skip to content
Sunday, February 9, 2025
HomeScrollFourth Pillar | মৃত কুম্ভের সন্ধানে এক বোবা ভারতের গল্প
Fourth Pillar

Fourth Pillar | মৃত কুম্ভের সন্ধানে এক বোবা ভারতের গল্প

মানুষের সক্রিয় প্রতিরোধ না গড়ে উঠলে দেশের কপালে অনেক দুঃখ আছে

Follow Us :

২০১৬, রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন, ঠিক তার আগে ভেঙে পড়েছিল পোস্তার ব্রিজ। ৩১ মার্চ, ২০১৬-র ওই ঘটনাতে মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন। তো সেই নির্বাচনী প্রচারে এসে আমাদের শ্রীল শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদী কী বলেছিলেন? শুনুন তাহলে। https://youtu.be/CR9aLZRAT3Q?si=AIaXQOb02YU59jNq
বলেছিলেন যে ভগবান নির্দেশ দিয়েছেন, এই যে ফ্রড, দুর্নীতিপরায়ণ রাজ্য সরকার, তাকে হারানোর জন্য স্বয়ং ভগবান নির্দেশ দিয়েছেন, এই ঘটনা আসলে ভগবানের নির্দেশ। আজ পাতাজোড়া সহাস্য বিজ্ঞাপন দিয়ে, কোটি কোটি মানুষের ভক্তি আর রীতি রেওয়াজের কথা বলে, পুণ্যস্নানে অভূতপূর্ব নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে এই দাবি করার পরে ইতিমধ্যেই ৩০ জনের মৃত্যু কোন নির্দেশ দিচ্ছে? কোন সত্যকে তুলে ধরছে। কিন্তু আজ আমার আলোচনা মোদিজি কী বলেছেন বা বলেন তা নিয়ে নয়, আমার আলোচনা বহু এমন ঘটনা নিয়ে যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোদিজি এই তীব্র ভাষাতে তার নিন্দা যেমন করেছেন, তেমনই সঙ্গে পোঁ ধরেছে গোদি মিডিয়া, বিশিষ্ট মানুষজন, কিন্তু যখন সেই একই ঘটনা মোদিজির আমলে ঘটছে তখন মোদিজিও চুপ, চুপ করে থম মেরে বসে আছেন বিশিষ্ট জনেরা, আর পাড়ার নেড়িকুকুরের মতো লেজ নাড়াচ্ছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বড় অংশ। দেখুন তাকিয়ে, এতবড় ঘটনা, মেন স্ট্রিম মিডিয়ার কভারেজ দেখে মনে হবে যেন কিছুই হয়নি, আর কিছু কভারেজে বলা হচ্ছে এর পিছনে এক বিরাট ষড়যন্ত্র আছে, বিরাট কনস্পিরেসি করেই মোদি-যোগীকে বদনাম করার কাজ করা হচ্ছে, অর্ণব গোস্বামী থেকে নবিকা কুমার থেকে সুধীর মিশ্রা নেমে পড়েছেন অবস্থা সামাল দিতে। আমি আজ এরকম আরও কিছু ঘটনার কথা বলব।

