Tuesday, June 24, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: মদ আর মাংস নিষেধ

চতুর্থ স্তম্ভ: মদ আর মাংস নিষেধ

Follow Us :

বাঙালি মাছে ভাতে মানুষ, সে তো আজ থেকে নয়। সবচেয়ে কম আমিষ যেদিন হল, সেদিনও পাতে থাকে কিছুটা চুনো মাছ ভাজা, নিদেন পক্ষে চুনো মাছের টক, এদিক সেদিক তো ছেড়েই দিন, ময়ূরেশ্বরে লকেট চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে দেখেছি, বিজেপি ক্যাডারেরা ভাত, ডাল, পোস্তোর পরে শেষ পাতে চুনো মাছের টকের ব্যবস্থা রেখেছেন। দেশের আমিষ চাহিদা অবশ্য কেবল এই বাংলায় নয়, দেশের ৭৮% মানুষ আমিষভোজী, নিরামিষভোজীদের মধ্যেও এমন মানুষজন আছেন যারা অবলীলাক্রমে ডিম খান, সে হিসেব ধরলে আমিষভোজীর সংখ্যা ৮৫% এ পৌঁছে যাবে। আর এই নিরামিষ খাবার খাওয়া কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই খুব নতুন, হোমোস্যাপিয়েন্সরা ওমনিভোরাস ছিল, তারা আমিষ নিরামিষের ফারাকও তেমন করতো না, শিকার জুটলে আমিষ, না জুটলে গাছের ফল পাকুড়। এর বহু পরে সনাতন ধর্মের কয়েকটা শাখা, মাছ মাংস থেকে সরে যেতে থাকে, বিশেষত উচ্চবর্ণের মানুষ। পরবর্তীতে তাঁদের সঙ্গে বৈষ্ণবরা জুড়ে যায়, আরও কিছু ধর্ম নিরামিষ খাওয়াকে ধর্মের অঙ্গ করে তোলে, মানে সভ্যতার শুরুর বহু বহু পরে ধর্মের আওতায় মানুষ আমিষ না খেয়ে, নিরামিষ খাবার খেতে শুরু করে। কিন্তু আমাদের দেবতারা?

ধরুণ সীতা, রামকে বললেন আমার সোনার হরিণ চাই, রামতো দড়ি, ফাঁস নিয়ে বের হলেন না, হাতে নিলেন তীর ধনুক। তীর ধনুক দিয়ে সেই উজ্জ্বলকান্তি হরিণ মেরে নিয়ে আসবেন, সেও তো এমনি এমনি নয়, তা খাওয়া হবে। কেবল কি মাংসই খাওয়া হবে, সুপক্ক মাংসের সঙ্গে চাই মদিরা, তাও থাকবে। রান্না করে, দেওর আর বরকে নিয়ে বসে, সেই মদিরা এবং হরিণের মাংস খাবেন জনক নন্দিনী। তারও আগে রাজা জনকের প্রাসাদে এমন এলাহি খাবারের বর্ণনা আছে, সীতার সঙ্গে রামের, লক্ষ্মণের সঙ্গে উর্মিলার বিয়ে হয়ে গেছে, পরদিন বর বধূরা অযোধ্যার দিকে যাবেন, ওদিকে পরশুরাম খবর পেয়েছেন, হরধনু ভেঙেছেন রাম, ক্রুদ্ধ তিনি আসছেন জনকের রাজসভায়, খবর পেয়েই রাজা জনক বলছেন, তাড়াতাড়ি নধর দেখে একটি বাছুর আন, তাকে সুসিদ্ধ কর, তরিবত করে রান্না কর, সঙ্গে সোমরসের আয়োজন থাক। কেন? পরশুরাম আসছেন, তাঁকে ওয়েলকাম জানাতে হবে না? রাজা জনকের জানা ছিল, পরশুরাম সুপক্ক গোবৎস আর মদিরা পছন্দ করেন। স্বর্গে ইন্দ্রের রাজসভায় মদিরা বাদ দিয়ে অন্য কিছু ভাবা যায় নাকি? সে সব অপ্সরারা নৃত্য করবে, সোমরস থাকবে, আনন্দ হবে, আনন্দম কেবলম। এখানে বলে রাখি যাঁর নামে সোমরস, সেই সোম কিন্তু এক বিশিষ্ট ঋষি, সম্ভবত সোমরস তৈরির রেসিপি আর পেটেন্ট ওনারই ছিল, যেমন জন ওয়াকারের নামে জনি ওয়াকার, তেমনিই সোম ঋষির নামে সোমরস। এ ছাড়াও সমুদ্র মন্থনের সময় বারুণি নামে এক মদের কথাও পাওয়া যায়, তা নাকি ছিল উৎকৃষ্ট দ্রাক্ষারস দিয়ে তৈরি। যজ্ঞের সময় ছাগ, গো বৎস ইত্যাদি আহুতির কথাও পাওয়া যায়, সোমরস ছাড়া তো যজ্ঞই হত না। ওদিকে অনার্য, অব্রাহ্মণ, দেশজ মানুষজনেদের দেবতাদের তুষ্ট করতে বলি প্রথা ছিল আরও প্রাচীন, হাঁস, মুরগি, পাঁঠা বলি তো ছিলই। এই সব ধর্মাচরণই বুঝিয়ে দেয়, মানুষ কী খেতে ভালবাসত, কী খেত। বহু পরে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণা অ্যানিম্যাল প্রোটিন, পশুজাত প্রোটিনের গুরুত্বের কথা বুঝেছে, তা সহজলভ্য, সহজপাচ্যও বটে।

