Monday, June 16, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: আলো দেখার অনেক আগেই শিশু শোনে তার মাতৃভাষা 

Fourth Pillar: আলো দেখার অনেক আগেই শিশু শোনে তার মাতৃভাষা 

Follow Us :

নিষিক্ত হয়ে প্রাণ পাওয়ার পরে কেটে গেছে ২৭-২৮ সপ্তাহ। তার নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ সে শুনতে পায়। অদ্ভুত আলো আঁধারিতে বেড়ে উঠতে উঠতে সে হঠাৎ আরেকটা লাবডুব লাবডুব শব্দ শুনতে পায়। বড্ড কাছের বড্ড আপন, তারা শিরা উপশিরা দিয়ে যে প্রাণের রস তাকে পরিপুষ্ট করছে, এটা যে তার সেটা বুঝতে ক’দিন কেটে যায়। তারপর আরও অচেনা শব্দ, তার তখনও আলো দেখার তিন কি চার মাস বাকি, তিন কি চার মাস পরে সে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে, পরিচিত গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার বিহ্বলতায় কান্না জুড়বে, সে কান্না শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন মা ঠাকুমারা। কিন্তু সেসব তো বহু পরের কথা, তার আগেই সেই শিশু আরও অনেক শব্দ শোনে, দুটো শব্দের পার্থক্য বোঝে। হাসি-কান্না, কলতলার ঝগড়া, অপমান, ভর্ৎসনা চিৎকার বা শীৎকার তার কাছে শব্দ, কিন্তু আলাদা আলাদা শব্দ। সেই মাসছয়েকের প্রাণ তখন শব্দ নিয়ে খেলা করে, হ্যাঁ এই সময়েই সে মাতৃভাষাকে চিনে নেয়, তারপর হঠাৎ একদিন রক্তমাখা এক মাংসপিণ্ড পৃথিবীর আলো দেখার পরেই তার জমিয়ে রাখা শব্দগুলোকে সাজায় গোছায়, তার মাতৃভাষা এবার তার ঠোঁটে আসে। বর্ণমালার প্রথম অক্ষরে নয়, উচ্চারণে আসে ম ম ম এবং শেষে মা। অজান্তেই জন্ম নেয় মাতৃভাষা। 
বহু পরে দেড় বছর বিদেশে কাটিয়ে মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার নাটক যারা করে, সে নাটকের জন্ম ব্রেন সেল-এ, কিন্তু অবশ্যই মাতৃভাষায়। সেই ৬ মাসের ভ্রুণ থেকে তার শৈশব, কৈশোর যৌবন প্রৌঢ়ত্ব বা বৃদ্ধাবস্থা জুড়ে থেকে যায় তার মাতৃভাষা। এ এক আবরণ। অন্য আবরণটা কী? অন্য আবরণ হল তাকে তো বলতে হয়, মা খেতে দাও, খিদে পেয়েছে, মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, মা আমার কষ্ট হচ্ছে, মা আমার নতুন বন্ধু এসেছে দেখো। কিন্তু যদি মা না থাকে, যদি তার মাতৃভাষা শোনার বা বোঝার মানুষ না থাকে, যদি তার মাতৃভাষার জোরে সে নিজের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারে? তাহলে? তাহলে সে মাতৃভাষার থেকে দূরে যাবে, নাড়ি জুড়ে থাকা জঠরের ওম নিয়ে যে শব্দমালা জেনেছিল, বুঝেছিল, যা নিয়ে খেলা করেছিল, সেইসব শব্দ থেকে সে দূরে সরে যাবে। মানে জন্মের সূত্রে আপনি যা পেলেন তা যদি কাজেই না লাগে, তাকে বয়ে নিয়ে চলবেন ক’জন? আর খামোকা বইবেনই বা কেন? 
যে দেশে একটাই ভাষা, যে দেশের মানুষের পরিচয় তার ভাষার ভিত্তিতে, সেখানে তো সমস্যা নেই, কিন্তু যেখানে অজস্র ভাষা, অনেক বহতা নদীর মতো বহু ভাষার মানুষ যেখানে একসঙ্গে থাকেন। সেখানে মাতৃভাষা যদি সেই মানুষের বেঁচে থাকার, তার জীবনধারণের থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়, তাহলে সে ভাষা মরে যাবে এটা স্বাভাবিক। এমনিভাবেই পৃথিবীতে ডোডো পাখির মতো কত শত ভাষা মরে গেছে। সে ভাষার মানুষ প্রথমে ভেবেছে থাক না মাতৃভাষা, ও আমরা নিভৃতে নির্জনে বাড়িতে বসে অবরে সবরে আওড়ে নেব। তার রোজগারের ভাষা তার মাতৃভাষা নয়, তার আলোচনার ভাষা, সাহিত্য থেকে সিনেমা, নাটক তার মাতৃভাষা নয়, অবশ্যই কিছুদিন পরে সে ভাষা মরে যাবে। তিন জেনারেশন বিদেশে থাকা এক বাঙালির এক্কেবারে বাংলা না জানা সন্তান আমরা তো সবাই দেখেছি। কিন্তু সে তো বিদেশভূমে, আমার দেশেই, আমার মাটিতে বসেই ভাষাকে জীবন বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে কিছু মানুষ। এই সেদিন নতুন ট্রেন বন্দে ভারতে চেপে শান্তিনিকেতন যাচ্ছিলাম, কম্পার্টমেন্টের কর্মচারী হিন্দিতে কথা বলছেন, ব্যাঙ্কে যান সেখানে ইংরিজিতে কাজ চলছে। বাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রো থেকে উড়োজাহাজ, আমার মাতৃভাষা ব্রাত্য। কুকুরের নাম জনি, মেয়ের নাম পলি, মাকে বলে মাম্মা, বাবাকে ড্যাডি। দুভাবে এই কাজ চলছে, এক আঞ্চলিক ভাষাকে জীবনযাপন, রোজগার, ব্যবসার থেকে আলাদা করে দিয়ে, অন্যটা হল এক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া, একটা মাহোল তৈরি