একজনের কোটেশন দিচ্ছি, কোটেশনগুলো সবই ওই ধরুন ২০১২–২০১৩-এর মধ্যে কোনওটা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, কোনওটা হিন্দুস্থান টাইমসের থেকে নেওয়া। সেই সময়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং প্রেক্ষিত হল আমাদের দেশের অর্থনীতি। হু হু করে টাকার দাম পড়ছে। আর তাই নিয়ে তুলকালাম। বামপন্থী থেকে দক্ষিণপন্থী প্রত্যেকে, চোখা চোখা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, রাতে টিভিতে ডিবেট হচ্ছে, দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো, চিল চিৎকার, সেই সুভদ্র মানুষটি বোঝাচ্ছেন দেখুন আসলে ডলার শক্তিশালী হচ্ছে আসলে ইত্যাদি প্রভৃতি। কে শোনে কার কথা। এই বাংলার স্ট্রিট কর্নার মিটিংয়ে সদ্য ক্ষমতা হারানো বামপন্থী নেতা ভাষণে বোঝাচ্ছেন মনমোহন মমতা এক হ্যায়, ভুলো মাৎ, ভুলো মাৎ। ঠিক সেই সময়ের কোটেশন। “Our country’s rupee is falling. The value of the rupee is continuously falling. During Atalji’s government, the rupee was at 40-45 to the dollar. And under this government, it has kept falling: 62, 65, 70…” আমাদের দেশের টাকা পড়ছে, টাকার মূল্য লাগাতার নামছে, অটলজির সময়ে টাকার মূল্য ছিল ৪০-৪৫ টাকা প্রতি ডলার এখন নামছে, ৬২-৬৫-৭০। ঝরে পড়ছিল ব্যঙ্গ। আর একটা কোটেশন, The rupee is in the hospital and has been admitted to the ICU. The government has told us that in two months the rupee will become stronger. But did it? They are unable to do so. They have lost control of the country.” টাকা হাসপাতালের আইসিইউ-তে, সরকার বলেছিল দু’ মাসে টাকা আবার ঘুরে দাঁড়াবে, হয়নি। সরকার দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। শেষ নয়, আরও একটা দিই। “While the rupee has been falling the government has not done anything about it. Once the rupee keeps falling, world powers take advantage of it.” টাকা পড়ছে সরকার কিছু করছে না কিন্তু টাকা পড়লে বিশ্বের অন্য শক্তিরা তার সুযোগ নেয়।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপি ভারতকে, আমার স্বদেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে

আমি জানি এতক্ষণে সব্বাই বুঝে ফেলেছেন এই অর্থনীতিবিদ কে? হ্যাঁ ইনি নন আদার দ্যান নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। শুধু কি তিনি, দেশে কি অর্থনীতিবিদ কম পড়িয়াছিল? একজন বললেন “Dollar on an escalator. Rupee on a ventilator. Nation in ICU. We are in coma,” ডলার এসকালেটরে, টাকা ভেন্টিলেটরে, দেশ আইসিইউ-তে আর আমরা কোমাতে। এই অর্থনীতিবিদের নাম শিল্পা শেঠি, কিসের জন্য বিখ্যাত তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। আর একজনের কথা ভুলিনি। “The only way the rupee can save itself is by tying à rakhi on the dollar.” টাকা নিজেকে বাঁচাতে পারে যদি ডলারের হাতে রাখি পরায়, কী স্যাটায়ার, বললেন যে পণ্ডিত, তাঁর নাম জুহি চাওলা। এবারে মাঠে বাদশাহকে বাদশাহ, অমিতাভ বচ্চন, তাঁর টাকা অনেক বেশি, এসব কোটেশন লিখে দেওয়ার লোকও অনেক বেশি। তাঁর টুইটারে আমরা দেখলাম ব্যঙ্গ “New word added to English dictionary: RUPEED (ru-pee-d), VERB meaning: move downward…” এখন থেকে পড়ে যাওয়াকে আমরা টাকাআআআআ বলে ডাকব। তো এই সব অর্থনীতিবিদরা এখন কোথায়? শুনেছেন মোদিজিকে একটা কথাও বলতে? একটা শব্দ? মনমোহন সিং তো তবু কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন, কংগ্রেসের আরও কেউ কেউ, মানে চিদম্বরম ইত্যাদিরা কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এবারে? মোদিজি তো বিপদ বুঝলেই মৌনিবাবা হয়ে যান এটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু আর অন্যরা? জেএনইউ-র সুবক্তা নির্মলা সীতারামন? ওদিকে শিল্পা শেঠি? জুহি চাওলা? আমাদের গুরু অমিতাভ বচ্চন? বোবায় ধরেছে? অর্ণব গোস্বামী? দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো? রাতের কলতলাতে একবারও? আমাদের আনন্দ নিরানন্দ পাবলিক রিপাবলিক বা ২৪/৩৬ ঘন্টার একটা অনুষ্ঠানে শুনেছেন যে টাকার দাম হু হু করে কমছে, আর ক’দিনের মধ্যে সেঞ্চুরি পার করবে?