গড়ের মাঠে ফুটবলাররা চৌরঙ্গী মোড়ে হালিম খেতেন কি সাধে? বিবেকানন্দ ছিলেন স্ট্রিক্টলি ননভেজ যাকে বলা হয়, তাই। অন্তত একবেলা মাছ ভাত, মাংস ভাত ছিল তাঁর অভ্যাস। না পেলে বিরক্ত হতেন। তাঁর মাদ্রাজ ভ্রমণের কথা থেকে জানা যায়, তিনি নিজেই চিঠি লিখে জানাচ্ছেন যে, দিন তিনেক নিরামিষ খাবার পরে তিনি বিরক্ত হয়ে এক বাঙালির বাড়িতে গিয়ে ওঠেন, জানিয়ে দেন, ওসব ঘাস পাতা খেতে তিনি নারাজ। মারা যাবার দিনেও আনিয়েছিলেন ইলিশ মাছ, নিজে রান্না করে খেয়েছিলেন, খাইয়েওছিলেন। ওই যে হিমালয় পাহাড় দেখছ, ওরই উত্তরে কৈলাশ। সেথা বুড়ো শিবের প্রধান আড্ডা, ওই বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন, এ দেশে চিরকাল। যদি পছন্দ না হয় সরে পড় না কেন? তোমাদের দু চার জনের জন্য দেশশুদ্ধ লোককে হাড় জ্বালাতন হতে হবে বুঝি? চরে খাওগে না কেন? কে বলছেন? স্বামী বিবেকানন্দ। যাঁর গুরু রামকৃষ্ণ মৌলবীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন, মুসলমান ধর্ম সাধনাও করেছিলেন, সেই বিবেকানন্দ, যিনি বলেছিলেন গর্বের সঙ্গে বল, আমি হিন্দু। তিনিই বলেছিলেন, দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই। তিনিই আবার চিঠি লিখছেন, মহম্মদ সরফরাজ হোসেনকে, ‘‘আমার অভিজ্ঞতা এই যে, কখনও যদি কোনো ধর্মের লোক দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে এই সাম্যের কাছাকাছি আসিয়া থাকে, তবে একমাত্র ইসলাম ধর্মের লোকেরাই আসিয়াছে; এইরূপ আচরণের যে গভীর অর্থ এবং ইহার ভিত্তি স্বরূপ যে সকল তত্ত্ব বিদ্যমান, সে সম্বন্ধে হিন্দুগণের ধারণা পরিষ্কার। আর ইসলাম-পন্থিগণ সে বিষয়ে সাধারণত সচেতন নয়। এইজন্য আমার দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম ধর্মের সহায়তা ব্যতীত, তাহা মানব সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানবজাতিকে সেইস্থানে লইয়া যাইতে চাই, যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরাণও নাই। অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরাণের সমন্বয়ের দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। আমাদের, নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ, এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই, বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ, একমাত্র আশা। আমি মানস চক্ষে দেখিতেছি এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া, মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে, জাগিয়া উঠিতেছে।’’

কোথাও তাঁকে গোঁড়া হিন্দু মনে হবে, পরক্ষণেই তিনি আদন্ত্য সেকুলার এবং আধুনিক। এদিকে তিনিই আবার বিজেপি আরএসএস নেতাদের পরম পূজনীয়, আরএসএস নেতা, মোদি, শাহ, যোগী মাছ মাংস মুখে দেবার কথা চিন্তাতেও আনেন না, আর বিবেকানন্দ মাছ মাংস ছাড়া খাবার কথা ভাবতেও পারতেন না। তাঁদের যুগাবতার রাম সীতা, আগেই বলেছি, কেবল মাংস নয়, সুপক্ক হরিণ বা কুক্কুটের মাংসের সঙ্গে ভাল মদিরা দিয়েই লাঞ্চ ডিনার সারতেন। আমি নই, রামায়ণেই সে কথা লেখা আছে।

