শ্রেয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা
দেখতে দেখতে এই শহরের বয়স হল ৩০০ বছর। কত কিছুর সাক্ষী থেকে এই শহর। রাজনীতির কলবর থেকে সাহিত্যের মাদকতা। ময়দান, গঙ্গাঘাট, রাজপথ থেকে অলিগলি জানে আমার আপনার মতো মানুষের ব্যর্থতা থেকে প্রেমের গল্প। আর এ জানে শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা ধমনীর মতো ট্রাম লাইলেন ইতিহাস। কলকাতার আইকন ট্রাম (Icon of KolkataTrams)। প্রায় ১৫০ বছরের ঐতিহ্যকে বুকে নিয়ে আজও কোন ক্রমে মাথা তুলে বেঁচে আছে। বর্তমানে এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত একটি রুটে চলে। বাকি রুটে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পরিষেবা। এবার ট্রাফিক সমস্যার ও শহরের গতি বজায় রাখতেই নাকি কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করা হচ্ছে। সত্যজিৎ রায়ের মহানগরে শুধু মাত্র ট্রামের উপর ফোকাশ করে টাইটেল সিকোয়েন্স চিত্রায়িত করা হয়েছিল। ট্রাম না থাকলে ওই দৃশ্য কী ভাবে ফুটিয়ে তোলা হত টা জানা নেই। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘কালপুরুষ’, শিবপ্রসাদ মুখ্যোপাধ্যায়ের প্রাক্তন, সৃজিত মুখ্যোপাধ্যায়ের ‘এক যে ছিল রাজা’ রাজ চক্রবর্তীর ‘পরিণীতা’। বাস্তবের মতো সিনেমার পর্দায় বারবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে ট্রামকে। কলকাতার রাস্তা থেকে ট্রাম চিরতরে মুছে যাওয়ায় মন খারাপ নস্ট্যালজিক বাঙালির।
ব্রিটিশদের হাতে তিলোত্তমায় ট্রাম যাত্রা শুরু হয়েছিল। সালটা ১৮৭৩ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয়েছিল। ১৮৮২ সালে ঘোড়ায় চালিত ট্রাম বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর বাষ্পচালিত লোকোমোটিভগুলি কলকাতায় চালু হয়। এর দুই দশক পরে ১৯০২ সালে, শহরে বৈদ্যুতিক ট্রামের জন্ম। তখন থেকেই কলকাতার গর্ব। ট্রামের মন্থরতা একরকম মিশে গিয়েছে ধীর গতির শহরের সঙ্গে। সাহিত্য কবিতায় বার বার জায়গা করে নিয়েছে। ময়দানের বুক চিড়ে যখন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছে তখন প্রাচীন গাছের ফাঁক দিয়ে চুপটি করে দেখেছে কত যুবকের পথ চলা। আবার কত সম্পর্কে দাঁড়ি পড়ার কাহিনীও দেখেও চুপ করে রয়েছে। কলকাতাবাসী আর শহরে ঘুরতে আসা প্রায় সকলেই কমবেশী ট্রামে চেপেছে। এ এক অন্য নস্ট্যালজিক। এই গর্ব আর বেশিদিন চলমান থাকবে না। এবার ইতিহাসের পাতা জুড়ে বাংলা হরফে লেখা থাকে কলকাতার আইকন ট্রামের ইতিবৃত্ত। অনেকের মতে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে অনেক কিছুই মুছে গিয়েছে। তবে কলকাতায় ট্রাম তো শুধুই আনন্দ পাওয়ার জন্য নয়, এ ছিল চলমান ইতিহাস।
আরও পড়ুন: খাদানের নতুন গান ‘রাজার রাজা’-এর ঝলক