না কেউ কথা বলছে না। এবং আপনারা ভাবছেন এই একটা ব্যাপারে চুপ করে আছে? না না, চলুন আরও কতগুলো বিষয়ে এই পুরো মোদি সরকার, মিডিয়ার হনুদের, তথাকথিত পোঁ ধরা বুদ্ধিজীবী শিল্পী কলাকুশলীদের হীরণ্ময় নীরবতা নিয়ে কথা বলা যাক। গত ১৪-১৫ দিন ধরে শেয়ার বাজারে উবে গেছে কমসম করে ৯ লক্ষ কোটি টাকা। বড়দের কথা ছাড়ুন, ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটে আর কুলোচ্ছে না বলে যে মধ্যবিত্ত মানুষজন তাদের সামান্য পুঁজি এসআইপি বা সরাসরি শেয়ার বাজারে ঢেলেছেন তাদের টাকা উবে গেছে। কোথাও কোনও শব্দ দেখছেন, কোনও ফার্স্ট পেজ হেডলাইন? নেই। অর্ণব গোস্বামীর চিল্লানেসরাস প্রোগ্রাম, বা ক্যাপ্টেন ময়ূখের জবাবদিহি? নেই। কেন নেই? এটা খবর নয়? আসুন অন্য খবরে, ইনকাম ট্যাক্স। হিসেব করে দেখুন কর্পোরেট ট্যাক্স কমে যাচ্ছে, ক্রমশ কমে যাচ্ছে, কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স যেই কার সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর মাইনে পাওয়া লোকজনের মধ্যবিত্তের ট্যাক্স দিতেই হয়, কেটে নেওয়া হয়, কোথাও কোনও আলোচনা দেখছেন, কোথাও বলা হচ্ছে যে মধ্যবিত্ত মানুষজনের দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখুন? কোনও কথা নেই। ডলার পড়ছে, সবচেয়ে বেশি ঝাড় মধ্যবিত্তের উপর, তাদের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার খরচ বাড়ছে, বেড়াতে যাওয়ার আগে গায়ে ছ্যাঁকা লাগছে, তাদের সামান্য পুঁজি শেয়ার বাজারে এসআইপি-তে, মিউচুয়াল ফান্ডে, উবে যাচ্ছে, তাদের উপরেই সবথেকে বেশি চাপ ইনকাম ট্যাক্সের, অথচ না রাজনৈতিক নেতাদের মুখে, না মিডিয়াতে, কোথাও কোনও চর্চাই নেই। ২০১২-২০১৩তে যাঁদের গলা শোনা যাচ্ছিল তাঁদের গলায় এখন ছিপি আটকে গেছে। কেন? একটা হিসেব দিই, খুব তাড়াতাড়ি মিলিয়নিয়ার্স তৈরি হচ্ছিল আমাদের দেশে, নতুন স্টার্ট আপ ইত্যাদি।

