কলকাতা: বিখ্যাত কাগজের সাময়িকীর প্রচ্ছদ জানাল, আজ বেঁচে থাকলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (Hemanta Mukherjee) বয়েস হত ১০৫। নেট অবশ্য জানাচ্ছে জন্ম ১৯২০।
মনে পড়ে গেল, হেমন্ত আজীবন মোহনবাগান সমর্থক। খেলার খবরটবরও যথেষ্ট রাখতেন। চুনী গোস্বামীর মুখে শোনা। রোভার্স ফাইনালের টিকিট চেয়েছেন হেমন্ত। কিন্তু চুনী পকেট থেকে টিকিট বার করছেন না। বলছেন হেমন্তদা ,নতুন গান শোনালে তবে টিকিট। দুর্দান্ত সম্পর্ক ছিল দু’জনের। হেমন্ত হাসতে হাসতে বললেন ,দাঁড়া একটা গান কালই তুলেছি। শোন। গাইলেন ,অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে।
আরও পড়ুন: ইভিএমে ভোট দান ও ফল গোনার মধ্যে ৪৮ লাখ তফাত শুধু উত্তরপ্রদেশেই?
হেমন্ত জন্মানোর মাসকয়েকের `মধ্যে বাঙ্গালি জীবনে আরো একটা যুগোত্তীর্ণ ঘটনার জন্ম। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তিনি সেইসময়কার কলকাতার অবিমিশ্র বাঙ্গালি। ধুতি। শার্ট। ব্যাকব্রাশ করা চুল। কংগ্রেস। আর মোহনবাগান।
হেমন্তর সঙ্গে এমনিতে আলাপ .হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওঁর বর্ণময় জীবনের কোনও শুকনো পাতাও আমার হওয়ার কথা নয়। উনি চলে যান ১৯৮৯-তে । আমার চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের বিনোদন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া এবং পরের বাইশ বছর টানা সেই পদে থেকে যাওয়া ১৯৯৫ সালে। আসলে ওঁর সঙ্গে মৃদু আলাপ হওয়াটা সাংবাদিকতায় আসার আগে। তখন পাড়ার সুভেনির সম্পাদনা করি। শেষ মুহূর্তে একটা লেখা লাগবে। কারণ আমাদের প্রিয় সাগরদা হঠাৎ মারা গিয়েছেন।
সাগরদা –সাগর সেন। দক্ষিণ কলকাতার মহানির্বাণ রোডবাসীরা তখন বাংলা সংস্কৃতির গর্ভগৃহে বাস করেন। ওপাড়াতেই জোছন দস্তিদার। যিনি কয়েকবছর বাদে জন্ম দেবেন বাংলা সিরিয়ালের। ওদিকটা বিশ্বভারতীর সহউপাচার্য প্রতুল গুপ্ত। পণ্ডিতিয়ার দিকে গায়ক তরুণ বন্দোপাধ্যায়। ট্রামলাইনের পেছনে অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়।
আর তিনি রুদ্ধসঙ্গীতের মূর্ত প্রতীক দেবব্রত বিশ্বাস। কিন্তু সাগর সেনের এবং তাঁর ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশি।
ঠিক হল সাগরদার ওপর কাউকে দিয়ে লেখাতে হবে। কে পারবেন ? সবচেয়ে সহজ হত দেবব্রত বিশ্বাসকে ধরা। এত আগলহীন জীবনযাপন ছিল যে আমাদের বন্ধু বাপির ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের ওপর দোতালা বাড়ি থেকে আমরা ওঁকে নিয়মিত হা করে দেখতাম। কিন্তু তখন তো তিনিও ইহজগতে নেই। ঠিক করি কপাল ঠুকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাব। আজকের দিন হলে নির্ঘাত উবের নেওয়া হত। কিন্তু তখনকার দিনে মহানির্বাণ রোড থেকে মেনকা হাঁটা দূরত্ব। ভুল বললাম আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা অনেক বুদ্ধি ধরে। তারা এরকম দুমদাম মহাতারকার বাড়ি যাবেই না। তা-ও আবার ফরমায়েশ নিয়ে।