করা যেখানে ইংরিজি ভাষায় কথা বললে লোকজন মান্যি করে, পাত্তা দেয়। হিন্দিতে কথা বলে রাগ দেখানো যায়, মানে এক উচ্চাঙ্গের ভাষা যা আমার মাতৃভাষা নয়। রেস্তরাঁয়, পাড়ার মোড়ে ভুল হি সহি, গড় গড় করে অশুদ্ধ ইংরিজিতে কথা বলতে থাকা দুই তরুণের দিকে অদ্ভুত সমীহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে রিকশাওলা পঞ্চা দা, ছেলেকে শেখায়, কেউ বিস্কুট দিলে থ্যাঙ্কু বলবি, ছেলে থ্যাঙ্কু বললে সেদিন পঞ্চাদার মুখ ঝলমল করে ওঠে, কারণ ওই মাহোল, যেখানে মাতৃভাষা নয়, বিদেশি ভাষার ওজন বেশি। দুটোই খুব সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফসল। কোনও এক অজানা পদ্ধতিতে দেশের ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে বোঝানো হয়েছে দেশের জাতীয় ভাষা নাকি হিন্দি, তাই আমাদেরও বিয়ান্ধা হিমাচালা ইয়মুনা গ্যাংগা, উচ্ছলা জলাধি তরঙ্গা বলে গান গাইতে হবে, বরদাস্ত করতে হবে এই বিকৃতি, এই বাংলাতেও বসে। বাংলা যার ভাষা নয়, তাদের উচ্চারণে বাংলা শব্দ নড়ে যাবে, হেলে যাবে স্বাভাবিক, কিন্তু আমাদের কেন হবে? আমরা সেই বিকৃতি বরদাস্তই বা করব কেন? কিন্তু এটাই চলছে। চলছিল বহুকাল, মোদি সরকার এসে তাতে আরও ইন্ধন দিয়েছে তার কারণ ওনারা দেশের বৈচিত্রে বিশ্বাস করেন না, বড় জ্যাঠার মতো হিন্দি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। 
ধরুন ইউপিএসসির পরীক্ষা, আপনি হিন্দিভাষী হলে আপনার হিন্দি ইংরিজি জানাটাই যথেষ্ট, কিন্তু আপনি বাংলা বা মালয়ালম বা কন্নড়ভাষী হলে আপনাকে তিনটে ভাষা জানতে হবে, আপনার মাতৃভাষা, তার সঙ্গে হিন্দি এবং ইংরিজি। আপনি ট্রেনের টিকিট কাটবেন, রেলের অ্যাপ ইংরিজিতে না হলে হিন্দিতে। এবং এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই যাবতীয় চাকরির ইন্টারভিউ ইংরিজিতে, অতএব বাবা মা বুঝে ফেলেছেন, ছেলে বা মেয়ে ইংরিজি না পড়লে সর্বনাশ, চাকরিই পাবে না। অতএব পেটের দায়ে এবং কেতা বজায় রাখার জন্য মাতৃভাষা ফেলে হিন্দি শেখো, ইংরিজি শেখো, ফ্রেঞ্চ শেখো, চাইনিজ শেখো, বাংলা শেখার দরকার নেই। ফ্রাইডেতে মিটিংয়ের পর অ্যাট মাই হাউস, প্লিজ এসো। উইল ট্রিট ইউ উইথ হিলসা ফিশ অ্যান্ড গরম ভাত। ব্যস বাংলা শেষ। মায়ের জঠরে জমিয়ে রাখা শব্দরা তখন অনাথ, তখন তারা ক্রমশ দূরে সরে যায়, মাতৃভাষার গঙ্গাযাত্রা। আর ঠিক এমনই এক প্রেক্ষিতে, কী আশ্চর্য কিছু বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল, ছিলাহীন টান টান সে সব শরীর অনায়াসে নিয়েছে শিসের বুলেট, কবরের মাটির তলায় গিয়েও রেখে গেছে তাদের প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের পিঠে চেপেই এসেছে এক নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। হ্যাঁ হয় তোমার স্বপ্নে পাওয়া জঠরের ভাষা ভুলে খেদমতগিরি করো, যদিও সেই নরম ওমের মধ্যে থেকেই প্রেমিকার মতো শব্দ ঝরে পড়েছে, প্রেমিকের মত আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেছে তোমায়, তোমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনকে। তাতে কী, মেনে নাও হুকুম, ফরমান। জীবন থেকে বিযুক্ত হয়ে মাতৃভাষা শুকিয়ে যাক, অন্য পথ প্রতিবাদের, অন্য পথে সেই সব শব্দরাশি হয়ে উঠুক আগুনের বর্ণমালা, তাদের কোনও শব্দ হোক তীক্ষ্ণ হাতিয়ার, শানিত যুক্তি, কোনও শব্দ অমন শাসকদের প্রতি ঘৃণা হয়ে ঝরে পড়ুক, যেমনটা ঝরেছিল মুক্তি যুদ্ধে। পৃথিবীর প্রথম ভাষা আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া স্বাধীনতার লড়াইয়ে। এই শব্দের মতো রক্তের ঝরে পড়া, পরক্ষণেই রক্তের মতো শব্দদের জমাট বেঁধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠা এটাই তো একুশের শিক্ষা। সে এক বিরাট মিছিলে শামিল মানুষ, হাজারো রবীন্দ্রনাথের অবয়ব নিয়ে। জসিমুদ্দিনের নকশি কাঁথার মাঠে, জীবনানন্দের কাল আবর্তে আর নজরুলের দামামায়। সে প্রতিবাদ আজ বড় জরুরি, অমিত শাহ–মোদি–আরএসএস আমার মাতৃজঠরের শব্দ কেড়ে নিতে চায়, প্রতিবাদ আজ সময়ের দাবি। অনায়াসে আবার উল্টোপাকে আমরা মায়ের জঠরেই বাসা বাঁধি, মায়ের বুকের লাবডুব লাবডুব শব্দ, আর মুখের ভাষা আমার ভাষা হয়ে উঠুক, আজ একুশে এই কথাই আমাকে বলে গেল বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম আর শফিউর।     
     

