মহালয়ার শুদ্ধ ভোরে আমরা মনে মনে পাঠ করি মাতৃমন্ত্র। যা আমাদের চেতনাকে পবিত্র হতে শেখায়। মা দুর্গা সর্বভূতে চেতনারূপে বিরাজিত, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে’। সেই মৃণ্ময়ী মূর্তির চিণ্ময়ী ভাবনায় আরাধনা হবে বারোয়ারিতে, দেবীমণ্ডপে, পাড়ার প্যান্ডেলে অথবা বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালানে। পুজোর উৎসবমুখর দিনগুলো সবার ভাল কাটুক, আনন্দে কাটুক। মিলেমিশে কাটুক, আত্মীয়তায় কাটুক, মিলনে কাটুক, বেঁধে বেঁধে থাকুক সম্পর্কগুলো। প্রদীপের নীচে অন্ধকার মুছে যাক, উৎসবে সামিল হোক উচ্চ-নীচ-ধনী-দরিদ্র-মুচি-মেথর-দারোয়ান সব্বাই।
আমার দুটো নতুন জামার বদলে আমার একটা, ওদের একটা হলে ক্ষতি কী! এক প্লেট বিরিয়ানি আমার সন্তান খাক, আরেক প্লেট স্টেশনের ওভারব্রিজে বসে ভিক্ষে করা আমানুলের সন্তান। আমার পাশে দাঁড়িয়েই আলোর রোশনাইয়ে ভেসে ঠাকুর দেখুক জইনুর, ভিখুরাম, সন্তোষ। নতুন পোশাকের আনন্দে ওদের চোখমুখে খেলে বেড়াক সেই আনন্দ, যে আনন্দ এতদিন শুধু আমার একার ছিল। আনন্দের একাকীত্ব ভেঙে ছড়িয়ে পড়ুক, দু’হাতে ওরাও তুলে নিক একগুচ্ছ সুখ, ঠিক তখন মায়ের মুখের দিকে তাকালে দেখা যায়, অপলক সুরমূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর, বাপের বাড়িতে উমা আজ বড্ড খুশি। উৎসব-খুশি-প্রীতি-আনন্দের মিশেল নিয়ে ওদের আটপৌরে দিন-আনা দিন-গুজরান নিয়েই মা আসছে। বারোয়ারি পুজোর ম্যারাপে লেপ্টে থাক আমরা-ওরার সম্মিলিত স্পর্শমালা। সব বাধা, বারণ ভুলে ওদের সন্তানদের ধুলোবালি মাখা জীবনের সঙ্গেই মিলেমিশে যাক আমাদের সন্তানদের বিত্ত। কাজের মাসি, ধোপা, সুইপার, পেপারের হকার, সবার জন্য পুজোর অগ্রিম বখশিসের পরিমাণটা এবার না হয় অনেকটাই বাড়ুক। ওদের সন্তানও যেন থাকে দুধেভাতে। পুজো মানেই তোমার আনন্দ ওই এলো দ্বারে, এলো এলো এলো গো, ওগো পুরবাসী। মা আসছে, ঘরের মেয়ে ঘরে আসছে। আকাশে-বাতাসে আগমনীর সুর। মাতৃবন্দনার কাল সমাগত।
মেনকাদুলালী উমা অন্য রূপে দুর্গা। যে শক্তিকে জানা যায় না, দুর্জ্ঞেয় তিনিই দুর্গা নামে পরিচিত। এই দুর্জ্ঞেয় শক্তিই ওদের মুখে হাসি ফোটাবে, তোমার আমার বিত্তবৈভবের একপশলা নিয়ে। দেবী যেমন সংসার বন্ধনের কারণ স্বরূপ অবিদ্যা আবার তিনিই অপর দিকে সংসার-বন্ধন-মুক্তির কারণস্বরূপা ব্রহ্মবিদ্যা সর্বেশ্বরীও। মা আসছেন মর্ত্যে। নিত্যনৈমিত্তিক যাপনের যাবতীয় খারাপ লাগা, কটু ও বিমর্ষ দূরে সরিয়ে রেখে আমরা, তোমাদের এবং ওদের সঙ্গে নিয়েই আনন্দযজ্ঞে মেতে উঠব। ওদের মনেও কাশফুলের দোলা, কুমোরটুলির মৃণ্ময়ী মূর্তির ছবি, শরৎ আকাশের মারকাটারি সাদা মেঘের ছবি, ঝুড়িতে সাজানো কমলা সাদা একগুচ্ছ শিউলি ফুলের ছবি কোলাজে, আদরে একাকার। যা কিছু গ্লানি, জড়তা, হীনতা সব কিছু ঘুচিয়ে দিয়ে ওরাও থাকে এধারে, আমাদের মনের কাছে, আনন্দের কাছে, উৎসবের উঠোনে সারিবদ্ধ। শারদ অর্ঘ্যে শুচি হয় মন। দশপ্রহরিনী দুর্গার অসুরদলনী তেজ ও বিভিন্ন আযুধে সমাজ সংসারে যাবতীয় হীনতা, অপূর্ণতা, দুর্বিপাক, দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটিয়ে নতুন শান্ত সুসংহত জীবনের প্রার্থনা ধ্বনিত হয় আমাদের মনে।
মা আসছে, আমরা সবাই তো মায়েরই সন্তান, কোন ভেদ নেই, দ্বন্দ্ব নেই, অফুরান ভালবাসা আছে, সম্পর্কের ঐশ্বর্য আছে, বেঁধে বেঁধে থাকার আর্তি আছে, আনন্দের সবটুকু আমাদের, তোমাদের, ওদের, কেউ একবিন্দু অবহেলিত হবে না, শপথ নেব না কেন? মা আসছে, বিবর্ণ টালির ফাঁক দিয়ে খুশির রোদ আছড়ে পড়ছে, স্যাঁতসেঁতে বিছানায় হাসনুহানার গন্ধ, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রঙিন নতুন পোশাক।