এবার আসুন কৃষ্ণের কথায়। কৃষ্ণকে বলরামের থেকে আলাদা করা যায় না, বলরাম আবার খেতে ভালবাসতেন, প্যাস্টোরাল যুগের চরিত্র এরা, যখন পশুপালন শুরু হয়ে গেছে। অতএব সম্ভবত গোমাংস এনাদের রুচত না বটে, কিন্তু মাংস? নিশ্চিত। বহু যজ্ঞের প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষ্ণ, ব্রহ্মার নির্দেশে যজ্ঞের হবি, মানে যজ্ঞে যা যা দেওয়া হল, সেটাই খাদ্য হবে দেবতাদের এবং উপস্থিত প্রধান পুরুষদের। এদিকে কেবল যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের বর্ণনাতেই দেখা যাচ্ছে শয়ে শয়ে যজ্ঞ উপযুক্ত পশুর হাজিরা, তারা কার খাদ্য হলেন? আর সুরা? সে তো বলরামের কথায় পরিস্কার, তিনি এলেন এবং জানালেন ভাই শ্রীকৃষ্ণ থাক পান্ডবদের সঙ্গে, উনি চললেন দুর্যোধনের কাছে, কারণ দুর্যোধনের মদিরার স্টক নাকি অনেক ভাল। কৃষ্ণের মদিরাপানের কথা আমরা নারদের মুখ থেকেই শুনেছি, কেবল তিনি একলা নন, শত গোপিনীদের হাতেও থাকত মদিরা পাত্র, তাঁরা সেই মদিরা পান করাতেন শ্রী কৃষ্ণকে। রামায়ণ, মহাভারত উপাখ্যান, কল্পকাহিনী, কিন্তু তা সমাজের প্রতিচ্ছবিও বটে।

আজ হঠাৎ এই মদিরা আর মাংসের গল্প কেন? এবার সেটাও বলে ফেলি। মাত্র গত রবিবার, কনফট যোগী আদিত্যনাথ গিয়েছিলেন মথুরা, জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সেখানে গিয়েই জানালেন এখন থেকে মথুরায় মদ এবং মাংস, দুটোই নিষিদ্ধ। ভগবান কৃষ্ণের জন্মভূমীতে মদ আর মাংস চলবে না। যাঁরা মদ বা মাংস বিক্রি করতেন, তাঁরা এখন থেকে দুধ বিক্রি করুন। বলাই বাহুল্য যে মথুরাতে আর কোনও আমিষ ভোজনালয় থাকবে না। যাঁরা আমিষ খেতেন তাঁদের কথা বাদই দিন, যাঁরা মাছ মাংস বিক্রি করতেন, সর্বস্য পুঁজি দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে একটা মদের দোকান খুলেছিলেন, তাঁদের কপাল পুড়ল, সেই জন্মাষ্টমীতেই, সেই মথুরাতেই যেখানে কৃষ্ণ বা বলরাম, কারোরই অরুচি ছিল না মদ বা মাংসে।

আপ রুচি খানা, একথা ছোট থেকে শুনে আসছি, বিজেপি’র জমানায় আপ রুচি খানা আর নয়, এবার খাবার দাবার নিয়ন্ত্রণ করবেন সেই মূর্খের দল, যারা খাবারের ইতিহাস পড়েনি, জানে না, যারা রামায়ণ মহাভারতও পড়েনি, এমন কি তাদের কাছে হিন্দু জাগরণের শ্রেষ্ঠ নেতার জীবনীটুকুও ঠিকঠাক পড়া নেই।

আমি নিশ্চিত বিবেকানন্দ বেঁচে থাকলে নিশ্চিত বলতেন, যদি পছন্দ না হয় সরে পড় না কেন? তোমাদের দু চার জনের জন্য দেশশুদ্ধ লোককে হাড় জ্বালাতন হতে হবে বুঝি? চরে খাওগে না কেন?

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Trump | ঘদর H মি/সাইলে কাঁপুনি ধরাচ্ছে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে, ট্রাম্পের নতিস্বীকার, কী এই মিসাইল?
00:00
Video thumbnail
Iran-Israel | ভয়ে যু/দ্ধবিরতি ভিক্ষা করছেন ট্রাম্প? কী বলছে ইরান? দেখুন বড় খবর
00:00
Video thumbnail
Donald Trump | ইরানের হা/মলা/য় বেকায়দায় ট্রাম্প, কাতারের মধ‍্যস্থতায় ট্রাম্পের নতিস্বীকার
00:00
Video thumbnail
Donald Trump | মধ‍্যপ্রাচ‍্যে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে ইরানের হা/মলায় যু/দ্ধ বিরতির সুর ট্রাম্পের গলায়
00:00
Video thumbnail
Politics | ধর্ম নিয়ে ছিল স্লোগান ভোটে বিজেপি খা/নখান
02:39
Video thumbnail
Trump | ঘদর H মি/সাইলে কাঁপুনি ধরাচ্ছে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে, ট্রাম্পের নতিস্বীকার, কী এই মিসাইল?
04:05
Video thumbnail
Iran-Israel | ভয়ে যু/দ্ধবিরতি ভিক্ষা করছেন ট্রাম্প? কী বলছে ইরান? দেখুন বড় খবর
11:13
Video thumbnail
Donald Trump | ইরানের হা/মলা/য় বেকায়দায় ট্রাম্প, কাতারের মধ‍্যস্থতায় ট্রাম্পের নতিস্বীকার
09:15
Video thumbnail
Eco ইন্ডিয়া | বিশ্বজুড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষরা টিকে থাকার হু/ম/কিতে রয়েছে, কেন?
09:49
Video thumbnail
BJP | শুধু বাংলা নয়, কোথায় কোথায় হারল বিজেপি?
03:29:35