বাবা-মায়ের খুনের ‘বদলা’। না, হিন্দি বা দক্ষিণী সিনেমার নায়কের কায়দায় নয়। আইনের দরজায় খটখটিয়ে বিচার না-পেয়ে বাহুবলি হয়ে ওঠাও নয়। বরং, এ কাহিনির প্লট থুড়ি বাস্তব ছবিটি পুরোটাই উল্টো। বাবা-মায়ের খুনের সুবিচার আদায়ে নিজেই আইনজীবী হিসেবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সত্য ঘটনা। আর সেই সত্যকে মুঠোবন্দি করে দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই চালিয়ে আজ কাকদ্বীপের দীপঙ্কর দাস গম্ভীর গলায় বলে উঠতে শিখেছে, ধর্মাবতার…!
এবার যাওয়া যাক ফ্ল্যাশব্যাকে। ২০১৮ সালের ১৩ মে। রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের রাত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের নিজেদের ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ির ভিতর থেকে দগ্ধ হয়ে যাওয়া বাবা দেবু দাস ও মা রানি দাসের মৃতদেহ পায় দীপঙ্কর। তাঁর বাবা-মা দুজনেই এলাকায় সক্রিয় সিপিএম কর্মী ছিলেন। সিপিএমের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা এই খুন করেছে।
আরও পড়ুন:
জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার সেই আগুন ঠান্ডা হওয়ার আগেই দীপঙ্করের লড়াইয়ের দৌড় শুরু। বিচারের জন্য তাঁর সংগ্রাম ওই চিতার আগুন থেকেই শপথ নেয়। সিপিএমের লিগাল সেলের সহায়তায় তরুণ দীপঙ্করের সেই প্রথম আদালতে চৌকাঠ পেরনো। বাবা-মায়ের দেহ পেতে আদালতের দ্বারস্থ হন। প্রায় ৫ দিন পর আদালতের নির্দেশে বাবা-মায়ের দেহ পান দীপঙ্কর। বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাঁর অবিচল আস্থার সেটাই ছিল অঙ্কুরোদ্গম।
তারপর কেটে গিয়েছে ৪ বছর ও আরও কয়েক মাস। ২৮ সেপ্টেম্বর দীপঙ্কর উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের একটি বেসরকারি আইন কলেজ থেকে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়ে স্নাতক হয়েছেন। বাবা-মায়ের জিন ধরে রেখে সিপিএমের সক্রিয় কর্মী ২৪ বছরের দীপঙ্করের ভাষায়, সুবিচারের জন্য লড়াই জারি থাকবে। তিনি বলেন, প্রশাসনিক গাফিলতির শিকার হওয়া মানুষের জন্য কাজ করবেন। শাসকের অত্যাচারে বোবা হয়ে থাকা মানুষের মুখে প্রতিবাদের ভাষা জোগাবেন দীপঙ্কর।
আরও পড়ুন:
তিনি বলেন, শুধু আমি নই। হাজার হাজার মানুষ রোজ বিচারের আশায় আদালতের দরজায় কড়া নাড়ে। আমার লড়াই তাঁদের সঙ্গে। দীপঙ্করের আইন পাশ করার পরদিনই বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা যিনি তাঁর মামলা শুনছেন, তিনি পুলিশকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। এফআইআরে নাম থাকা ব্যক্তিদের কেন পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, তা জানতে চান বিচারপতি।
সওয়ালে দীপঙ্কর বলেন, পুলিশ আগুন লাগার কারণ হিসেবে জানায় শর্ট সার্কিট হয়েছিল। এটা ঠিক নয়। এমনকী আমি এফআইআরে যাদের নাম দিয়েছিল, আজ পর্যন্ত পুলিশ তাদের জেরা করেনি। উপরন্তু, এই মামলায় কয়েকজন নিরপরাধ সিপিএম কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর এই নতুন জীবন পেয়ে একবার নিজের গ্রামে পা রাখতে চান দীপঙ্কর। বলেন, আমার কোনও সন্দেহ নেই যে, এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর কিনারা আছে। সেটা সেই আলো যার দিকে তাকিয়েই আমি এতটা পথ লড়ে এসেছি।