কলকাতা: শহর জুড়ে আলোর বন্যা। মহানগরীর বুকে নামল উৎসবের বিক্রম। জ্ঞান-প্রজ্ঞান ভুলে মানবযান প্রদক্ষিণ করে চলেছে কলকাতা নামের গ্রহকে। ষষ্ঠীর সকাল থেকেই রঙমশালের মতো রঙের ঝরনাধারায় ধুয়ে গিয়েছে গলি থেকে রাজপথ। সন্ধ্যা নামতেই তাতে লেগেছে বিস্ময়ের পোঁচ। সব প্যান্ডেলকে যেন নিমেষে চেটেপুটে নিতে ভিড় শেষমেশ সাগরের চেহারা নিল সূর্যাস্তের আগেই।
ষষ্ঠীর দুপুরে অনেকেই সেরে নিলেন শেষ ওভারের বাজার। দুপুরে হাতিবাগানে দেখা হল অতসীর সঙ্গে। এসেছেন বেলঘরিয়া থেকে। তাঁর মাকে সঙ্গে নিয়ে। বললেন, টুকটাক কটা গয়না কিনে উত্তরের কয়েকটা ঠাকুর দেখে ফিরবেন। একই ছবি ধরা পড়েছে গড়িয়াহাট, ধর্মতলাতেও।
ভরদুপুরে ডোভার লেনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুরঙ্গমারা। এসেছেন বালি থেকে। বেহালা থেকে ডোভার লেনে এসে পা আর চলছে না। প্রখম বর্ষের পাঁচ বন্ধু এই প্রথম স্বাধীনভাবে পুজো দেখতে বেরিয়েছেন। বার দুয়েক পথ হারিয়েছেন। এখন খিদের চোটে নাজেহাল। কিন্তু কোনও রেস্তরাঁতেই ঠাঁই নেই। কোথাও এক ঘণ্টা তো কোথাও তার বেশি অপেক্ষা। অগত্যা শক্ত চামড়ার মতো এগরোল…।
আহিরীটোলা সর্বজনীনের পাশে একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রায় ষাটোর্ধ্ব ঠাকুমা অতসীদেবী। বিধবা মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন নাতি-নাতবউয়ের অপেক্ষায়।
আপনি যাননি?
প্রশ্ন করতেই বললেন, ওরে বাপ আর পারছি না। সেই গড়িয়া থেকে এসেছি। তারপর বাগবাজার হয়ে এখানে। এবার নিমতলায় ঢুকে পড়লেই বাঁচি বাবা।
সকালে পোঁটলায় চারটে রুটি বেঁধে এনেছেন। এখন প্রায় দুপুর তিনটে। নাতি বেরলে একটা আইসক্রিম খাওয়ার আবদার মনে পুষে রেখেছেন।
এখন কলকাতায় সন্ধ্যা জাঁকিয়ে বসেছে। জ্বলে উঠেছে যেন আসমুদ্রহিমাচলের বাতি। কে বলবে, এখন ৭টা বাজে! পুজোর ভিড় ধীরে ধীরে কৈশোর কাটিয়ে যেন যৌবন পাচ্ছে। একদল ফিরছেন ঘরের দিকে। অন্য দল বেরিয়ে পড়েছেন নতুন উদ্যমে।
বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের সামনে দেখা গেল বেশ কয়েকজন টুরিস্ট নিয়ে এসেছে কেরলের এক অপারেটর। প্রত্যেকের মাথায় একরঙা টুপি। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মানুষ-ষাঁড়ের গুঁতোগুঁতি করে ঠাকুর দেখেছেন। ভাঙা হিন্দিতে ম্যানেজার বললেন, এই প্রথম, এই শেষ। কাল কালীঘাট, আর অষ্টমীতে বেলুড়-দক্ষিণেশ্নর দেখিয়ে নবমীতে রেস্ট। বিসর্জনের পরদিনই ট্রেন।
কেমন লাগছে কলকাতার পুজো?
জবাবে এক বৃদ্ধ একগাল হাসলেন।
ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলাম শ্রীভূমির কাছে। দুরন্ত বর্ষায় যেভাবে নদীর জল বিপদসীমা অতিক্রম করে, তেমন অবস্থা। ডিভিসির ছাড়া জলের মতো লোকস্রোত দৌড়চ্ছে। একটা পায়ে হোঁচট খেলেই…। মোবাইল উঁচিয়ে পিলপিল করে পিঁপড়ের মতো মানুষ চলেছে কোন এক সম্মোহনে।
ভিআইপি রোডের বাতাসে তখন সামান্য শিরশিরে ভাব এসেছে। ফুটব্রিজ স্টপে তখনও লোক দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায়।
একটু দূরে একটা বাচ্চা ছেলে তার দিদির সঙ্গে পাথরের দুটো টুকরো বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করছে।
বেসুরো সেই চিৎকারে অনেকে বিরক্ত হয়ে ভিক্ষা দিচ্ছেন। ডিজনিল্যান্ডের খুব কাছেই হয়তো তাদের বাস্তবের উত্তরণ। আমরা কেউ তা জানি না।
চমকে উঠলাম একজনের কথা শুনে।
রাজা, ফেলো ফেলো না। অ্যাই তুই খাবি?
এক মহিলা ছেলের আধ খাওয়া আইসক্রিমটা বাড়িয়ে দিলেন ভিখারি ছেলেটার দিকে।
ভাইবোন তখন আর্তনাদ করে গাইছিল, ইয়ে দুনিয়া, ইয়ে মেহফিল, মেরে কাম কি নেহি…।
পাশের সার্ভিস রোড দিয়ে তখন একদল ছেলে বলতে বলতে চলে গেল, বলো দুগ্গা মাইকি জয়।
বোধনের রাতেই তাদের উপহাসের রেশটা যেন কানে লেগেই থাকল।