আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কিছু মানুষ চাইছেন এই বিচার চলতে থাকুক। চলতে থাকুক অন্তত ২০২৬ পর্যন্ত, রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে আরজি কর ধর্ষণ আর খুন হয়ে উঠুক এক প্রধান ইস্যু। এদের মধ্যে এমন মানুষজনও আছেন যারা আসল দোষী শাস্তি পেল কি না তা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, তাদের একমাত্র লক্ষ্য পলিটিক্যাল মাইলেজ। সেটা আদায় করতে গিয়ে যদি ছাড়াও পেয়ে যায় আসল ধর্ষক বা খুনি, তাতেও এদের কিছু যাবে আসবে না। কাজেই একটা নির্দিষ্ট ইন্টারভ্যালে এক অজানা সূত্রের উল্লেখ করে নিয়ে আসা হচ্ছে নতুন নতুন তথ্য। এবং সঙ্গে আছে সংবাদমাধ্যম, এদের কারও দরকার ৬০০ কোটি টাকার জমি, কারও লক্ষ্য টিআরপি আর কেউ বা প্রভুর নির্দেশে কথা বলা পুতুল, হিজ মাস্টার্স ভয়েজ। আবার নতুন তথ্য এসে হাজির, সিএফএসএল রিপোর্ট নাকি বলছে ওই সেমিনার রুমে ধর্ষণ হয়েছিল তেমন কোনও প্রমাণ নেই। সিবিআই চার্জশিট দিয়েছে তাদের তদন্তের ভিত্তিতে আর সেখানে তারা ৯টা সিএফএসএল রিপোর্টের উল্লেখ করেছে। তার ভিত্তিতে তারা যে চার্জশিট তৈরি করেছে তাতে বলা হচ্ছে, কোন কোন প্রমাণের ভিত্তিতে কলকাতা পুলিশ সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছিল? কোন প্রমাণের ভিত্তিতে সিবিআই এই ঘটনাতে ওই অভিযুক্তকে এই ধর্ষণ আর খুনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে?
১) সঞ্জয় রায়ের সিসিটিভি ফুটেজ যা দেখাচ্ছে সে আরজি কর হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিল্ডিং-এর তিন তলাতে ৮ এবং ৯ অগাস্টে পাওয়া গেছে। ২) মোবাইল ফোনের টাওয়ার জানাচ্ছে যে সঞ্জয় রায় সেদিন রাতে ওই আরজি কর হাসপাতাল চত্বরেই ছিল। ৩) ধর্ষিতা মৃতার দেহে যে অন্য ডিএনএ-র অস্তিত্ব ছিল তা সঞ্জয় রায়ের। ৪) ধর্ষিতা মৃতার রক্তমাখানো সঞ্জয় রায়ের জিনসের প্যান্ট এবং জুতো যা কলকাতা পুলিশ ১২ অগাস্ট ওই ব্যারাক থেকেই উদ্ধার করে। ৫) শর্ট হেয়ার বা পিউবিক হেয়ার যা ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে তা ওই সঞ্জয় রায়ের। ৬) ব্লু টুথ ইয়ারফোন যা নাকি সঞ্জয় রায়ের মোবাইলের সঙ্গে অটোম্যাটিক্যালি পেয়ার হচ্ছিল তা পড়ে ছিল ওই ঘটনাস্থলে। ইতিমধ্যে সব্বাই জেনে গেছেন যে সঞ্জয় রায় যখন কনফারেন্স রুমে ঢুকেছে সিসিটিভিতে তার কাঁধে ওই ব্লু টুথ ছিল, বার হওয়ার সময়ে আর ওটা দেখা যায়নি। ৭) সঞ্জয় রায়ের গ্রেফতারির পরেই যে মেডিক্যাল এফজামিনেশন হয় তাতে তার গায়ে বেশ কিছু আঁচড়ের দাগ পাওয়া গিয়েছিল, যা ২৪–৪৮ ঘণ্টা আগের, অর্থাৎ ওই ঘটনার সময়েই। 8) যে ক্ষতগুলো অভিযুক্তের গায়ে পাওয়া গেছে তা চার্জশিট অনুযায়ী খুব ধারালো কিছুর আঘাত নয়, মনে করা যেতেই পারে যে এই আঘাত ওই মেয়েটি নিজেকে বাঁচানোর জন্য করেছিল। ৯) মেডিক্যাল টেস্ট বলছে সঞ্জয় রায় যৌনতা সম্পর্কিত কাজে সম্পূর্ণ সক্ষম। ১০) সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি অফ কলকাতা মৃতার অন্তর্বাসে যে ছেঁড়া অবস্থা পেয়েছে তা ধর্ষণের সময় শারীরিক বলপ্রয়োগের সময়ে হয়ে থাকতে পারে। ১১) ওই সিএফএসএল জানাচ্ছে যে মৃতার ছেঁড়া কুর্তিও একই রকমের বলপ্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়। কারা এনেছে ওই প্রমাণ? এই ১১টা প্রমাণের ভিত্তিতে সিবিআই তার চার্জশিটে ১৬.