দ্য হেনলি প্রাইভেট ওয়েলথ মাইগ্রেশন রিপোর্ট ২০২৪ জানাচ্ছে, গত দু’ বছরে গড়ে, মানে প্রতি বছরে ৫০০০ জন মিলিওনিয়ার এদেশের পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেশে চলে গেছে। বেআইনিভাবে নয়, এক্কেবারে আইন মেনে সব বেচেবুচে স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে উড়ে গেছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে দেশে তাঁরা মনে করেছেন তাঁদের সম্পদ সুরক্ষিত, তাঁদের জীবনযাত্রার মান বাড়বে, সেখানে তাঁরা চলে গেছেন। অনেকে লং টার্ম ভিসা নিয়ে এক্কেবারে কেটে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করছেন। কেন যাচ্ছেন? অন্যদিকে সুপার রিচ কিছু মানুষ প্রতিটা কথায় সরকারের সমর্থন করছেন, ৯০ ঘণ্টা, এমনকী রবিবারে কাজ করার কথা বলছেন, এনারা ভোকাল কিন্তু মজার কথা হল এনারা খুব বড় কোনও ইনভেস্ট করছেন না, তাঁদেরকে যা হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কেবল সেগুলো কপাৎ করে গিলে চুপ করে বসে আছেন। এই নিন এই বিমানবন্দর, এই নিন রেল, এই নিন জাহাজবন্দর নিয়ে নিচ্ছেন কিন্তু হিসেব বলছে তাঁরা নতুন ইনভেস্টমেন্ট করছেন না। কেন করছেন না? কারণ বাজারে চাহিদা নেই, কেনার লোক নেই, দেশের বিরাট মধ্যবিত্ত আপাতত ল্যাঙ্গোট পরে বসে আছে, তাঁদের কাছে অপশন বেড়েছে, সেই বিশাল বাজারে সামাল দিতে বহু কিছুর চাহিদা হু হু করে কমছে। হঠাৎ মনে হয়েছিল যে দেশের মধ্যে ডোমেস্টিক ট্যুরিজমের বিশাল গ্রোথ হবে, কী হল? মধ্যপ্রদেশ ঘোরার খরচে আপনি আলামাটি, কাজাখস্তান ঘুরে আসতে পারছেন। কে যাবে মধ্যপ্রদেশে? গোয়াতে যাওয়ার বদলে মানুষ যাচ্ছে পাটায়া। বিস্কুট খাও পাটায়া যাও। কেন যাবে তার চেয়ে বেশি খরচ করে গোয়াতে? কাজেই হিসেব বলছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার ট্যুরিজম এক্সপ্যানশন প্ল্যান আর তার ইনভেস্টমেন্ট আপাতত মায়ের ভোগে।

বাজারের বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এক্সট্রা টুএবি-র খবর রাখা নরেন্দ্র মোদি কী বলছেন? বলছেন সাল মে ঢাই লাখ কার বিক রহা হ্যায়, আড়াই লক্ষ গাড়ি বিক্রি হচ্ছে। একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পেতেন যে লো এন্ডের গাড়ি বিক্রি হচ্ছে না কিন্তু হাই এন্ডের গাড়ির জন্য লাইন লেগে আছে। চাইলেই মিলছে না, বাজারে চাহিদা নেই, ইনভেস্টমেন্ট করছেন না, তাহলে করবেন কী? বড়লোকেরা হাত পা খেলিয়ে গাড়ি হিরে প্ল্যাটিনাম কিনছেন, অর্থনীতির ভাষায় লিজার ইকনমি। বর্ষার বিকেলে সুইগিকে দিয়ে আলুর চপ আনিয়ে খাওয়ার মতো একটা ব্যাপার। কুম্ভমেলার বিপর্যয় থেকে টাকার হু হু করে নামা থেকে ইনকাম ট্যাক্সের বোঝা থেকে শুরু করে শেয়ার মার্কেটের বিপর্যয়, সর্বত্র এক হীরণ্ময় নীরবতা। কেউ কোনও কথা বলছেন না। কেন এই নীরবতা? তার কারণ চতুর্থ স্তম্ভ এখন পঙ্গু, বিরোধী ঐক্য গেছে গড়ের মাঠে ঘাস খেতে আর সেই মধ্যবিত্ত যাঁরা বা যাঁদের এক বড় অংশ বুদ্ধিজীবী, সিভিল সোসাইটির অংশ আপাতত ভয় পেয়ে, বিরক্ত হয়ে ঘরে বসে আছেন। তা না হলে দেশ, দেশের সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, শ্রমিক কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের যা অবস্থা তাতে গরিষ্ঠ মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়াতেই নরেন্দ্র মোদির সরকার কবেই বঙ্গোপসাগরে, আরব সাগরে হাবুডুবু খেত। মানুষের সক্রিয় প্রতিরোধ না গড়ে উঠলে দেশের কপালে অনেক দুঃখ আছে।

RELATED ARTICLES

Most Popular