সংসদে বসে যা খুশি বলার অধিকার সাংসদদের আছে, মানে আইন বলছে সংসদে মিথ্যে কথা বলার জন্য কোনও সাংসদকে শাস্তি দেওয়া যায় না। অ্যাটলিস্ট এখনও পর্যন্ত সংসদে দাঁড়িয়ে বহু নেতাই যে হুদো হুদো মিথ্যে বলেছেন, তার জনও আজ পর্যন্ত কোনও শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কাজেই ওই প্রথম ভাগ, প্রথম পাঠের শিক্ষা কদাপি মিথ্যা বলিও না ইত্যাদি কিন্তু সংসদ ভবনের মধ্যে খাটে না। সেখানে যার যত ইচ্ছে মিথ্যে কথা বলাই যায়। যেমন আমাদের নির্মলা সীতারামন বলে দিলেন, অনায়াসে এক নিঃশ্বাসে বলে দিলেন বাংলাতে কিছুই হয়নি, সবটাই চুরি ঘোটালা, কোনও উন্নয়ন বিকাশ মানুষের জন্য কাজ ইত্যাদি কিছুই হয়নি। হ্যাঁ, এই কথাগুলোই আমরা শান্তিকুঞ্জের খোকাবাবুর মুখে শুনি, এই কথাগুলোই বলেন সুকান্ত মজুমদার বা দিলু ঘোষ। এবং আরও আমোদ পাবেন এটা শুনে যে হুবহু এই একই কথাই বলেন আমাদের কমরেড সেলিম-সুজন। তো আসুন আজ নির্মলা মাসি যা যা বলেছেন তা নিয়ে, বা আরও ভালো করে বলা যাক, যা যা বলা হয় বাংলার অর্থনীতি নিয়ে সেগুলোর দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নানান কাজকর্ম চলছে, কেউ এই জায়গাতে এগিয়ে তো কেউ ওই জায়গাতে, কারও পিছনে টাকা ঢালতে বাধ্য মোদি সরকার না হলে সরকারই পড়ে যাবে, কারও টাকাই জুটছে না তবুও ঐতিহাসিকভাবে এক এক রাজ্যের এক এক বৈশিষ্ট্য আছে, সে রাজ্যের সরকার তাদের নিজেদের মতো করে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে জমানা গেছে যখন পিঠে কুলো আর চোখে তুলো দিয়ে কেটে যেত এইসব রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সমেত সরকারি ক্ষমতায় থাকা নেতামন্ত্রীদের, এখন কাজ না করলেই সুতো কেটে যাবে, কাজেই সব রাজ্যই কোনও না কোনও ভাবে তাদের রাজ্যের উন্নয়ন আর বিকাশের কাজ করে চলেছে।
কিন্তু, একটা রাজ্যও এমন দেখাতে পারবেন যা এক নির্দিষ্ট থিম ধরে তার উন্নয়নের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? এই শিল্প, সেই শিল্প, এখানে রাস্তা, সেখানে রেল, কিন্তু দেশের কোনও রাজ্যে একটা থিমকে নিয়ে এগিয়ে চলার কোনও চেষ্টা চোখে পড়েছে? হ্যাঁ বাংলাতে সেটা হচ্ছে। তাকিয়ে দেখুন সরকারের যাবতীয় কাজ কোথাও না কোথাও মহিলাদের ঘিরেই হচ্ছে, মহিলাদের ক্ষমতায়ন না হলে সমাজ এগোবে না, মহিলাদের এগিয়ে দিতে না পারলে অর্থনীতিও এগোবে না, পশ্চিমবাংলায় কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডার সেই অর্ধেক আকাশের জয়গান। স্বাস্থ্য সাথীর কার্ড? সেটাও বাড়ির সর্বজ্যেষ্ঠ মহিলার নামে। নারীর এই ক্ষমতায়নে আরও বেড়েছে পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভাতে মহিলাদের বিরাট অংশগ্রহণে। দেশের আর একটা রাজ্যও এভাবে কাজ করা তো বাদই দিন ভেবেও উঠতে পেরেছে মাননীয় জেএনইউ পাস মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন? কোনও একটা রাজ্যে মহিলাদের এই গুরুত্ব, এই প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে? সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করে ফ্রিজারে পুরে দেওয়া হয়েছে, কবে তা লাগু হবে কেউ জানে না। কিন্তু হাজার একটা অভিযোগ আপনি করতেই পারেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে, সেই সরকার যে ভাবে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নকে সামনে এনেছে তা দেশের সরকার, অন্য কোনও রাজ্যের সরকার ভেবেও উঠতে পারেনি। কাজেই নির্মলা তাইজি, কথা বলার আগে দু’বার ভাবুন।
