কলকাতা: রিগিং৷ ইভিএম ভাঙচুর৷ ছাপ্পা ভোট৷ বুথ জ্যাম৷ দরজা বন্ধ করে ভোট৷ গুলি, বোমা, লাঠি নিয়ে তেড়ে যাওয়া৷ অভিযোগগুলো এমনই৷ অভিযোগকারীর তালিকায় বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা৷ অপরদিকে শাসকদলের মন্তব্য, ভোট শান্তিপূর্ণ৷ অবাধ, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে অবশ্যই৷ সংবাদমাধ্যম কাঠগড়ায়৷ তারা প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে ভোটারদের৷ রবিবারের সকাল থেকে শুরু হওয়া পুরভোটের হাল হকিকত অল্পকথায় এভাবেই বোধহয় ব্যাখ্যা করা যায়৷
১০৮টি পুরসভার ভোট৷ ১৬ জন বিশেষ পর্যবেক্ষক৷ ৪৪ হাজার পুলিস৷ ৯ কোটির বেশি ভোটার৷ ১০ হাজারের বেশি বুথ৷ পরিসংখ্যানটা ঠিক এমনই৷ বিক্ষোভ, গন্ডগোল, হাতাহাতি হয়েছে বেশ কিছু এলাকায়৷ ভাটপাড়া, ব্যারাকপুর, ডালখোলা, সোনারপুর, বারাসত, কাঁথি, রিষড়া অভিযোগ এসেছে এমন নানা জায়গা থেকে৷
লাঠি উঁচিয়ে পুলিসকে তেড়ে যেতে দেখা গিয়েছে৷ পুলিসকে লক্ষ্য করে ইট-বৃষ্টি হয়েছে৷ কাদানে গ্যাসের শেল ফেটেছে৷ গুলির শব্দ শোনা গিয়েছে৷ হাতাহাতির জেরে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা ভেঙেছে৷ আক্রান্ত হয়েছে সংবাদমাধ্যম৷ দিনের শেষে আহত হয়ে মাথা ফাটতে দেখা গিয়েছে ভোটারদের-রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের৷
রাজ্যের ১০৮ পুরসভার নির্বাচনকে ভোট লুঠের শামিল বলে তোপ দেগেছে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস৷ কাঠগড়ায় তুলেছে শাসকদলকে৷ অভিযোগ করেছে, গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছে তৃণমূল সরকার৷ ভয় পেয়ে ছাপ্পা ভোট করে নিজেদের পথ সুগম করার চেষ্টা করেছে তারা৷ পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে তৃণমূল৷ ছবি-সহ তুলে ধরেছে ভোটারদের উস্কানি দেওয়ার প্রমাণ৷ নির্বাচন কমিশন যে কতটা নিরপেক্ষ সেকথা দাবি করে ঘাসফুলের মন্তব্য, অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে৷ ১০৮টি পুরবোর্ডের মধ্যে গোটা কয়েক বুথে গন্ডগোলের খবর এসেছে৷ যা বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন ও বিরোধীদের চক্রান্ত৷
বিধানসভা ভোটে বিপুল সাফল্য৷ উপনির্বাচনে জয়৷ কলকাতার ছোট লালবাড়িতে হেলায় প্রবেশ৷ তারপরেও ১০৮ পুরসভা নির্বাচনে ছবিটা একটু অন্যরকম ঠেকল নাকি!