২৮ পরিচ্ছদে লিখছেন যে that During investigation conducted so far, involvement of accused Sanjay Roy has been clearly established in the commission of offences punishable u/s 64, 66, 103(1) of BNs 2023. ওই যে ১১টা বিষয় তার প্রত্যেকটাই সিএফএসএল কলকাতা, দিল্লি, চণ্ডীগড়, থেকে আনানো। যেখানে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের শরীরে যে ক্ষতচিহ্নগুলো দেখা গেছে তার ডিএনএ ম্যাচ করানো হয়েছে, মৃতার শরীর বা জামাকাপড় থেকে রক্ত, দেহরস বা শর্ট হেয়ার ইত্যাদির ডিএনএ টেস্ট পাওয়া গেছে, এবং এই টিম ১৪ অগাস্ট কলকাতা এসেছিল, তাদের রিপোর্ট আজ নয় বহু আগেই জমা পড়েছে। সেই রিপোর্ট এবং অন্য রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিবিআই চার্জশিট দিয়েছে, হঠাৎ সোমা বলছির দল এসে হাজির। আবার একটা সিএফএসএল রিপোর্ট? কবে এল ভাই? ১৪ অগাস্ট যে ময়নাতদন্তে এসেছিল এই টিম তারা চার্জশিট দেওয়ার পরে তাদের রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন? বহু আগে সম্ভবত রাজীব গান্ধীর সেই বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে এক পথনাটিকাতে উৎপল দত্ত নিজেই অভিনয় করতেন, সেখানে তাঁর একটা ডায়ালগ ছিল, প্রমাণের প্রমাণ চাই।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপি জমানায় ভারতবর্ষে আমিষ খাওয়া মানা?
এখন দেখে শুনে মনে হচ্ছে এই ডাক্তারবাবুরা, পেটোয়া মিডিয়ার লোকজন সিবিআই তদন্তের সিবিআই তদন্ত চেয়ে বসবেন। তো হোক সেই তদন্ত। এবং খুব স্বাভাবিক যে সেই তদন্ত যদি চালু হয়, তাহলে এই বিচারকে বন্ধ রাখতে হবে, সেটাও খোলসা করে বলে ফেলুন, যে আপাতত বিচার স্থগিত থাক, সিবিআই-এর যে তদন্ত তা কম্প্রোমাইজড, তাকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না অতএব সেই তদন্তের বিরুদ্ধে হে মহামান্য আদালত, আপনারা আর একটা সিবিআই তদন্তের আদেশ দিন কারণ আর যাই হোক আমাদের দেশ তো সার্বভৌম দেশ, এখানে তদন্তের জন্য তো এফবিআই-কে ডাকা যায় না। এদিকে এই ধরনের অপরাধের তদন্তের জন্য মাত্র দুটো এজেন্সিই আছে আমাদের দেশে। কলকাতা পুলিশের উপরে ধর্ষিতা মৃতার বাবা-মায়ের ভরসা নেই, সেই জন্যই তদন্ত সিবিআই-কে দেওয়া হয়েছে। এবারে সেই সিবিআইও নাকি তদন্ত করছে না, আর সেটা জানানোর জন্য এক সিএফএসএল রিপোর্টের কথা বলা হচ্ছে যা ওই ন’টা রিপোর্টের বাইরে হতেই পারে না। আবার বলছি আরজি কর আন্দোলনের সময়ে যা হয়েছে তা অভূতপূর্ব। এত মিথ্যে আর এতদিক থেকে তা ছড়ানো হয়েছে যে একটা সময়ে মনে হচ্ছিল এই মিথ্যের বন্যায় মানুষ ভেসে যাবেন। কিন্তু ওই যে আমাদের ঠাকুর বলেছেন, মানুষের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ। আমরা দেখলাম মিথ্যের জাল ছিঁড়েছেন মানুষ নিজেই। আর ক্রমশ পিছু হটা সেই ভুয়ো আন্দোলনজীবীর দল এখন যত মাটি কামড়ে পড়ে থাকার চেষ্টা করছে, ততই তাদের মাংস ছাল চামড়া খসে পড়ে কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে আসছে।