আসুন একটু শিক্ষার দিকে চোখ মেলা যাক যেখানে ভারি গোলযোগ চলছে। বলা হচ্ছে বাংলার স্কুল ড্রপ আউট পার্সেন্টেজ বিরাট, সংসদে, রাস্তায়, সন্ধ্যেতে কলতলার ঝগড়াতে ওই একই কথা আমরা শুনি। তো তথ্য কী বলছে? এই রাজ্যে প্রাইমারি স্কুলে ছাত্রদের ড্রপ আউট ২.৫%, বাকিরা কোথায়? কেরালা ০.৫, তামিলনাড়ু, ১.২। মহারাষ্ট্র ১.৮। কর্নাটক ১.৫, গুজরাট ২, উত্তরপ্রদেশ ৩.২ আর বিহারে ৪ % ছাত্র ছাত্রী স্কুলে আসছে না। উত্তরপ্রদেশ আর বিহারের সঙ্গে তুলনা করাই উচিত নয়। কিন্তু সত্যিই তো এই হিসেব দেখলে মনে হবে যে বাংলাতে তাহলে শিক্ষা সত্যিই পিছিয়ে পড়ছে। এবারে দ্বিতীয় তথ্যটা দেখুন, ২০১১ থেকে এই ড্রপ আউটের ডেটা কী বলছে? ২০১১–১২তে যখন তৃণমূল ক্ষমতায় এল তখন ড্রপ আউট ৬.৩, ১২ -১৩ তে ৫.৮, ১৩–১৪তে ৪.৫, ১৪–১৫তে ৩.৪, ১৫–১৬তে ৩.১, ১৬–১৭তে ২.৯, ১৭–১৮তে ২.৭, ১৮–১৯-এ ২.৫, ১৯–২০ তে ২.৩, ২০২১-এ ২.১ এসে ঠেকেছিল, করোনার সময়ে আবার তা বেড়েছে, সেটা একা বাংলার নয়, সর্বত্র বেড়েছে। কিন্তু প্রবণতা কমার দিকে, হ্যাঁ এইভাবেই ডেটা অ্যানালিসিস করতে হয় নির্মলা মাসি, কেবল আজকের একটা তথ্য দিয়ে পুরো সত্যটা বোঝা যায় না। প্রবণতা বলছে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা এত কিছুর পরেও ভালোর দিকে যাচ্ছে। আসুন আরও কিছু তথ্য দেখা যাক।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরুন: মমতা
Sector West Bengal Maharashtra Tamil Nadu Gujarat Karnataka Uttar Pradesh
Agriculture & Allied 22% 12% 12% 15% 11% 23%
Industry 28% 30% 32% 45% 27% 24%
Services 50% 58% 56% 40% 62% 53%
তথ্য বলছে কৃষিতে আমাদের বাংলার রাজ্যের আয় এলাকা, মানে জমির দিক থেকে হিসেব করলে সবথেকে বেশি, উত্তরপ্রদেশের ওই বিশাল ভূমিতে তাদের মোট আয়ের ২৩% আসে কৃষি থেকে আমাদের রাজ্যের পাহাড়, শুকনো এলাকা, বাদা বন বাদ দিলেও যা থাকে সেখান থেকে এখন ২২% আয় আসে, মহারাষ্ট্রের তা মাত্র ১২%, গুজরাটের ১৫%, কর্নাটকের ১১%। হ্যাঁ আমরা কৃষিতে এক নম্বর। আমাদের ছোট জোত, ছোট কৃষক বলে সেই আয় আরও বিস্তৃত, তা কুক্ষিগত নয়। যা গোটা রাজ্যের মানুষের খাবারের জোগান দিতে সমর্থ, একেই ফুড সিকিউরিটি বলে নির্মলা তাই। আসুন এবারে স্বাস্থ্য নিয়ে আপনি যা বলেছেন তা যে ১০০% মিথ্যে সেটা বুঝে নেওয়া যাক, আপনাদের তথ্য বলছে, মানে ইউনিয়ন সরকারের তথ্য বলছে শিশু জন্মানোর পরে জীবিত থাকার হার এই বাংলায় ৭১.৬, গুজরাটে ৬৯.৭, উত্তরপ্রদেশে ৬৫.৪, বিহারের সংখ্যা বলে মন খারাপ করতে চাই না। প্রতি হাজার জনে এই বাংলাতে ২২ জন শিশু জন্মের সময়েই মারা যায়, গুজরাটে ২৮ জন, কর্নাটকে ২৩ জন, উত্তরপ্রদেশে ৩৮ জন। ২০১১তে এই বাংলাতে সরকারি এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছিল ৮টা, এখন তা ৩৮টা, মানে ১৪ বছরে ৩০টা মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে। হ্যাঁ ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট টাকা দেয় না, আটকে রাখে, ঝোলায়, তারপরেও এটা হয়েছে। আসুন লিটারেসি রেটেও, স্বাক্ষতার হার, বাংলায় ৮০.৫% ছেলেদের ৮৩.৬% মহিলাদের ৭৭.৩%। গুজরাট ৭৯.৩%, ছেলেদের ৮৭.২%, মহিলাদের ৭০.৭%। কর্নাটক ৭৬%, পুরুষদের ৮২.৫%, মহিলাদের ৬৮.১%।