প্রথমত, ভাটপাড়া অর্জুনের গড়৷ কোণঠাসা বিজেপি সাফল্য পেতে চাইবে স্বাভাবিক৷ পথে নামলেন স্বয়ং অর্জুন সিং৷ ক্ষোভটা ছিলই তাঁকে ঘিরেই৷ বিক্ষুব্ধ জনতা অর্জুনের পথ আটকালো৷ শুরু হল ধস্তাধস্তি৷ রাস্তায় মিলল বন্দুকের গুলি৷ অগ্নিগর্ভ হতে বিন্দুমাত্র সময় নিল না ভাটপাড়া৷ শাসকদল, প্রশাসন, কমিশন সাধ্যমত চেষ্টা করল৷ কিন্তু দিনের শেষে একটা খচখচানি থেকেই গেল৷
দ্বিতীয়ত, সোনারপুর, বারাসত, ব্যারাকপুর৷ সাত সকালে ইভিএম ভাঙার খবর সামনে এল৷ বারবার কাঠগড়ায় বিজেপি৷ ভোট লুঠের অভিযোগে বিজেপির প্রার্থীরা ইভিএম ভাঙল৷ সেই কলুষিত গণতন্ত্র৷
তৃতীয়ত, জয়নগরে বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে যেতে দেখা গেল রাজনৈতিক কর্মীকে৷ কেউ বলল, তৃণমূল৷ কারও দাবি, দুষ্কৃতী৷ দিনের শেষে রাজনীতি রক্তাক্ত হল৷ আহত হলেন দু’জন৷
চতুর্থত, ধূলিয়ান-দমদম৷ তৃণমূল-বিজেপি তুমুল রাজনৈতিক সংঘর্ষ৷ নামাতে হল বিশাল পুলিস বাহিনীকে৷ পাঠানো হল কাদানে গ্যাসের শেল৷ মাথা ফাটল কয়েকজনের৷ আঙুল উঠল প্রশাসনের দিকে৷ যদিও পুলিস দায়িত্ব সহকারে পরিস্থিতির মোকাবিলা করল৷
পঞ্চমত, খড়গপুর৷ কোণঠাসা দিলীপ ঘোষ৷ সকাল থেকেই একাধিক উস্কানিমূলক মন্তব্য৷ হয়তো সহ্যের বাধ ভাঙল সাধারণ মানুষের৷ তৃণমূল সমর্থকদের৷ মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধল৷ গুলি চলল কয়েক রাউন্ড৷ ফের প্রশ্ন উঠল, গণতন্ত্র কলুষিত হচ্ছে না তো?
ষষ্ঠত, মেদিনীপুর৷ তৃণমূলের থেকে একাধিক সুবিধা পাওয়া অধিকারী গড়৷ বর্ষীয়ান সাংসদ শিশির অধিকারীর মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ৷ সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সৌমেন্দুকে ঘিরে৷ আক্রান্ত হলেন তৃণমূল নেতা তরুণ জানা৷ হাসপাতালে ভর্তি করা হল তাঁকে৷
সপ্তমত, বহরমপুর৷ সকাল থেকেই পথে নামলেন একসময়ের ‘বেতাজ বাদশা’ অধীররঞ্জন চৌধুরী৷ যার দল আজ শূন্য৷ উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে শুরু করলেন৷ আস্তে আস্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হল৷ ভাঙচুর হল৷ পথে বসলেন কংগ্রেস কর্মীরা৷
অষ্টমত, বাঁকুড়ার সোনামুখী৷ ভুয়ো ভোটার দেখে তেড়ে গেল জনতা৷ গুলি চালালো দুষ্কৃতীরা৷ আহত হলেন একজন৷ কাঠগড়ায় শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস৷
নবমত, বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষের খবর এল বাম সমর্থকদের সঙ্গে৷ বাংলা থেকে কর্পূরের মতো উবে যাওয়া লাল মাটি ফিরে পাওয়ার যেন শেষ চেষ্টা৷ খবর মিলল তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষের৷ বাস্তব অবাস্তব, সত্যি, মিথ্যা যাচাই নয়৷ পথে নেমেছে বামেরা৷ খবর এটাই৷
দশমত, বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ পথে নেমেছে৷ আহত হয়েছে৷ পুলিস পথে নেমেছে৷ ৭৭ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে৷ কিন্তু শেষ অবধি গণতন্ত্রের উৎসব উৎসব থাকল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল৷ বাম, ডান সব দলই এখানে কাঠগড়ায়৷ সুকান্ত মজুমদার থেকে দিলীপ ঘোষ, কুণাল ঘোষ থেকে অনুব্রত মন্ডল, একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করলেন৷ রক্ত ঝরল, গুলি চলল৷ মানুষ ভোট দিলেন৷ ভোট পড়ল৷ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবি করা বাংলায় যেন কোথাও একটা কালো দাগ থেকেই গেল৷