বৈশাখ এসেছে খরতাপ তীব্রতা নিয়ে। ইদানীং লোডশেডিং জিনিসটা প্রায় উঠেই গিয়েছে। তালপাতার হাতপাখা একমাত্র দেখা যায় ওই একদিন পয়লা বৈশাখের ক্রিয়েটিভে। শুভ বৈশাখের পাশে রাখা হাতপাখা। বা কখনও লালশালুতে বাঁধানো হালখাতার ছবি। ষোলো আনা মুদ্রার সিঁদুর টিপ ছাপ।
তালপাতার হাতপাখা। তাতে রংবেরংয়ের কারুকাজ। বাইরের দিকে কাপড়ের কুঁচি-সেলাই। বৈশাখের দিনে গরমে মা-ঠাকুমারা অক্লান্ত ভাবে তাঁদের সন্তানের শরীরে বাতাস করে চলেছেন। এক সময় সারাদিনের বিরামহহীন খাটনির ভারে চোখ আঠার মত লেগে আসছে। আর ঠকাস্ শব্দে পড়ে যাচ্ছে সেই হাতপাখা। আওয়াজে জেগে উঠে ততোধিক দ্রুততায় পাখা কুড়িয়ে নিয়ে আরও বেশি গতিতে বাতাস করছেন বরিশাল থেকে কলকাতার ঘুপচি সিআইটি কোয়ার্টারে ঠাঁই নেওয়া লীলাবতী। আমার মায়ের মা।
গরমের দিনে মেঝেতে শোয়ার চল ছিল। দুপুরের ভ্যাপসা খুপরি ঘরে গাদাগাদি লোকজন। সিলিং ফ্যান ঘুরছে। গ্রীষ্মের দুপুরে পুরোনো সিলিং ফ্যান ঘুর্ণনের যে শব্দ তাতে একটা অদ্ভুত মাদকতা রয়েছে। কখনও তা আবার একঘেয়েও। ফ্যান ঘুরছে তবু গুমোট কাটছে না। পিঠের দিক করে শুলে মেঝে আর শরীরের সংযোগে চটচটে ঘাম। এবার একদিক ফিরে সাইড হয়ে শোয়ার চেষ্টা। হঠাৎ লোডশেডিং। ব্যস দুপুরের শোয়া মাথায়। ‘জ্যোতিবাবু চইল্যা গেলেন’। আবার কারেন্ট এলে ‘জ্যোতিবাবু আইলেন’। এভাবেই কেটে গিয়েছে কত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্যের খর রৌদ্রের অলস দুপুর।
পয়লা বৈশাখের সন্ধেয় পাড়ার দোকানে নিমন্ত্রণ থাকত। মিষ্টিমুখ, রঙিন শরবত সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডার। এই জিনিসটি ছিল দিদা-ঠাকুমাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং কাঙ্খিতও। তিথি-নক্ষত্র-পূর্ণিমা-অমাবস্যা-একাদশী-মল মাস-পুজোপাব্বনের তারিখ দেখে নিতে হত মাঝে মধ্যেই। ক্যালেন্ডারে থাকত ঠাকুর-দেবতার ছবি। বা কখনও রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-নেতাজির মতো দেখতে মনীষীর হাতে আঁকা ছবিও। একটু সচ্ছল দোকানিরা বাড়ির জন্য খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিতেন। ক্যাম্পাকোলা বা গোল্ডস্পট খেতে দিতেন। স্ট্র দিয়ে পানীয় অল্প করে করে টানতাম। যাতে এই অমৃত দ্রুত ফুরিয়ে না হয়ে যায়।
কাঁচা আম এক ঝুড়ি। কেটেকুটে ভিতরের শাঁস বের করে, রোদে ফেলে রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ের উপর আম রোদ খাচ্ছে। এ’রকম পরপর দু’দিন টানা রোদ্দুর খেয়ে আমের জল শুকিয়ে গেলে, তাকে নুন-হলুদ-তেল মাখিয়ে ফের একপ্রস্থ রৌদ্রস্নান। পরে তেল, পাঁচফোড়ন, রাধুনি, ভাজা শুকনো লংকা, ভাজা মৌরী, আমচূর্ণ এ সব দিয়ে কড়াইয়ে মাখামাখি করে বয়ামবন্দি। এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যেই এক দু’টুকরো চালান হয়ে যেত ভাইবোনেদের পকেটে। কখনও চুরি আবার কখনও আবদারে চেয়ে নেওয়া। মহার্ঘ সেই আচারের বয়াম বাঁধা থাকত রোদপড়া জানলায় শিকের সঙ্গে। সেই রোদ্দুর কবে কোথায় কতদূর চলে গেল! খাঁ-খাঁ বৈশাখের দুপুরে দিদাঠাকুমাদের পাকাচুলের তেলগন্ধস্মৃতিমাখা দেওয়াল ঘড়ি যেন পূর্বজন্মকে মনে করিয়ে দেয়। কী একটা অচেনা পাখি ডাকতে থাকে। কিছুতেই তার নাম করে পারি না।