বিরোধীদের জোট আজকের বিষয় নয়, ৬৬-৬৭ থেকে সারা দেশে, বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে, বিভিন্ন রকমের বোঝাপড়া হয়েছে, ভেঙেছে, আবার নতুন জোট হয়েছে। এই বিরাট কোয়ালিশন পলিটিক্সে সবথেকে সুবিধেবাদী অবস্থান নিয়েছে সিপিএম, সব সময়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় বড় কথা বলে বা না বলে, দেশের রাজনীতিতে আদর্শগত অবস্থানের কথা বলে বা না বলে এই দল এবং এই দলের নেতারা শুরু থেকেই সবচেয়ে ভুল অবস্থান, বরাবর সবচেয়ে সুবিধেবাদী অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, নিয়েছেন। গান্ধী বলছেন ইংরেজ ভারত ছাড়ো, ওঁদের পূর্বসূরি কমিউনিস্ট পার্টি তখন সোভিয়েত আক্রান্ত, এ যুদ্ধ এখন জনযুদ্ধ ইত্যাদি আবোল তাবোল বকে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চরম পর্যায়ে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখলেন। নৌ বিদ্রোহে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল, একা গান্ধীর জন্য স্বাধীনতা আসেনি, নেতাজীর আইএনএ বা নৌ বিদ্রোহের বিরাট ভূমিকা ছিল। কিন্তু যখন সত্যিই স্বাধীনতা এল, তাকে ওঁরা স্বাধীনতা বলেই মানতে রাজি ছিলেন না। ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত, ভুলো মত। নেহরু এঁদের হিপোক্রাট বলতেন, আম্বেদকর কমিউনিস্টদের দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের বিরোধী বলেই মনে করতেন। তারপরে সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু সংবিধান নিয়ে তাঁদের বক্তব্য এক্কেবারে আলাদা, নতুন সংবিধান লিখতে হবে, এখন বিজেপিও লিখছে। পতাকা? না কমিউনিস্ট পার্টির দফতরে জাতীয় পতাকা, ১৫ অগাস্ট, ২৬ জানুয়ারি এসব ছিল না, নভেম্বর বিপ্লব ইত্যাদি ছিল। লাল কিলে পর লাল নিশান, মাঙ্গ রহা হ্যায় হিন্দুস্থান। দেশের জাতীয় পতাকা নয়, লাল পতাকা চাই লালকেল্লায়, ৮০-র দশকেও এ স্লোগান জারি ছিল। এরমধ্যে দল ভাগ হয়েছে, ক’ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত আকচা আকচির পরেও যে মুহূর্তে সেই দক্ষিণপন্থীদের সিপিআইকে সঙ্গে নিলে সরকার গড়া সম্ভব, সিপিএম তাদের জোটে নিয়েছে, কংগ্রেসকে হারাতে হবে বলে।
দেশে জরুরি অবস্থা, জর্জ ফার্নান্ডেজ, মধু লিমায়ে থেকে মোরারজি দেশাই, মোহন ধারিয়া, জগজীবন রাম সবাই জেলে, জ্যোতি বসু জেলের বাইরে। এ বাংলায় এক জ্যোতির্ময় বসু জেলে ছিলেন, সেটাও অন্য রাজনৈতিক অভিযোগে। বাকিদের পেটাচ্ছিল কংগ্রেসি গুন্ডারা, কাজেই গুন্ডাদের ভয়েই পাড়াছাড়া। জয়প্রকাশের আবেদনে পতাকা ফেলে এমনকী জনসঙ্ঘও এল, সিপিএম গেল না, তারা বিপ্লবী পার্টি। না জয়প্রকাশ আন্দোলনে তাঁদের কোনও ভূমিকাই ছিল না। তো ইন্দিরা হারলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই বিখ্যাত জুলাই ক্রাইসিস, মোরারজি সরকার পড়ে যাবে, পড়ে গেলে ফিরবে কংগ্রেস, কোনদিকে ছিলেন কমিউনিস্টরা? সিপিএম? মোরারজি ভাইয়ের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিকক ক’দিনের চরণ সিংয়ের পুতুল