কথায় আছে প্রেমের শহর কলকাতা। তার বুকে মুক্ত বিহঙ্গের মত ছুটে বেড়াচ্ছে ট্রাম। হয় তো মনে হবে এত সকলের জানা কী আর নতুনত্ব লিখলাম। ট্রাম নিয়ে আমরা চোখে ধরা পড়ে কত বিভিন্ন গল্প। ৯ দশকে বড় হয়েছি কলকাতায়। আমাদের সময়ের ছেলে মেয়েরা শহরের অনেক হারিয়ে যেতে দেখি আবার অনেক আধুনিকতা প্রযুক্তিকে আপন করে নিত্যদিনের সঙ্গী করে নিয়েছি। ফেরা যাক ট্রামের কথায়। বেহালায় বড় হয়ে ওঠা। সেই সময় ধর্মতলা থেকে বেহালা ট্রাম চলত। আর সেই সময় প্রথম বাবার হাত ধরে ট্রামে উঠেছিলাম। তখন কী আর জানতাম একদিন এই ট্রাম শহরের বুক থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। এই ট্রামের দৌলতে আস্ত একটা জায়গার পরিচিত হল বেহাল ট্রাম ডিপো নামে। কিন্ত কী অদ্ভুত দেখুন জায়গাটা যার নামে পরিচিতি পেল সেই ট্রাম শহরের বুক থেকে হারিয়ে গেল। একবার কলেজে পড়ার সময় প্রথম প্রথম কলেজ স্ট্রিট যেতে শিখেছি। কিন্ত মুসকিল হল ফেরার সময় বাসের অভাব। তখন মুশকিল আসান সেই ট্রাম। দ্রুততার ভিড়ে মধ্যেও নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখে কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলার দিকে এগিয়ে চলেছে। এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত যে রুট চলে যেত ময়দানের সবুজের বুক চিরে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। দ্যসি দামালরা ময়দান কাঁপিয়ে ট্রামের চড়ে বাড়ি ফিরত। রাস্তার অগুনতি মানুষ, তাঁদের হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখের প্রমান বহন করে চলেছে কল্লোলিনী। সঙ্গে যৌবনের ক্লান্তি বুকে নিয়ে বয়সের ভারের সঙ্গে অস্তিত্ব সংকট নিয়ে ঘড়ঘড়ে চেনা শব্দ করে এগিয়ে চলেছে।
কলকাতাই এর মন্থরতা ধরে রেখেছিল। মৃনাল সেনের লেন্সে ধরা পড়েছিল কলকাতার ট্রামের প্রত্যাহিক কাহিনী। বাঙালির গান, সাহিত্য, প্রেম, এবং আরও অনেক কিছু জুড়েই ছড়িয়ে ছিল ট্রাম। কিন্ত আজ তার প্রয়োজন নেই এমনটাই মনে করছে প্রশাসন। কত মামলা-মোকদমা হল কিন্ত শেষ মেষ পরিণতি কী হবে তা সবার জানা। আধুনিক সময়ে এই দ্রুত আরও দ্রুত বেঁচে থযেমন যে লড়াই তাতে অস্তিত্ব সংকটে। কে ঠিক করবে যোগ্যতম কে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত অনেকর অজানা। পরিবেশবান্ধব হলেও সময়ের পাল্লাই যে ভারী হল। আরও অনেকটা স্মার্ট হল কলকাতা। নস্ট্যালজিয়া চুলোয় গেল। অথচ বিশ্বের বহু উন্নত এবং আধুনিক শহর যেমন ভিয়েনা, মিলান, বার্লিন, লিসবন, মেলবোর্ন শহরে এখনও ট্রাম চলে। তাহলে এই শহর কি দোষ করল? যাত তো বাঙালি, চায়ের দোকানে বসে আলোচনায় ঝড় তুলবে। কিংবা বিদেশের রাস্তায় ট্রাম দেখলে প্রবাসী মনে ভেসে ওঠে কল্লোলিনী বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া অহংকার। কিন্ত এগিয়ে এসে বন্ধের প্রতিবাদ জানাবে না। শহরের ট্রাম ডিপো গুলো আজ ভাসানের পর শূন্য মণ্ডপ। আজ সেই জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে মাল্টিপেক্স। প্রশাসন ভাতা দিতে ব্যস্ত, কিন্ত ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা কোনও প্রচেষ্টা নেই। তিলোত্তমা বারবার নানা ইস্যুতে গর্জে উঠেছে। এবার কেন নিশ্চুপ?
অন্য খবর দেখুন