আদালতের একটি রায়। তাই ফিরতেই হচ্ছে এগারো বছর আগে। ঠিক যেমন ২০১২-য় গুজরাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ফিরে গিয়েছিলাম দশ বছর আগে।
তার আগে একটু ভনিতা…
যে দেউলগুলি বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছিল, সেই দেউলের দেওয়াল থেকে একের পর এক চাঙড় খসে খসে পড়ছে। দেউল-দেবতার নগ্নরূপ আজ উদ্ঘাটিত। পুলিশ প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা অনেকদিনই গত। দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ আর নিরপেক্ষ প্রশাসন রূপকথার মতোই সোনার পাথরবাটি। বিচারব্যবস্থার অচলায়তনেও বিদ্রোহের মেঘ অনেক আগেই ঘনীভূত। বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষেণ লোয়ার মৃত্যু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সুস্থির থাকতে দেয়নি। অচলায়তনের নিগড় তাঁরা ভাঙতে বাধ্য হন। ২০০৫ সালে হায়দরাবাদ থেকে মহারাষ্ট্র যাওয়ার পথে সোহরাবুদ্দিন, তাঁর স্ত্রী কৌসর বাঈ এবং তাঁদের সঙ্গী তুলসীরাম প্রজাপতিকে গুজরাত পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পর গুজরাতের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্তভার নেওয়ার পর বিজেপি নেতা ও গুজরাতের তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী অমিত শাহ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলাটি মহারাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়। ২০১৪-য় বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর পুণের দায়রা আদালতের সংশ্লিষ্ট বিচারক জে টি উৎপত (Jaudge JT Utpat) বদলি হয়ে যান। সোহরাবুদ্দিন ও তুলসীরাম প্রজাপতি মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি লোয়ার আদালতে বিচারাধীন ছিল। ২০১৪-র ১লা ডিসেম্বর নাগপুরে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এর পর এই মামলায় অভিযুক্ত সব পুলিশ অফিসার এবং অমিত শাহ একে একে বেকসুর খালাস হয়ে যান।
২০০০ সাল থেকে এমন অনেক সংঘর্ষ, মৃত্যু ঘটেছে দেশে। ইশরাত জাহান সহ আরও তিনজনের হত্যা, বেস্ট বেকারিতে ১৪ জনের হত্যাকাণ্ড, গুলবার্গ সোসাইটিতে তৎকালীন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরি সহ ৫৯ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ড, প্রতিটি ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার সহ রাজনীতিকরা অব্যাহতি পেয়ে গেছে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাতের নারোদা গামে ১১ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের হত্যাকাণ্ডে ঠিক একই ঘটনা ঘটল। বিজেপির তৎকালীন নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মায়া কোডনানি, বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা জয়দীপ প্যাটেল সহ ৬৭ জন বেকসুর খালাস। শুধু নারোদা গাম নয়, গুজরাত দাঙ্গার বহু ঘটনাতেই দোষীদের সাজা হয়নি। নারোদা গাম নিয়েও তাই প্রশ্নের মুখে তদন্ত। একাধিক মামলায় সবে শুনানি শুরু হয়েছে। আবার বিলকিস বেগমের মতো বহু মহিলাকে ধর্ষণ ও খুনে দোষীদের গুজরাতের বিজেপি সরকার মুক্তি দিয়েছে। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আদালত অভিযুক্তদের নির্দোষ বলে মামলা খারিজ করেছে একাধিক ঘটনায়। সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে নারোদা গাম।
সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১১ জনকে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারত মাতা কী জয়’ স্লোগান দিতে দিতে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ ওঠে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের লোকজনের বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষ মদত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে নারোদা পাটিয়ার তত্কালীন বিধায়ক মায়া কোডনানির বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম ৬৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল। অথচ মায়া কোডনানি সহ সব অভিযুক্ত বেকসুর খালাস। বিজেপি নেত্রী মায়া কোডনানির নাম জড়িয়েছিল আরও একটি হত্যাকাণ্ডে। সেই মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হলেও হাইকোর্ট তাঁকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়েছে। ২০১৭ সালে নারোদা গাম মামলায় আদালত অমিত শাহকে তলব করেছিল কোডনানির বক্তব্য যাচাই করতে। শাহ আদালতে বলেন, ঘটনার দিন তিনি কোডনানিকে সকালে বিধানসভায় এবং দুপুরে স্থানীয় হাসপাতালে দেখেছেন। পুলিশের প্রহরায় তাঁদের গাড়ি হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছিল। গুজরাত দাঙ্গার একাধিক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণের মামলারই এমন পরিণতি হয়েছে। বারবার তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠলেও তা শোধরানোর কোনও চেষ্টা হয়নি। অথচ দ্রুত এবং যথা়যথ তদন্তের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট সিট গঠন করে দিয়েছিল। শুধু নারোদা গাম নয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই গুজরাতের পঞ্চমাল জেলার একটি আদালত গুজরাত দাঙ্গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৩ জনকে খুন এবং ধর্ষণ ও সম্পত্তি নষ্টের ঘটনায় অভিযুক্ত ২৬ জনকে মুক্তি দেয়। জানুয়ারিতে পঞ্চমালের আদালতই দুই শিশু-সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৭ জনকে খুনের ঘটনায় ২২ জনকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয় প্রমাণের অভাবে।
প্রমাণের অভাব, প্রভাবশালীদের মুক্তি। তবুও প্রশ্নটা উঠবেই, স্বাভাবিক, এত মানুষকে খুন করল কে? নারীর ইজ্জত লুটল কে? শিশুদের আছড়ে কুয়োয় ফেলে দিল কে? তারা কারা? ধরেই নিলাম, নেতা-মন্ত্রীরা জড়িত নন, তাহলে প্রকৃত অপরাধীদের ধরা গেল না কেন? খুনগুলো কি মঙ্গলগ্রহের কোনও জীব এসে করে দিয়ে গেছে? হাস্যকর লাগছে। ২০১২-য় গুজরাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ফিরতে চেষ্টা করেছিলাম দশ বছর আগে।
পিচঢালা চওড়া রাস্তাটা হঠাৎ সরু হয়ে নেমে গেছে ডানে। সামনেই গ্লোসাইন বোর্ড। হিন্দিতে নারোদা পাটিয়া লেখাটা বেশ পড়া যায়। পাশেই সার দিয়ে দোকান, কয়েকটা প্যাডেলওয়ালা রিকশা দাঁড়িয়ে। বাইরে রাস্তা থেকেই গলিগুলো নজরে পড়ে। দোকানঘরগুলোর মাঝে পাকা দোতলা বাড়িটার গায়ে নানান রঙের আঁকিবুকি। হঠাৎই আজানের সুর। দূরে মসজিদের চুড়োটা নজরে পড়ে। মুসলিম অধ্যুষিত মহল্লার যাপনের সঙ্গে আলাপ জমাতে মন চাইছিল। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়লাম গলিতে। গলি পেরিয়ে তস্য গলি, অবিন্যস্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের রোজনামচায় হঠাৎ ঢুকে পড়া কলকাত্তাইয়া যুবকের গতিবিধিতে রংচটা দেওয়ালের ওপারে উত্সুক চোখ। মলিন পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে আসা মহিলাদের চোখেমুখে কেমন যেন সন্দেহের কড়া নজরদারি। কোথা থেকে আগমন, কেন আসা, কী প্রয়োজন? কৌতূহলী চোখগুলো পড়ে নিতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। পা বাড়ালাম। অনেকটা ভেতরে, সারি সারি ঘর, গুমটি, খোলা মাঠ, মসজিদ, বাজার পেরিয়ে নারোদার মাটি জরিপ করে নেওয়া। সকাল পেরিয়ে দুপুর, ফের ফিরে আসা। বিকেল যখন গোধূলির সঙ্গে খুনসুটিতে মত্ত, তখন আসাদ, ইকবাল, রাকিবদের সঙ্গে গল্প জুড়েছি। ইকবালের চায়ের দোকানে জটলা নেই, রাজনীতির উত্তাপ নেই, ধুলোমাখা জীবনের কথকতা আছে, চাপা কান্না আছে, বাধ্য হয়ে মেনে নেওয়া আছে, দুমুঠো খাবারের জন্য রোজগারের আশায় উজিয়ে ভিনরাজ্যে যাওয়া আছে, আর স্মৃতি আছে অমলিন। ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাতব্যাপী বনধ। বাঘোলের নারোদা গামে ১৫০০ জনের এক উন্মত্ত দঙ্গল সকাল 9টায় জমায়েত হয় বনধ সফল করতে। সাড়ে ৯টা নাগাদ বিজেপি বিধায়ক মায়া কোডনানি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা জয়দীপ প্যাটেল দুদিক থেকে গাড়ি নিয়ে হাজির হন। তাঁরা দুজনেই এই জমায়েতের সামনে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে জনতাকে প্ররোচনা দেন। উন্মত্ত জনতা তখন ভাঙচুর শুরু করে। পাশের মসজিদে আক্রমণ চালায়। ছোট ছোট চায়ের দোকান সহ সব দোকানঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। দুজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলে এই ধ্বংসলীলা। ১২ জনের মৃত্যু হয়। মায়াকে দেখেছেন অনেকেই। অন্তত ১৪ জন সাক্ষ্য দেন। পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় মায়াকে। পুলিশ দাঙ্গাকারীদের বাধা দেয়নি। ইকবাল, রাকিবদের স্মৃতি মলিন হয়নি। নারোদা গাম থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে নারোদা পাটিয়া। প্রায় দুঘণ্টা পর মায়া সেখানে পৌঁছন। সেখানেও প্ররোচনা। গুজরাত দাঙ্গার সবচেয়ে জঘন্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সেখানেই সংঘটিত হয়। দাঙ্গাকারীদের হাতে অন্তত ৯৭ জনের প্রাণ যায়, প্রায় ২০০ জন আহত হন। সম্পত্তির খতির খতিয়ান আজও অজানা। অন্তত ১১ জন প্রত্যক্ষদর্শী কোডনানিকে প্রত্যক্ষভাবে দাঙ্গায় অংশ নিতে দেখেছেন। পিস্তল হাতে মায়ার রুদ্ররূপ দেখেছে নারোদা পাটিয়া। মামলা চলাকালীন গুজরাতের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মায়াকে নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে উন্নীত করেন। গুজরাতের তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী অমিত শাহ আদালতে মায়ার হয়ে সাক্ষ্য দেন। সকাল আটটায় তিনি নাকি মায়াকে বিধানসভার ভিতরে দেখেছেন, ১১.৪৫-এও তিনি মায়াকে বিধানসভায় দেখেছেন। অতএব ধরে নিতে হবে, ঘটনার সময় মায়া অকুস্থলে ছিলেন না। কিন্তু সাড়ে আটটা নাগাদ মায়ার গাড়ি বিধানসভা ছাড়ে বলে রেকর্ড রয়েছে, এবং সেই গাড়িতে কোডনানিকে বসে থাকতে দেখা যায়। গুজরাত দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলাগুলি বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ আদালত কোডনানিকে দোষী ঘোষণা করে। তিনিই নারোদা হত্যাকাণ্ডের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী বলে অভিহিত করে আদালত। ২৮ বছর জেলবাসের সাজা শোনানো হয়। গুজরাত হাইকোর্ট পরে অবশ্য খুন, দাঙ্গার মতো জামিন-অযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত মায়া কোডনানিকে জামিন দিয়ে দেয়। কারণ হিসেবে আদালত বলে, মায়ার ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করে, স্বামী অসুস্থ, পেটের ক্রনিক সমস্যা, অন্ত্রে সংক্রমণ।
চায়ের দোকানে বসে গল্প করতে করতে কতক্ষণ যে কেটে গেছে, খেয়ালই নেই। বাইরে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, আকাশের চাঁদটা রুটির মতো গোল। না, সেদিন পূর্ণিমা ছিল না। ইকবালদের স্মৃতির পাতায় চোখ রাখতে রাখতে মনে হচ্ছিল, ওদের জীবনে অমাবস্যা কাটার নয়। নারোদার আঁধারের বুকে লেপ্টে থাকা অভিমান আর মাটিতে কান্নার সুর শুনেছিলাম সেদিন, সেই কান্না আজও উথলে ওঠে। ইকবালদের সব হারানোর দলাপাকানো রাগ আর অসহায় চাহনি দেখে ফিরেছিলাম, আজও সেই দৃষ্টি চোখের সামনে ভাসে। উত্তাল হয়ে ওঠে স্মৃতির ঝাঁপি।