 

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Iran | Trump | ইরানের মা/রে মাটিতে আমেরিকার F35 যু/দ্ধবিমান, চিন্তার ভাঁজ ট্রাম্পের কপালে
02:50:25
Video thumbnail
Ali Khamenei | চ‍্যালেঞ্জের মুখে ইরাক-আমেরিকার সৈন্যঘাঁটি, খামেনির হুঁশিয়ারি ট্রাম্প-ম‍্যাঁক্রোকে
01:56:09
Video thumbnail
Iran-Israel | ইরানের কাউন্টার অ‍্যা/টা/কে ছারখার তেল আভিভ, ইজরায়েলে শুধুই সাইরেনের শব্দ
02:17:50
Video thumbnail
Kedarnath | কেদারনাথ যাওয়ার পথে ভেঙে পড়ল হেলিকপ্টার, কমপক্ষে ৭ জনের মৃ/ত্যু/র আশঙ্কা
02:03:00
Video thumbnail
Iran-Israel | মাসাদ এয়ারপোর্টে ইরানের প্লেন ধ্বং/স করল ইজরায়েল, হুঁ/শিয়ারি খামেনির, অ‍্যাটাকে ইরান
02:36
Video thumbnail
Iran-Israel | মাসাদ এয়ারপোর্টে ইরানের প্লেন ধ্বং/স করল ইজরায়েল, হুঁ/শিয়ারি খামেনির, অ‍্যাটাকে ইরান
00:00
Video thumbnail
Good Morning Kolkata | সকালের গুরুত্বপূর্ণ খবর, দেখুন একনজরে সরাসরি
01:50:41
Video thumbnail
Donald Trump | ইরান-ইজরায়েল যু/দ্ধ থামবে আমার মধ‍্যস্থতায় বি/স্ফো/রক দাবি ট্রাম্পের
03:10:52
Video thumbnail
Sandeshkhali | TMC | পদ্ম ছেড়ে ঘাসফুলে সন্দেশখালির প্রতিবাদী নারীরা, কারা এলেন?
03:22:59
Video thumbnail
Iran-Israel | ‘বন্ধু’কে পাশে পেয়ে ইজরায়েলকে ডবল অ‍্যা/টা/ক ইরানের, পু/ড়ে ছাই হচ্ছে ইজরায়েল
03:26:15