এই আন্দোলনের শুরু থেকেই কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ জড়িয়েছিল, যাদের আমরা বলি স্টেক হোল্ডার, যাদের স্বাস্থব্যবস্থার থেকে টাকা আসে, সেটা কোনও এক ডাক্তারের বড় কর্পোরেট হাসপাতালের অংশীদারিত্ব হোক, কোনও এক বিপ্লবী গার্ডেনরিচের সর্বহারা নেতার ডায়গনাস্টিক সেন্টারই হোক বা আরজি করেই এর আগে লুঠপাট করে খাওয়া কোনও এক মহান সাজা ডাক্তার যিনি বখরার হিসেবে বাদ পড়েছিলেন, সেইসব স্টেক হোল্ডারেরা ক’দিনের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলেন এই সুযোগ এসেছে, গোটা হিসেবটাকে পালটে দিয়ে তাঁরাই হয়ে উঠবেন একচ্ছত্র অধিপতি। আসলে এটা সেই স্টেক হোল্ডারদের বখরার লড়াই ছিল। এঁরা ছিলেন মাথায়। মানে নীতি-নির্ধারক কমিটিও বলতে পারেন, এঁদের অনেকেই সামনেও আসেননি। অপেক্ষা করছিলেন সম্পূর্ণ জয়ের। এরপরে ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন, যাঁরা এক থ্রেট কালচারের পালটা গড়ে ওঠা আরেক থ্রেট কালচারকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের নতুন থ্রেট কালচার রেজিম তৈরি করার চ্রেষ্টায় নেমেছিলেন, তাঁরাও ওই শুরুয়াতি দিনগুলোতেই বুঝে ফেলেছিলেন যে নতুন গড়ে ওঠা রেজিমকে ভেঙে তাঁদের সিন্ডিকেটের হাতে চলে আসবে সব ক্ষমতা। তাঁরা সেই লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামলেন। মাথায় ঘাঘু লোকজন তো ছিলই আর তার সঙ্গে এসে গেল হঠাৎ তৈরি হওয়া আবেগে উত্তাল বহু মানুষকে, তাঁরা সাধারণ মানুষজন, তাঁদের এক অংশ বামপন্থী, এক অংশ গণতান্ত্রিক উদার, আর এক বড় অংশ কিছুই নয় ভালো মানুষ, এই ঘটনায় বিচলিত। কিছু মানুষ তাঁদের কন্যা, তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে চিন্তিত, তাঁরাও এলেন। ৯ তারিখের ঘটনার পরে ১৪ তারিখে হঠাৎ করেই মানুষের ঢল নামল রাত দখলে। সেই রাতেই আরজি করের সামনে সাকসেসফুল অপারেশন, ব্যারিকেড ভেঙে নাকি প্রমাণ লোপাট করা হচ্ছে। ৯ তারিখ থেকে সেগুলো তো আরজি করের সামনে ফেলে রাখা ছিল, তাই তৃণমূলিরা ব্যারিকেড ভেঙে প্রমাণ লোপাটে নামল, হ্যাঁ এটাই বলা হল, আবেগতাড়িত ১৪ রাত দখলে যাঁরা নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই সেটা বিশ্বাসও করলেন। হ্যাঁ ওটাই ছিল পিক পয়েন্ট। এবার সেই পিক পয়েন্টকে আরও উচ্চতা দেওয়ার জন্যই মিথ্যের পর মিথ্যে মিথ্যের পর মিথ্যে বলা হতে লাগল।
আর ওই ১৪ তারিখ থেকে এই আবেগের আগুনে রুটি সেঁকে নিতে আর এক দলও মাঠে হাজির হলেন তাঁরা হলেন সেলিব্রিটি, এঁরা হলেন অতৃপ্ত আত্মা, এঁদের আরও কিছু পাওয়ার আছে, এঁরা কেউ নৃত্য, কেউ শিল্প আকাদেমির চেয়ার পাননি, কেউ বঙ্গ বিভূষণ পাননি, কেউ বঙ্গভূষণ পেলেও বিধানসভা পাননি, সেই তাঁরাও মাঠে নামলেন। তবে এই অংশের কাছ থেকে খুব একটা ধারাবাহিকতা আশা করা যায় না, কাজেই ওনারা যেই দেখেছেন ভিড় পাতলা ওমনি নিজের কাজে মন দিয়েছেন। পাত পেড়ে যে ডিরেক্টর সাহেব রাস্তায় এসে বসেছিলেন পরিবার সমেত তিনি আর চৌহদ্দিতেও নেই, এখন তাঁকে ডাকলে আর পাওয়া যাবে না, কারণ পাবলিকই নেই তো উনি এসে কী করবেন, তো এনারাও ছিলেন। এবার সেই লোক জড়ো করার জন্যে আবার নতুন মিথ্যের ডুগডুগি বাজানো হচ্ছে, আবার এক নতুন তথ্য এনে হাজির করার চেষ্টা হচ্ছে যা নতুনও নয়, তথ্যও নয়। আসলে নতুন সিএফএসএল রিপোর্টের নামে এই বিচারকে আরও দীর্ঘায়িত করা আর এই আন্দোলনকে ২০২৬ পর্যন্ত জিইয়ে রাখার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।