প্রথম দিন খোলা পাওয়া গেল না মেনকা সিনেমার ঠিক সামনের বাড়ির গেট। নিচ থেকেই দরজা বন্ধ । দ্বিতীয় দিন যে গেট খুলল সে ওপরে খোঁজ নিয়ে বলল, বাবু ডাকছেন । আমরা পাড়ার দুই বন্ধু আমি আর কালিদাস গটগট করে ওপরে উঠে গেলাম। গিয়ে আরো চমক। হাসিমুখের হেমন্ত দাঁড়িয়ে আছেন সম্পূর্ণ অপরিচিত দুই যুবককে অভ্যর্থনা করার জন্য।
ঠিক পেছনের রাস্তায় থাকতেন আমার দেখা সবচেয়ে রূপবান বাঙ্গালি পুরুষ। আগের দিন একই সুভেনিরের জন্য লেক টেম্পল রোডের বাড়ি থেকে অন্য বিষয়ে তাঁরও লেখা নিয়ে এসেছি।
তখন জানতাম না বহুবছর বাদে সংবাদ প্রতিদিন কফিহাউসে যে সেই রূপবান ভদ্রলোকের অনুলিখন করার দায়িত্ব পাবো আমি। আর আঠারোটা চ্যাপ্টারের মধ্যে একটা চাপ্টারের হেডিং হবে —হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সদাশয়তা। হেমন্তর উদারতা নিয়ে যখন বলছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ,তখন আমি আনমনা হয়ে আশির দশকে শালপ্রাংশু মানুষটার সঙ্গে কথা বলে চলেছি।
একটা আবদার নিয়ে এসেছি। কিছু মনে করবেন না।
বলো না।
আমরা সাগর সেনের পাড়ার। এই মৃত্যুতে আমরা সবাই খুব শোকার্ত। পাড়ার সুভেনিরের জন্য ওঁর ওপর একটা লেখা চাই।
ঠিক আছে। সাগর আমারও খুব প্রিয় শিল্পী। তোমরা মঙ্গলবার এস। আমি বলবো তোমরা লিখে নেবে।
এরপর লেখাটা মঙ্গলবার ডিক্টেট করলেন। একমিনিট দাঁড় করাননি । মুখে সেই হাসি আর সৌজন্য। এত অমায়িক যে বললে বিশ্বাস হবে না গোটা ভারত এঁকে হেমন্তকুমার নামে চেনে।
লেখাটা তৈরি করে যখন দেখাতে যাই দুটো লাইন অ্যাড করেছিলেন , সাগর খুব বড়মাপের শিল্পী ছিল। ও চলে গ্যাছে ঠিকই। কিন্তু পুরোপুরি কখনো হারিয়ে যাবে না। ও বেঁচে থাকবে ওর গানের মাধ্যমে। শিল্পীরা যেমন সময় থেকে আর এক সময়ে তার সঙ্গীতেই বেঁচে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
বহুবছর পরে লতা মঙ্গেশকরের ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় তিনি মান্নার কথা ততটা নয়। বারবার করে বলেছিলেন ,সলিল চৌধুরী আর হেমন্তর কথা । বিশেষ করে হেমন্ত যে তাঁকে বলতেন এই লতা একদম হিন্দি নয়। পুরো বাংলায় বলবে। বাঙ্গালি খাবার খেতে হবে। পুরো সুর করে হেমন্তর গলায় বলেছিলেন।
সারমর্ম —হেমন্ত হলেন সঙ্গীত জগতের বটগাছ। সবাইকে আলো দেওয়ার রেডিমেড প্যাকেজ। বড় চেহারা এবং তারও বড় হৃদয়।
শুনে এতটুকু অভিভূত হইনি । লতা হলেন সংগীত জগতের উদীয়মান সম্রাজ্ঞী।
সৌমিত্র তিনি শুরু থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের সুদৃঢ় মিনার।
এঁরা সদাশয়তা পাবেন আশ্চর্য কী।
কিন্তু অজানা -অচেনা তরুণ যে সহৃদয়তা এবং সহযোগিতা পেয়েছিল তার লম্বা সাংবাদিক জীবনে তেমন দু’তিনটি তুলনাও আছে কিনা গভীর সন্দেহ। সে কী করে উপড়ে ফেলে অভিভূত হওয়ার সেই আশির দশকে গেঁথে থাকা চিপটা ?
কেন ওঁর নাম হেমন্ত দেওয়া হয়েছিল কে জানে ? উনি ঝরা পাতার কারবারি কোন দুঃখে হতে যাবেন ?
আজ ১০৫তম জন্মদিন হোক বা ১০৪। তিনি বাঙ্গালির বা গোটা ভারতের ভালোবাসায় অবিনশ্বর। সংগীতের ঋতুরাজ।
বসন্ত মুখোপাধ্যায় !