সরকারের পরেই ৮০তে ফিরলেন ইন্দিরা। এবার হাত চিহ্ন নিয়ে, ওমনি কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। ওই জুলাইয়ে কমিউনিস্ট পার্টি মোরারজি সরকারকে সমর্থন করলে রাজনারায়ণ, সঞ্জয় গান্ধী ষড়যন্ত্র টিকত না। বেশ, এরপর? ইন্দিরা সরকার, ইন্দিরা হত্যার পরে রাজীব সরকার। বোফর্স ইস্যু এল, ভিপি সিং মধ্যে, একধারে বিজেপি অন্যধারে সিপিএম, একধারে অটল বিহারী, অন্যধারে জ্যোতি বসু। কংগ্রেস হঠাও দেশ বাঁচাও। বিজেপি রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছিল সেদিনেই। রামমন্দির আন্দোলন শুরু হল, ভি পি সিং কমণ্ডল বার করলেন, মণ্ডল কমিশন, কমিউনিস্টরা কোথায়? তারা সেদিন বুঝতেই পারেনি ওই ভি পি সিং কমিউনিস্টদের স্যোশাল এস, দরিদ্র, হরিজন, সিডিউল কাস্ট, পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য আলাদা সামাজিক রাজনৈতিক ইকুয়েশন তৈরি করছেন। হলও তাই, কমিউনিস্টরা বা বলা ভালো সিপিএম ত্রিপুরাতে দশরথ দেব, নৃপেন চক্রবর্তীর জন্য, বাংলায় জ্যোতি বসুর জন্য, কেরলে এক বড় টিম ওয়ার্ক, নাম্বুদ্রিপাদ থেকে ভি এস অচ্যুতানন্দনের মতো নেতারা ছিলেন, এবং কেরলে সিপিএম-এর মৌরসিপাট্টা ছিল না। এইবার আছে তো অন্যবারে নেই, কাজেই ৩৪ বছরের বাপের জমিদারি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বাকি দেশে সাফ। উত্তরপ্রদেশে সরযূ পান্ডে, হাজরা বেগম, রাশিদ জাহান, কুঁওর মহম্মদ আসরফ, লতাফত আলি খান, সুরাজ প্রসাদ, মিত্রসেন যাদভ, কত নেতা ছিলেন, কানপুরেই তো জন্ম, আজ মুছে গিয়েছে। ওই মণ্ডল রাজনীতি না বোঝার জন্য। তাঁরা সঠিক রাজনৈতিক জোটে থাকেননি, খোলা মন নিয়ে থাকেননি। প্রতিটা সময়ে তাঁদের এক কৌশল কাজ করেছে, দিমিত্রভের তত্ত্ব কাজ করেছে, জোট হল এক সাময়িক ব্যাপার, জোটে যাও নিজেদের ক্ষমতা বাড়াও, দেশ নয়, দল বাড়াও। কাজেই দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নে তাঁরা নেই, থাকেননি কোনও দিন।
৭৭-এ ছিলেন সরকারে? না ছিলেন না কারণ ওঁরা বিপ্লবী দল। ভি পি সিংয়ের সরকারে ছিলেন? না ছিলেন না, কারণ ওঁরা বিপ্লবী দল। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে সাধাসাধি করছে বিরোধী দলের নেতারা, ওঁরা গেলেন না, কেন না ওঁরা বিপ্লবী দল। দেবেগৌড়ার সরকারে সিপিআই গেল, সিপিএম গেল না, কারণ ওঁরা বিপ্লবী দল। এমনকী ৫২ সালের নির্বাচনেও যারা দেশের দু’ নম্বর দল, তারা এখন অবলুপ্তির মুখে, সিপিএম-এর তিনজন সাংসদ, দুজন কমরেড স্তালিন নয়, মুথুভেলি করুণানিধি স্তালিনের দয়ায়, স্তালিন হারলেই ওই দুজনেই হারবে। অন্যটা কংগ্রেসের সঙ্গে লড়ে কেরল থেকে পাওয়া। সংসদীয় রাজনীতিতে একটা জায়গাতেও বিজেপির সঙ্গে সিপিএম-এর কোনও লড়াই নেই, ওই ত্রিপুরা ছাড়া, সেখানেও লড়াই কোথায়? বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাঁদের সবথেকে কম স্টেক, তাঁরা মাঝেমধ্যেই বিপ্লবী হওয়ার অভ্যেসটা ছাড়তে পারেন না। মন দিয়ে শুনুন, ফ্যালাসিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিজেপি বিরোধী