাসনগুলির মধ্যে অন্যতম। স্বাভাবিক ভাবেই তার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ আঁটোসাটো। সহজে এই আবাসনে ঢোকা যায় না। আর সেখানেই কি না ঘাঁটি গেড়েছিল ভিন রাজ্যের দুই কুখ্যাত দুষ্কৃতী। সেখানে কীভাবে কোন পরিচয়ে তার এতদিন লুকিয়ে ছিল তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কি করে হদিশ মিলল ২ গ্যাংস্টারের। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জুন মাসের ১ তারিখে ভরত নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পঞ্জাব পুলিশ। লুধিয়ানা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ভরতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পঞ্জাব পুলিশ জানতে পারে জয়পাল সিং ও যশপ্রীত পঞ্জাব থেকে কলকাতায় এসে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ভরত জানায় সে নিজে বাংলার থেকে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয় এবং সেই গাড়িতে করেই তাদেরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। এমনকি এই অভিজাত আবাসনে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। এরপর পঞ্জাব পুলিশ বেঙ্গল একটি অ্যাপের সাহায্যে সেই গাড়িটি খুঁজে বের করে। তারপর ভরতকে কলকাতায় নিয়ে এসে এই ফ্ল্যাট শনাক্ত করানো হয়। বৃহস্পতিবার দুই গ্যাংস্টারের দেহের ময়নাতদন্ত হবে। বুধবার রাত ১টা নাগাদ তাদের মৃতদেহ বের করা হয় আবাসন থেকে। ঘর থেকে একাধিক মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বিদেশের কোন যোগ রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। আবাসনের বি-১৫৩ নম্বর টাওয়ার এখনও ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বাসিন্দাদের ঢোকা-বেরোনোতেও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ১৬ মে লুধিয়ানার জগরাও জেলার দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টরকে গুলি করে হত্যা করে পঞ্জাবের কুখ্যাত গ্যাংস্টার এই জয়পাল ভুল্লার ও তার সঙ্গী যশপ্রীত সিং। এরপর থেকেই তারা ফেরার হয়ে যায়। তাদের তল্লাশিতে শুরু হয় ‘অপারেশন জ্যাক’। প্রায় চার-পাঁচটি রাজ্য জুড়ে তাদের সন্ধানে তল্লাশি চালাতে শুরু করে পঞ্জাব পুলিশ। ১৫-২০ দিন ধরে একাধিক রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তল্লাশি চালানো হয় এই দুই দুষ্কৃতীর। যোগাযোগ করা হয় এরাজ্যের পুলিশের সঙ্গেও। শুধু তাই নয়, দু’জনকে ধরতে পারলে পুরস্কার মূল্যও ঘোষণা করা হয়। জয়পালের মাথার জন্য ১০ লাখ এবং যশপ্রীতের জন্য ৫ লাখ। নিউটাউনে সাপুরজি কমপ্লেক্সে এনকাউন্টারের ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই উঠে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। বুধবার এসটিএফের গুলিতে নিহত যশপ্রীত-জয়পালদের বিষয়ে তদন্তকারীদের দাবি, গত মাসে পঞ্জাব পুলিশের দুই অফিসারকে খুনের পর যশপ্রীতরা ৪ জন পালিয়ে আশ্রয় নেয় মধ্যপ্রদেশে। তারপর সেখান থেকে যশপ্রীত জয়পালকে নিয়ে বাংলার নম্বরপ্লেট দেওয়া একটি কালো গাড়ি করে ঝাড়খণ্ড হয়ে বাংলায় আসে। এখানেই গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, মধ্যপ্রদেশ থেকে কীভাবে বাংলার গাড়ি তারা পেল? তদন্তে জানা গিয়েছে, WBO24500R – এই নম্বরের গাড়িটির রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা মূলত বাংলার গাড়ি হিসেবেই পরিবহণ বিভাগের নথিভুক্ত থাকলেও প্রায়ই ভিনরাজ্যে ঘুরে বেড়াত। যার ফলে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন না করানোয় তা বাংলার গাড়ি হিসেবেই এখনও রয়ে গেছে। আর সেই গাড়িতে চড়েই এই রাজ্যে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লকডাউনের সুযোগে প্রবেশ করে যশপ্রীতরা। মে মাসের সেই সময়ে যশপ্রীত এবং জয়পালের সঙ্গে এসেছিল ভরত কুমারও। আর এখানে এসে ব্রোকার সুশান্ত সাহার মাধ্যমে নিউটাউনের ‘সুখবৃষ্টি’ আবাসনে এন্টালির বাসিন্দা আকবর আলির ২০১ নং ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে জয়পাল, যশপ্রীত। এরপর ভরত ওরফে সুমিত কুমার ফিরে যায় মধ্যপ্রদেশে।
এডিজি এসটিএফ বিনীত গোয়েল বলেন, ‘গত ২২ মে থেকে নিউটাউনের সাপুরজি এলাকায় একটি আবাসনের তিনতলার ফ্ল্যাটে গা ঢাকা দিয়েছিল জয়পাল ও যশপ্রীত। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমরা সেখানে অভিযান চালাই।’ বুধবার দুপুরের পর থেকেই অভিজাত ওই আবাসনের চারপাশ ঘিরে ফেলেন এসটিএফ অফিসাররা। তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়েই তিনতলা থেকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে জয়পাল ও যশপ্রীত। পালটা গুলি ছুড়তে শুরু করেন এসটিএফ অফিসাররাও। এই গুলির লড়াইয়ে জখম হন এসটিএফের ইন্সপেক্টর কার্তিক মোহন ঘোষ। তাঁর কাঁধ ফুঁড়ে তিনটি গুলি কনুইয়ের নিচ দিয়ে বেড়িয়ে যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে, পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় জয়পাল ও যশপ্রীত। বিনীত গোয়েল আরও বলেন, ‘তাদের কাছ থেকে প্রায় ৮৯ রাউন্ড গুলি পাওয়া গিয়েছে। পাওয়া গিয়েছে সাত লাখ টাকা ও পাঁচটি ৯ এমএম পিস্তল।’
অন্য নামে ফ্ল্যাট ভাড়া দুষ্কৃতীদের
Follow Us :