আর আপনাদের আরেক হিন্দুত্ববাদী পোস্টার বয় যোগিজির উত্তরপ্রদেশে? ৬৯.৭%, পুরুষদের ৭৯.২%, মহিলাদের ৫৯.২%। এরপরে কোন মুখে সংসদে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলেন? এমএসএমই নিয়ে এত কথা বলেন, সেখানে বাংলার হাল কেমন? বাংলাতে এই মুহূর্তে ৪০ লক্ষ এমএসএমই ইউনিট আছে, গুজরাটে ৩৭ লক্ষ, কর্নাটকে ৩১ লক্ষ এমএসএমই ইউনিট আছে। মানে ছোট ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের একটা গ্রোথ বাংলাতে এসেছে, আগে আগে দেখনা হ্যায় হোতা হ্যায় কেয়া। রাজ্যের মোট আয়ে এই শিল্প থেকে আসছে কত? তারও হিসেব আছে নির্মলা তাই, শুনলে চোখ মাথায় উঠবে। এ তথ্যও আপনাদেরই দেওয়া। এই বাংলার শিল্প থেকে আয় ২৮%, মূলত টেক্সটাইল, জুট, কেমিক্যাল, আইটি, পেট্রোকেমিক্যাল থেকে আসছে। কর্নাটকের ২৭% আর উত্তরপ্রদেশের এত উজাড় করে ডাবল ইঞ্জিন চালানোর পরে আসছে ২৪%, ওই কৃষিজাত পণ্য, টেক্সটাইল, চামড়া, ইলেক্ট্রনিকস থেকে। আপনার সাতসকালে উঠে মনে হল বাংলা পিছোচ্ছে, অন্য কারও রাত ৮টা হলেই মনে হয় বাংলা কতটা পিছোচ্ছে তা দেশকে জানাই, সেসব চালিয়ে যান। বাংলা এগোচ্ছে, বাংলার নিজের মতো করেই। হ্যাঁ আমাদের কোর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে না, সত্যি। কিন্তু তার থেকেও বেশি জরুরি আমাদের রাজ্যে খিদে নিয়ে মানুষ ঘুমোতে যাচ্ছে না, আমাদের রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ পেটানো হয় না। আর মাঝেমধ্যেই যে ঋণ ঋণ নিয়ে যে চিল চিৎকার করেন সেটা বন্ধ করুন না হলে অর্থনীতির কিছুটা পাঠ আপনার কাছের মানুষের কাছ থেকে নিয়ে আসুন।
যে কোনও উন্নয়নশীল দেশে, বিকাশ উন্নয়নের জন্য ঋণ লাগবেই, তাকিয়ে দেখুন বিশাল বিশাল ব্যবসায়ী হাউসগুলোর দিকে, তাদের ঋণের পরিমাণ দেখুন, সমস্যা ঋণ নয়, সমস্যা হল যদি আপনার সেই ঋণ চোকানোর মতো সম্পদ উৎপাদন না হয়। তো সেটা বোঝার জন্যে একটা হিসেব আছে, সেটা হল ডেট টু জিএসডিপি রেশিও। মানে ঋণ আর মোট সম্পদের অনুপাত। তো সেখানে আমরা কোথায়? পঞ্জাবে সেটা ১৫-র উপরে, তামিলনাড়ু ১১.৫, তেলঙ্গানা ১২.৫%, বিহার ১১.৬%, উত্তর প্রদেশ ১% আর বাংলা মাইনাস ১%। এসব একটু জেনে নিন, কেবল মধুবনী প্রিন্টিংয়ের শাড়ি পরে হালুয়া বিতরণ করলেই হবে? একটা রাজ্য যাদের বকেয়া টাকা দেওয়া হচ্ছে না, যাদের প্রাপ্য টাকা আটকে রাখা হয়েছে বিভিন্ন খাতে, যাদের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজ তো ছেড়েই দিলাম দুর্যোগ সামলানোর টাকাও দেওয়া হচ্ছে না সেই রাজ্য আপনাদের চরম বিমাতৃসুলভ আচরণের পরেও এগোচ্ছে, এক মহিলার নেতৃত্ব রাজ্যের মহিলাদের এই বিশাল ক্ষমতায়ন আগামী দিনে আরও বড় ইতিহাস তৈরি করবে, তখন এই সংসদে দাঁড়িয়েই এই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথাগুলো বলার জন্য আপনাকে লজ্জা পেতে হবে, নির্মলা তাই, বলে রাখলাম, মিলিয়ে নেবেন।