একটা জোট হবে, অর্থাৎ যে যে রাজনৈতিক দল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের জোট হবে। সিপিএম-এর বক্তব্য কী? তৃণমূল আর বিজেপি তো একই, তারা তো একে অন্যের পরিপূরক, তারা তো আসলে ছায়া ছায়া যুদ্ধ করছে, লোককে বোকা বানাচ্ছে। হতেই পারে, এই সব কথা সত্যি হতেই পারে। তাহলে তেমন এক দল জোটে আসছে, আপনারা সেই জোটের বৈঠকে কিছু বলবেন না? বিরোধী ঐক্য চাই? কাদের সঙ্গে যারা আসলে বিজেপি? আসলে আরএসএস? জোটের মধ্যে এই কথা বলেছে সিপিএম? না, বলেনি। কেন বলেনি? কারণ নাকি তারা বিজেপি বিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠুক সেটা চায়। বিজেপি বিরোধী জাতীয় ঐক্যে একটা দল আছে যা নাকি আরএসএস-এর একটা শাখা, তাদের সঙ্গে জোটে আছে সিপিএম। কেন? কারণ ওই যে, ওঁরা বিপ্লবী। আচ্ছা মমতা নিয়ে ওঁদের এত আপত্তি কেন? কারণ মমতা অটল মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। খেয়াল করুন নীতীশ কুমারও ওই একই মন্ত্রিসভায় ছিলেন, বিজেপির সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন, কিন্তু না ইতিমধ্যেই তাঁর সঙ্গে জোট সরকার কিন্তু চলছে। মমতার দলে দুর্নীতি? মন্ত্রীরা জেলে? লালুপ্রসাদের দলে কী? তেজস্বী যাদবের ক’টা মামলা? কেজরিওয়ালের দলের দু’ নম্বর আজও জেলে, স্তালিনের মন্ত্রিসভার সদস্য জেলে। আসলে ওঁরা কেউই এই সিপিএম-এর ৩৪ বছরের মৌরসিপাট্টা ভাঙেননি, ইনি ভেঙেছেন, তাই এঁর সঙ্গে জোট নয়, তো সেটা সোজাসুজি বললে চুকে যায়। কিন্তু না, ওঁরা বিপ্লবী পার্টি, একটা আদর্শের প্রলেপ দিতেই হবে, দিচ্ছেন। ২৬টা ২৮টা দল মিলে একটা জোট হয়েছে, সরকার নয়, জোট হয়েছে। তার কোঅর্ডিনেশন কমিটিতে ১৪ জনকে রাখা হবে। সিপিএম-এর সীতারাম ইয়েচুরি সেদিনেই জানিয়েছিলেন, ওই নাম পরে দেওয়া হবে। বাকি কমিটিতে নাম আছে, কারা তাঁরা? গুগল করলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অরুণ কুমার আর মিঃ প্রাঞ্জল। কেরল থেকে কেউ আসবে না, তাঁদের জোট নিয়ে কিসসু বলার নেই। আজকের দেশাভিমানী খুলে দেখুন, গতকালের ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক নিয়ে কোনও খবর নেই, ছবিও নেই। তো সেই কোঅর্ডিনেশন কমিটিতে কারও নাম দিল সিপিএম? দেয়নি। দেবে না বলেছে? না তাও বলেনি। কেন? কারণ তাঁরা বিপ্লবী পার্টি।
তারপরে সেই কোঅর্ডিনেশন কমিটির প্রথম বৈঠক হল। সেই দিনেই সেই কমিটির অন্যতম সদস্য, তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডি ডেকে পাঠাল। তিনি সেখানে গেলেন। বৈঠক শুরু হওয়ার আগেই সঞ্জয় রাউত বলেছেন এটা ইডির নয় আসলে মোদি সরকারের নির্দেশে হচ্ছে, হ্যারাস করা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে, আমরা ওঁর জন্য চেয়ার খালি রাখব। বৈঠক শেষ হল। শরদ পাওয়ার, হেমন্ত সোরেন, সঞ্জয় রাউত, রাঘব চাড্ডা, মেহেবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লা সমেত কংগ্রেসের কে সি ভেনুগোপাল মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। প্রেস বিবৃতি দেওয়া হল পড়ে শোনানো হল। Shri Abhishek Banerjee of All India Trinamool Congress could not attend the meeting due to a summon by the Enforcement Directorate, arising out of the vendetta politics of Bharatiya Janata Party. বাংলা মানে হল, তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আজ এই বৈঠকে হাজির থাকতে পারেননি কারণ তাঁকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, এটা ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির অঙ্গ। এটা আছে প্রথম প্যারাগ্রাফে। এরপরে বলা হয়েছে আসন বণ্টনের বিষয়টা তাড়াতাড়িই চূড়ান্ত করার কাজ শুরু হয়েছে, বিভিন্ন দলের নেতারা এ নিয়ে কথা বলা শুরু করবেন এবং সিদ্ধান্তে আসবেন। এই কমিটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনসভার আয়োজন করবে, তার মধ্যে প্রথমটা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ভোপালে হবে। যেখানে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, মোদি সরকারের দুর্নীতি, জাতিগত জণগণনা ইত্যাদি বিষয়গুলো আসবে। শেষে বলা হয়েছে জোটের মিডিয়া কমিটি সেই সব অ্যাঙ্করদের নামের তালিকা ঠিক করবে যাদের সঙ্গে ইন্ডিয়া জোটের কেউ বসবে না। এবার গণশক্তির এই বৈঠক নিয়ে প্রতিবেদনটা পড়লে বোঝা যাবে যে কতটা শঠতা নিয়ে তারা এই জোটে আছেন। বিবৃতিতে পরিষ্কার জানানো হল যে জোট মনে করে, অভিষেক ব্যানার্জিকে আজই ডেকে পাঠানোটা বিজেপির প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি, কিন্তু গণশক্তি সেটা লিখল না। কেন লিখল না? কারণ সেই একই, ওঁরা বিপ্লবী বলে। এবং এই বিবৃতিতে সাফ বলা আছে, আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হবে শিগগির, এবং তা চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু গণশক্তি খুলুন, আলোচনা হবে এবং আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হবে, কথাগুলো লেখার পরেই তাঁরা লিখে দিয়েছেন, “অবশ্য বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গ কেরল সমেত কিছু রাজ্যে সেভাবে আসন সমঝোতা হবে না তা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল।” কথাটার মানে কী? জোটের বৈঠক, যেখানে সিপিআই হাজির, সেই বৈঠকের বিবৃতি জানাচ্ছে আলোচনা হবে, তাড়াতাড়ি হবে, সিপিএম জানাচ্ছে হবে না। কেন? ওই যে, ওঁরা বিপ্লবী।
আগেই বলেছি, রাজনৈতিক ভাবে, প্রশাসনিকভাবে বাকি প্রত্যেক দলের বিজেপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমে লড়াইয়ের জায়গা আছে, তাঁরা লড়ছেন। সিপিএম-এর স্টেক সবচেয়ে কম, আর যেখানে লড়বেন, সেই ত্রিপুরার ফলাফল তাঁরা এবং আমরা আগাম জানি। কাজেই সিপিএম-এই জোটের সবচেয়ে নড়বড়ে খুঁটি। বিপ্লব ওঁরা জীবনেও করবেন না, না ইচ্ছে আছে না এখন সাধ্য আছে। যা আছে তা হল বাংলায় তীব্র মমতা বিরোধিতা, কেরলে তীব্র কংগ্রেস বিরোধিতা। কাজেই এই জোট যতদিন এগোবে ততদিন ধরে এই খুঁটিটা নড়বড় করতেই থাকবে, এবং এখনও এই গোলমেলে অবস্থান না ছাড়লে ২০২৪-এর পরে যার অস্তিত্বই থাকবে না।